নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

বাংলাদেশ মঙ্গলবার। রাত ১:২৮। ২১ অক্টোবর, ২০২৫।

জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন

অক্টোবর ২০, ২০২৫ ৩:০২
Link Copied!

ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে বেড়িবাঁধ ভেঙে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের গ্রামগুলি প্লাবিত হয়ে ঘরবাড়ি ও ফসলের ব্যাপক  ক্ষতি হয়, যার কারণে অনেকে নিঃস্ব হয়ে বাঁধের উপর আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ও দ্রুত বাঁধ মেরামত না হওয়ায় এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় এবং স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের ভিটেমাটি হারিয়ে জীবিকা সংকটে পড়েন। অনেকেই তাদের বসতভিটা হারিয়ে স্থায়ীভাবে বাঁধের উপর খুপরি ঘর তৈরি করে বসবাস করতে বাধ্য হন। বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পানখালী গ্রামের আমিরন বিবি তার স্বামী এবং চার সন্তান নিয়ে খুলনা শহরে আশ্রয় নেন। সুন্দরবনের কারণে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় রিমালের হাত থেকে বড়ো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহত হওয়া থেকে উপকূলবাসী রক্ষা পেলেও টানা দুই দিনের ঝড়-বৃষ্টিতে আমিরন বিবি তার খুপরি ঘরসহ সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। কয়েক দিন বাঁধের উপর খোলা আকাশের নিচে থেকে জমানো সামান্য কিছু টাকা নিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে  চলে আসেন খুলনা শহরে।

দশ বছর আগে ১৪-১৫ বছরের কিশোরী আমিরন বিবি’র সাথে বিয়ে হয় একই গ্রমের ২১ বছরের নজরুলের সাথে। বিয়ের পর থেকেই আমিরন বিবি’র শাশুড়ি ও স্বামী কারণে অকারণে নানারকম অপবাদ দিতো। তখন আমিরন বিবি’র মনে হতো সব সমস্যার জন্য সে নিজেই দায়ি। শাশুড়ি গত হয়েছে। অল্প বয়সে বিয়ে, পরপর চার সন্তানের জন্ম,আর্থিক দুরবস্থা সব মিলিয়ে তাদের বস্তির জীবন খুবই কষ্টে কাটে। তারপরও ভুলতে পারে না পানখালী গ্রামের কথা।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বিশ্বের ১০৯টি দেশের ৬৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ১১০ কোটি মানুষ চরম বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে ভুগছে। সরাসরি জলবায়ু ঝুঁকিতে রয়েছে বিশ্বের প্রায় ৯০ কোটি মানুষ যা মোট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশ। খরা, বন্যা, তাপপ্রবাহ বা বায়ুদূষণের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে কেউই এখন পুরোপুরি নিরাপদ নয়। কিন্তু সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীই এর সবচেয়ে কঠিন প্রভাবের শিকার। সাহারার দক্ষিণাঞ্চলীয় আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় মানুষ দারিদ্র্যের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। চরম তাপমাত্রা, খরা, বন্যা ও বায়ুদূষণ-এই চারটি জলবায়ু ঝুঁকির কারণে এই অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষভাবে ঝুঁকিতে রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও এর ফলে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ অভিবাসন একটি আলোচিত কিন্তু জটিল বিষয়। বিশেষ করে আমাদের দেশের জন্য এটা আরও বেশি সমস্য। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসন সারা বিশ্বের জন্যই একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের প্রধান সমস্যাগুলো হলো নিজ ভূমি ত্যাগে বাধ্য হওয়া, উন্নত আবাসন ও কর্মসংস্থানের অভাব, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, আধুনিক দাসত্বে জড়িয়ে পড়া এবং আইনি স্বীকৃতির অভাব। এশিয়ার অতিদ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণজনিত সবচেয়ে সমস্যাপূর্ণ দেশ হলো বাংলাদেশ। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার কম-বেশি ৪২ শতাংশ লোকের বাস শহরাঞ্চলে। অথচ ১৫ বছর আগেও এ হার ছিল কম-বেশি ২৫ শতাংশের মতো। শহরের মোট জনসংখ্যার কম-বেশি ৫৪ শতাংশ মানুষ আবার বস্তিবাসী। তাঁদের প্রতি চারজনের তিনজন জলবায়ু উদ্বাস্তু। শহরের অন্যান্য এলাকার তুলনায় বস্তি এলাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব কম-বেশি ৭ গুণ বেশি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা, মরুকরণ ইত্যাদি কারণে এসব মানুষ ঘরবাড়ি ও জীবিকা হারায় এবং জীবনধারণের জন্য নিরাপদ আশ্রয় ও কর্মসংস্থান খুঁজতে গিয়ে শহরে ভিড় করে, যা শহরগুলোকে ঘনবসতিপূর্ণ করে তোলে ও নতুন নতুন সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করে।

