নওগাঁ প্রতিনিধি : গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ মেলা আজ শুধ্ইু স্মৃুতি…। ছেলে বয়সিদের আবদার ও বায়না ধরার অপর নাম মেলা নামে আখ্যায়িত এই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনে। নওগাঁর পত্নীতলার নজিপুর ইউনিয়নের ‘পদ্মপুকুর শ্রী শ্রী ক্ষিতিশা কালী মন্দির’ এর উদ্যোগে কালি পূজা উপলক্ষে স্থানীয় স্কুল মাঠসহ আশেপাশে পুকুর পাড়ে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ মেলা বুধবার (১৭ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মেলায় সকল ধর্মের নানান বয়সীদের উপচেপড়া ভিড়। মেলায় প্রবেশ হতে শুরু করে শেষ পর্যন্ত জনতার ধাক্কা-ধাক্কির মধ্যে দিয়ে উপভোগ করতে হয়। গত বছর মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে মেলা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এ বছর মেলায় লোক-জনের চাপ ও বেচাকেনা বেড়েছে।
মেলায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে ও বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়, পঞ্জিকা মতে, পহেলা সংক্রান্তির দিন এ পূজা প্রতি বৎসরের ন্যায় আয়োজন করা হয়। তবে, পহেলা সংক্রান্তির আগের দিন মেলার স্টলগুলো প্রস্তুতিমূলক সীমানা নির্ধারণ ও দোকান বসলেও মূলত একদিন ব্যাপী এ পূজা ও মেলা বসে। কিন্তু, মেলায় ব্যাতিক্রম ভাবে কাঠের ফার্ণিচার সামগ্রীর দোকান আরো ১০ থেকে ১৫ দিনও অবস্থান করে থাকে।
এছাড়া, অন্যান্য মেলার জিনিসপত্রের দোকান একদিন জমজমাট কেনা-বেচা হয়। তবে, মেলাটি ভাঙতে ভাঙতে পূব নির্ধারিত দিনের পরদিন প্রায় অর্ধ বেলা লেগে যায়। কারণ, নির্ধারিত মেলার দিন গভীর রাত অবধি চলে জমজমাট বেচা-কেনা।
মেলায় শিশু ও তরুণ-তরুণীদের প্রধান আর্কষণ খেলনার দোকান গুলোতে। আর উপভোগ ও বিনোদনের জন্য দোলনা ও ঘূর্ণিপাক খেতে দেখা যায়। দেশীয় তৈরি আসবাবপত্র ও জিনিসপত্র গ্রামীণ মেলার ঐতিহ্য ও প্রাণ। তাই দেশীয় তৈরির জিনিসপত্র মেলায় চোখে পড়ার মত ছিল সবার নজরেই। এদের মধ্যে খেলনা সামগ্রী শিশুদের জন্য বায়নার বস্তু ছিল অধিকাংশ দোকানই।
শিশুদের খেলনার জন্য মাটির তৈরি মৃৎশিল্পিদের হাতের তৈরি রঙিন তুলির আঁচড়ে শোভা ও সবার দৃষ্টি নন্দিত সামগ্রীর মধ্যে-পয়সা জমানো মাটির ব্যাংক, হাড়ি-পাতিল, কড়াই, কলস, জাগ, বদনা, টমেটো, ডাব, মরিচ বাটার শিলপাটা ও নোড়া, বেলনা, ফুলদানি, বিলাতি, লাউ, বেগুন, মরিচ, হাতি, ঘোড়া, সিংহ, বাঘ ইত্যাদি। এছাড়াও নিত্য প্রয়োজনীয় মৃৎশিল্পিদের হাতের তৈরি হাড়ি, পাতিল, কড়াই, মটকি, দইয়ের খাবলী, ফুলের টব, ডাবর ঢাকনা, খাঁসা, খুঁটি, কলসি, মাটির ব্যাংক, প্রদীপ, সহ বিভিন্ন রকমারি জিনিসপত্র।
