অনলাইন ডেস্ক : শোকাবহ জেলহত্যা দিবস আজ। বাঙালি জাতির ইতিহাসে কলঙ্কময়, রক্তঝরা ও বেদনাবিধুর দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিন (আজ ৩ নভেম্বর) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নিভৃত প্রকোষ্ঠে বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ও মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মধ্যরাতে কারাগারের ভেতরে এমন জঘন্য ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সেদিনের ওই ঘটনা দেশবাসীসহ সারা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়েছিল। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি বাণীতে বলেন, জাতির পিতা দু’দশকের অধিককাল জাতিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার আহ্বানে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগারে বন্দি থাকাবস্থায় তার অবর্তমানে জাতীয় চার নেতা মুজিবনগর সরকার গঠন, রণনীতি ও রণকৌশল প্রণয়ন, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, কূটনৈতিক তৎপরতা, শরণার্থীদের তদারকিসহ মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে পরিণত করতে অসামান্য অবদান রাখেন। জাতি তাদের অবদান চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ড ছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ধারাবাহিকতা। এ ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি, দেশবিরোধী চক্র বাংলার মাটি থেকে আওয়ামী লীগের নাম চিরতরে মুছে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস এবং বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার অপচেষ্ট চালিয়েছিল। তিনি বলেন, আমরা জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচারকাজ সম্পন্ন করেছি। জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারও সম্পন্ন হয়েছে। জনগণকে দেয়া ওয়াদা অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য পরিচালনা করছি, বিচারের রায় কার্যকর করা হচ্ছে।
এদিকে জেল হত্যা দিবস উপলক্ষে এক ভিডিওবার্তায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় কোনো ব্যক্তিগত হত্যাকাণ্ড নয়, বাঙালিকে নেতৃত্বশূন্য করে স্বাধীন বাংলাদেশকে আবার নব্য পাকিস্তানে রূপান্তর করাই ছিল স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক চক্রের মূল লক্ষ্য। ১৯৭৫ সালে জাতীয় চার নেতার সঙ্গে একই কারাগারে থাকা আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতা স্মৃতিচারণ করে জানান, তারা ওইদিন রাত ২টা ২০ মিনিটে প্রথম ব্রাশফায়ারের শব্দ শুনতে পান। পরে ২০ মিনিট পর আবারও ব্রাশফায়ার। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর কাতরানোর শব্দ শুনে জাতীয় সব নেতার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য ঘাতকরা আবারও ব্রাশফায়ার করে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। জেলের ভেতরে এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড বিরল ঘটনা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
দিবসটি উপলক্ষে জাতীয় চার নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এমপি এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম। এক বিবৃতিতে তারা বলেন, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং অশুভ শক্তির কাছে মাথা নত করেননি, তারা আমাদের কছে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাদের এই দেশপ্রেম ও আদর্শের প্রতি আনুগত্য আমাদের চলার পথে সাহায্য করবে।
বিচার কার্যক্রম : জেল হত্যার পরদিন তৎকালীন উপকারা মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। তবে দীর্ঘ ২১ বছর এ বিচার প্রক্রিয়াকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার প্রক্রিয়া শুরু করে। ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর এ মামলায় ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মতিউর রহমান মামলার রায় দেন। রায়ে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন (পলাতক), দফাদার মারফত আলী শাহ (পলাতক) ও এলডি (দফাদার) আবুল হাসেম মৃধাকে (পলাতক) মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিন আহমেদসহ ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। সাবেক মন্ত্রী কেএম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে খালাস দেয়া হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে হাইকোর্ট ২০০৮ সালে মোসলেমের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি মারফত আলী ও হাসেম মৃধাকে খালাস দেন।
কর্মসূচি : সূর্যোদয় ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে সংগঠনের সব স্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ এবং কালো পতাকা উত্তোলন। সকাল ৮টায় ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবে আওয়ামী লীগ। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে নিহত সব শহীদ ও কারাগারে নির্মমভাবে নিহত জাতীয় নেতাদের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও মোনাজাত। রাজশাহীতে জাতীয় নেতা শহীদ কামরুজ্জামানের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও মোনাজাত। বিকাল সাড়ে ৩টায় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সংযুক্ত হবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
10