প্রতিদিন ঢাকা শহরেই নতুন করে কম-বেশি ২ হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তু যুক্ত হচ্ছে, বছরে এই সংখ্যা সাত লক্ষাধিক। শুধু ২০২৪ সালেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের ২৪ লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এদের একটা বিরাট অংশ দক্ষিণ অঞ্চল থেকে আসে। গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষেরা সাধারণত কাজের কিছু সুযোগ পেলেও বসবাস, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি ও স্যানিটেশনসহ মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত হন। অধিকাংশ সময়েই  এসব বাস্তুচ্যুত মানুষকে সরকারের বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতার আনতে নানারকম সমস্যা দেখা দেয়। সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো  জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী ঠিকানা নিবন্ধিত থাকায় তারা সাধারণত সেটি পরিবর্তন করতে চায় না। অন্যদিকে অস্থায়ী বস্তিবাসী হিসেবে ঠিকানা পরিবর্তন করাও একটি চ্যালেঞ্জ হওয়ায় তারা অধিকাংশ সময়েই সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতার বাইরে থেকে যায়।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ১৯টি শহরের বস্তিতে বসবাসকারী কম-বেশি ৫২ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো জলবায়ুজনিত দুর্যোগের কারণে শহরে এসেছে। এর মধ্যে বন্যা, নদীভাঙন এবং ঘূর্ণিঝড় প্রধান কারণ। এই জনগোষ্ঠীর কম-বেশি ৮০ শতাংশ মধ্যম দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং ৫০ শতাংশ চরম দারিদ্র্যের শিকার। এদের মাত্র ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাভুক্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাসস্থান হারানো, সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং সহিংসতার ঝুঁকি এসবের মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে স্থানান্তরের ফলে শিশুরা স্কুলছুট হয় আর মেয়েশিশুরা পড়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে। ১৪-১৫ বছরের মেয়েশিশুদের বিয়ে হচ্ছে, যা একদিকে স্বাস্থ্যগত সংকট, অন্যদিকে একটি প্রজন্মের সম্ভাবনাকে গ্রাস করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি ও মৎস্যখাতে ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে ৫২ শতাংশ পরিবারে লবণাক্ততা, অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কম-বেশি ৬৬ শতাংশ পরিবারের লবণাক্ততা, পানির উষ্ণতার কারণে খাদ্য নিরাপত্তা ও উর্পাজন বাধাগ্রস্ত হয়। ৪২ শতাংশ পরিবার ফসলের হানি, ৪৮ শতাংশ পরিবার গবাদিপশুর ক্ষতিসহ বিভিন্ন ক্ষতির সম্মুখীন হন । জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রজনন ও যৌনস্বাস্থ্যেও প্রভাব পড়ে।

জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে কক্সবাজারে বড়ো একটি আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। জলবায়ু শরণার্থীদের জন্য এ ধরনের পুনর্বাসন প্রকল্প বিশ্বে এই প্রথম। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর কোনো আর্থিক সহায়তা ছাড়াই এ ধরনের প্রকল্প পৃথিবীতে বিরল। । অথচ বারবার আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে দাবি সত্ত্বেও কার্বন দূষণকারী দেশগুলো জলবায়ু শরণার্থীদের পুনর্বাসনে কোনো দায়িত্বই নেয়নি। বাঁকখালী নদীর পূর্ব-উত্তর পাড়ের খুরুশকুল এলাকায় ২৫৩ একর জায়গাজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে ১৩৭টি পাঁচতলা ভবন। ২০১৭ সালে খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০২০ সালে প্রাথমিকভাবে ৬০০ পরিবারকে নামমাত্র মূল্যে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হয়। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় থাকা পরিবারগুলো মূলত কক্সবাজার পৌরসভার কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া ও নাজিরারটেক এলাকার বাসিন্দা।

বর্তমানে ঢাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে ১০-১৫ লাখ মানুষ বিভিন্নভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে ঢাকা শহরেরে এসে বসবাস করছে। এসব বাস্তুচ্যতু মানুষ ঢাকা মহানগরির ভঙ্গুর অবকাঠামো, আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর ওপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করছে। আবার যারা গ্রামে আছে, তাদের অবস্থাও আরও শোচনীয়। মৌলিক নাগরিক সেবার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে নিজেদের ঘরবাড়ি ও ভিটেমাটি হারাতে হয়েছে, যার ফলে তারা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। কৃষি, মৎস্যচাষ বা অন্যান্য পেশা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ব্যাহত হওয়ায় তারা পেশা পরিবর্তন করতে বা নতুন কাজ খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে। নিজ এলাকা থেকে উচ্ছেদ হয়ে তারা কর্মসংস্থান ও আশ্রয়ের আশায় শহরে ভিড় করছে, যার ফলে শহরগুলো অতিরিক্ত ঘনবসতিপূর্ণ ও বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। নিরাপদ আশ্রয় না থাকায় এবং দুর্বল অবস্থানের কারণে তারা আধুনিক দাসত্ব বা অন্যান্য শোষণের শিকার হচ্ছে। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য এখনও কোনো স্পষ্ট আন্তর্জাতিক বা জাতীয় আইনি কাঠামো নেই, যা তাদের স্বীকৃতি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ও বিত্তশালী ব্যক্তিরা উদ্বাস্তুদের দুর্বলতার সুযোগে তাদের জমিসহ অন্যান্য সুবিধা দখল করে নেয় । নিরাপদ আশ্রয় ও নিয়মিত জীবনধারণের অভাবে তারা স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।

প্রযুক্তির সহায়তায় জলবায়ু উদ্বাস্তুদের ট্র্যাকিং এর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে তাদের জন্য টেকসই পুনবাসন নিশ্চত করার উদ্যোগ নিলে সুফল পাওয়া যাবে।তাদের কর্মসংস্থান , খাদ্যনিরাপত্তা এবং বাসস্থনের ব্যবস্থা করতে হবে। শহর ও গ্রামে উভয় জায়গায় জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য গুরুত্বসহকারে  সমানভাবে কাজ করতে হবে। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের মধ্যে নারী, শিশু, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধীদের মতো ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী রয়েছে। সবার জন্য এক রকম সমাধান কার্যকর হবে না,প্রত্যেককে তার প্রয়োজন অনুযায়ী সমস্যার সমাধান দিতে হবে। সমস্যাগুলো কম-বেশি আমরা সবাই জানি,সমাধানের পথও আমাদের জানা আছে, দরকার শুধু আন্তরিকতা, প্রস্তুতি এবং সদিচ্ছা।

লেখক: ইমদাদ ইসলাম
সিনিয়র তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর।
পিআইডি ফিচার

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময়ের কথা ২৪ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন somoyerkotha24news@gmail.com ঠিকানায়।