স্টাফ রিপোর্টার : ‘ভাই, আমি যে চাকরি করি, আমি ভাই এর মধ্যে কোনো ফাঁক রাখি না। আমি যদি পাঁচ টাকা খাব, এই কাজ আমি করি না যে সিনিয়র অফিসারকে ফাঁকি দেব। এই কাজ আমি করি না, কোনদিনও না। এখন আমার কোনো সমস্যা হলে সিনিয়র অফিসার আমাকে সেইফ করে কীভাবে?’
মুঠোফোনে মাহমুদ হাসান লিমন নামে মামলার এক আসামির সঙ্গে এভাবেই কথা বলেছেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মহিউদ্দিন। এর ফোনকল রেকর্ড পাওয়া গেছে। মহিউদ্দিন এখন নগরের বোয়ালিয়া থানায় কর্মরত। আগে ছিলেন চন্দ্রিমা থানায়। আসামির সঙ্গে কথোপকথনটি সে সময়ের। আসামিপক্ষ বলছে, এসআই মহিউদ্দিন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে টাকা নিয়েছেন।
মামলাটির আসামি আছেন রাজশাহী মহানগর ছাত্রদলের সাবেক নেতা মাহমুদ হাসান শিশিলও। তাঁর অভিযোগ, পারিবারিক বিরোধের কারণে তাঁর আপন বড় ভাই মেহেদি হাসান সিজারের শ্বাশুড়ি হাবিবা আক্তার মুক্তা একটি মামলায় পরিকল্পিতভাবে তাঁকে এবং তাঁর বন্ধু মাহমুদ হাসান লিমনকে আসামি করেছেন। ওই মামলার ঘটনার সঙ্গে তারা সম্পৃক্ত না থাকলেও এসআই মহিউদ্দিন এবং চন্দ্রিমা থানা থেকে বদলি হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। চন্দ্রিমা থানার তৎকালীন ওসি আবুল কালাম আজাদও এখন বোয়ালিয়া থানায়।
গত ২ জুলাই শহরের ভদ্রা পারিজাত আবাসিক এলাকার হাবিবা আক্তার মুক্তার বাসায় রাজশাহী মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌরিদ আল মাসুদ রনির অবস্থানের খবর পেয়ে ছাত্র-জনতা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা বাসাটি অবরুদ্ধ করেন। পরে পুলিশ নিয়ে বাসায় চল্লাশি চালালে সেখানে রনির সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে মুক্তা মামলা করেন যে, তাঁর ফ্ল্যাট থেকে ২ লাখ টাকা ও ১২ ভরি স্বর্ণালঙ্কার লুট করা হয়েছে। এ মামলায় শিশিল ও লিমনকেও আসামি করা হয়। ঘটনার সঙ্গে যে শিশিল সম্পৃক্ত না, তা এসআই মহিউদ্দিনের কথোপকথনেই উঠে আসে। তবে ফোনকল রেকের্ড শোনা যায়, ওসি আবুল কালাম আজাদ তা কিছুতেই মানছেন না বলে এসআই মহিউদ্দিন শিশিলকে বলেছেন।
ফোনকল রেকর্ডে শোনা যায়, শিশিল এসআই মহিউদ্দিনকে প্রশ্ন করছেন- ‘আপনি কি তদন্ত করেছেন আমি গেছি কি না বা চুরি করেছি কি না?’ জবাবে এসআই মহিউদ্দিন বলেন, ‘না, না রে ভাই। ওগুলো কিছুই নাই। এগুলো নিয়েই তো ওসি লেগেছিল আমার সাথে। আমি বললাম- স্যার, ইনি (শিশিল) কি ২ লাখ টাকা চুরি করবে? এগুলো কিচ্ছু নাই। শিশিল ওপরে যাইওনি। ওসি আমাকে বলে, কীভাবে জানলেন ওপরে যায়নি? আমি বলি ক্যামেরা দেখেন। একটা টাকা, এতটুকু স্বর্ণও চুরি হয়নি। আমি এসব বলে আসছি।’ এ সময় শিশিল বলেন, ‘সুষ্ঠুভাবে যেটা হবে, সেটা করবেন। আমার পক্ষেও করার দরকার নাই।’ কিন্তু তারপরও সিনিয়র অফিসারদের কথা বলে টাকা নেন এসআই মহিউদ্দিন। শিশিলের বন্ধু লিমন তাকে বিকাশের মাধ্যমেও টাকা দেন। এর স্ক্রিনশটও পাওয়া গেছে।
আবার লিমনের সঙ্গে মহিউদ্দিনের কথোপকথনের রেকর্ডে শোনা যাচ্ছে, মহিউদ্দিন তাকে প্রশ্ন করছেন- ‘তুমি যে আমাকে বিকাশে টাকা দিছো, এই স্ক্রিনশট মানুষের কাছে গেল কীভাবে? তোমরা যদি টাকা ব্যাক চাও, আমি তো ভাই ট্যাকা খরচ কইরে ফেলছি, সবই জানো।’ এ সময় লিমন বলেন, ‘আপনি আমাকে বললেন যে, “আমি স্যারের সাথে কথা বলেছি। ২ লাখ দিলেই এটা ঠিক করে দিচ্ছি।” আমি আপনাকে ওডাই দিতে চাহাচ্ছি ভাই। আপনি করে দেন।’ আরেক ফোনকল রেকর্ডে শোনা যায়, লিমন মহিউদ্দিনকে বলছেন- ‘আমি লিমন নিজে বলছি। আমার নাম থেকে যাক। আপনি ভাইয়ের (শিশিল) নামটা শুধু বাদ দেন।’ এ সময় মহিউদ্দিন বলেন, ‘এ ভাই, আমি তো পারব না রে ভাই। তোমরা তো বিষয়ই বুছতেছো না। মামলার মনিটরিং অফিসার হলো ডিসি স্যার। ডিসির ওপরে হলো কমিশনার। তোমরা কি জান? মামলা খালি আমাদের কাছে থাকে তাই। সব ডিরেকশন ওনারা দেয়। আমরা চাকরি করি ভাই সবাইকে লিয়েই। বোঝো নাই? আমার দ্বারা একটা লাইনও কারও ক্ষতি হবে না।’
মামলার আসামি মাহমুদ হাসান শিশিল বলেন, ‘আমাদের নামে মিথ্যা মামলা করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা মহিউদ্দিনই বলেছেন যে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। চুরির ঘটনাও নেই। তারপরও ওসি, ডিসি, কমিশনারকে দেখিয়ে অভিযোগপত্র দেওয়ার ভয় দেখিয়ে এসআই মহিউদ্দিন টাকা নিয়েছেন। তারপরও তিনি আদালতে প্রতিবেদন না দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছেন।’
ফোনকল রেকর্ড নিয়ে জানতে চাইলে এসআই মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমি এখন আর কি বলব ভাই? যা বলি, আমার গায়ে লেগে যায়। মাঝখানে অনেক কথা কেটে দিয়ে কিছু অংশ ওরা প্রচার করছে। হয়তো ওদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে, সে জন্য এটা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
আরএমপির মুখপাত্র গাজিউর রহমান বলেন, ‘এ বিষয়ে একটি অভিযোগ এসেছে। একজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