কামার শিল্পের নিড়ানি, কাচি, দা, কুড়াল, ফাঁফড়া, কোদাল, খুন্তি, শাবল, যাঁতা, ধারাপল্লি-বাটকারা, বটি, চামুচ, ছুড়ি, চাকু, চাপাতি, ইত্যাদি সামগ্রী। যা প্রকারভেদে ১০ টাকা থেকে সাড়ে ৪শ টাকায় বিক্রি হয়।
জেলার পত্নীতলা উপজেলার চকনিরখীন বাসিন্দা (ঠুকনিপাড়া) গয়ার পালের পুত্র সঞ্জিত কুমার পাল (৪৪) তার স্ত্রী কবিতা পাল (৩৮), একই গ্রামের যমুনা প্রসাদ পালের পুত্র সুরেশ পাল (৪৬) সহ আরো বেশ কয়েকজন মৃৎশিল্পিদেরসাথে কথা হলে তারা জানান, এ কাজে পরিশ্রমও প্রচুর। শ্রমের তুলনায় ঐসব তৈরি জিনিস পত্রের ও উপযুক্ত মূল্য পাওয়া যায় না। এছাড়া আধুনিক জিনিসপত্রের সঙ্গে ব্যাপক প্রতিযোগিতা।
যেমন ফ্লাস্টিক, এ্যালোমোনিয়াম, কাঁসা, স্টিলসহ বিভিন্ন ধরণের সামগ্রী মাটির তৈরি তৈষসপত্র বিকল্প স্থান দখল করে নিয়েছে। ফলে মৃৎশিল্পীদের হাতের তৈরি জিনিস পত্রের চাহিদা কম। তবে দইয়ের খাবলী ও গুড় রাখার মটকির চাহিদা কিছুটা রয়েছে। তবে বিগত কয়েকে বছর ধারে থান গুড় তৈরি হওয়ায় মটকির চাহিদা অনেক কমেছে। তবে, মেলাতেই শিশুদের খেলনা গুলো বেশি বিক্রয় হয়ে থাকে। তবুও বাপ-দাদার চৌদ্দ গোষ্ঠীর পরমপরায় এ পেশাটাকে ও দেশীয় এ ঐতিহ্য ঠিকে রাখতেই লাভ আর লোকশানের কথা না ভেবে পেশাটা ধরে আছেন মাত্র। তারা আরো জানান, সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা পেলে বাঙালির এ দেশীয় তৈষজপত্র টিকে রাখা সম্ভব। এ বিষয়ে তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
শিশুদের খেলনা সামগ্রীর মধ্যে কাঠের তৈরি ঘোড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় ও ট্রাক ৫০ থেকে ১৫০ টাকায় প্রকারভেদে বিক্রয় হয়।
এ খেলনা কারিগর ও বিক্রেতা পত্নীতলা উপজেলার ডাসনগর দিঘীপাড়ার বাসিন্দা নজরুল ইসলামের পুত্র মামুনুর রশিদসহ অনেকেই জানান, আমরা শুধু মাত্র মেলাতেই এ খেলনা সামগ্রী বিক্রয় করে থাকি। এতে যা আয় হয় কোন রকমে জীবিকা ও সংসার চললেও খুশি।
মেলায় দেশীয় প্রস্তুত করণ সাংসারিক ব্যবহার্য কাঠের তৈরি সামগ্রী পিঠা তৈরির বেলচা, তালের রস (শ্বাস) বের করার জিনিস, পিঁড়ি, টুল ইত্যাদি। এসব আসবাবপত্র প্রকারভেদে ৫০ থেকে ১৯০ টাকায় বিক্রি হয়। মহাদেবপুর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামের মনোরঞ্জন কুমারের পুত্র বিধান কুমার (৪২) জানান, কাঠের তৈরি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুলো মেলাতে বেশি বিক্রয় হয়ে থাকলেও হাটে হাটে বিক্রয় করে থাকি।
শিশুদের হাতে অস্থায়ী রঙের ছাপ মারা দেখার মত ছিল, যাতে লেখা আছে, আই লাভ ইউ, মা, আল্লাহ্ আকবর, তুমি শুধু আমার, জান আমার জান, প্রাণের চেয়েও প্রিয়, তুমি যে আমার, তোমাকে ভালবাসি, জীবন আমার তুমি ইত্যাদি জল ছাপ। এগুলো রঙের ছাপ মারতে ৫ থেকে ১০টাকায় পাওয়া যায়।
মেলায় তরুণীদের ভিড় দেখা যায়, কসমেটিকস দোকানগুলোতেই বেশি। এছাড়া আনন্দ বিনোদন উপভোগ করতে দোলনা চড়ে ও ঘূর্ণিপাক খেতে অনেকের দেখা গেছে। মাত্র ১০ থেকে ১৫ টাকায় এ উপভোগ করা যায় কয়েক মিনিটের জন্য ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ পাক ঘুরানো হয়।
শিশুদের আরো একটি প্রিয় বাঁশের বাশি, বেলুন, বেলুনের তৈরি মাছ, ঘোড়া, বাঘ, কাঠের এক হাতল চালানো খেলনা গাড়ি, ইত্যাদি।
এছাড়াও লটারি খেলা, ফুচকা ও চটপটি, পিয়াজু, চিংড়ির শুটকির পিয়াজু, মিষ্টান্ন দোকানে রসগোল্লা, জামমিষ্টি, কালোমিষ্টি, বালিশা, জিলেপি, বাদশার তৈরি ঘোড়া, হাতি, মাছ, সিংহ। পানিফল, পাপড়, মাষকালাই রুটি, শরবত, বাতাবি লেবু, পাকা কলা, পান-সুপারি, গুড়, বেল ও বিশেষ ছাড় মূল্যে জুতার দোকান ইত্যাদি।
পদ্মপুকুর শ্রী শ্রী ক্ষিতিশা কালী মন্দির এর পূজা উদযাপন কমিটির সংশ্লিষ্টরা বলেন, পঞ্জিকা মতে, পহেলা সংক্রান্তির দিন এ কালি পূজা প্রতি বৎসরের ন্যায় আয়োজন করা হয়। এ পূজা উপলক্ষে এ মন্দিরের আশে-পাশে মেলা বসে। এতে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী দেশীয় আসবাবপত্রের দোকান বসে। যা নানান ধর্মের-নানান বয়সের লোকজনের ব্যাপক সমাগম ঘটে।
পদ্মপুকুর মেলা বাস্তবায়ন কমিটির অন্যতম সদস্য রানু কুমার বলেন, এ মেলার আসর উপলক্ষে বছরের একটি দিনে অত্র এলাকার আশে-পাশের গ্রাম গুলোর প্রতিটি পরিবারে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের মিলন মেলা পরিণত হয়। এছাড়া ত মেলাতে তারা এসে মিলন মেলায় আরেকবার সুযোগ পান এবং আনন্দ-বিনোদন উপভোগ করেন। যা বাপ-দাদার পরম্পরায় এ সংস্কৃতি চলে আসছে। তিনি আরো দাবি করেন, এবারের মেলায় প্রায় দেড় লাখের মতো নানান বয়সি মানুষের মিলন ঘটে।
পদ্মপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (অব.) মো. ইউনুছার রহমান বলেন, একটি বছরের জন্য আমরা অপেক্ষা করি। কারণ, মেলা মানেই মানুষের মিলন মেলা। আর এ মেলাতেই দেশীয় জিনিসপত্রের দোকানিদের সমাগম ঘটে। বিকিকিনিও হয় প্রচুর। এছাড়া, অগ্রায়ণ মাসে এলাকার গ্রাম গুলোর প্রতিটি পরিবারে এ মেলা উপলক্ষে স্বজন-প্রীতি ও নবান্ন উৎসবও এর সাথে যোগ হয়ে নতুন ধান কাটা ও নতুন চালের আটার পিঠা-পায়েস, ভাপাপিঠা, ক্ষির, মাংস, বিরিয়ানী রান্না ও খাওয়ার যেন ধূম পড়ে যায়।
1