নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

বাংলাদেশ সোমবার। দুপুর ২:৪৮। ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণে সরকারি আইনি সহায়তা

সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৫ ৩:২৫
Link Copied!

অসচ্ছল পরিবারের সদ্য এসএসসি পাশ করা নাছিমার বিয়ে হয়, একই গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারের বেকার ছেলের সাথে। মেম্বারের পরিবারের কেউই এ বিয়েতে রাজি ছিলো না । একেতো মেয়ের পরিবার দরিদ্র তারপরে তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য এবং প্রতিপত্তিও নেই। শুধু ছেলের অতিআগ্রহের কারণে এ বিয়েতে মেম্বারের পরিবার রাজি হয়। নাছিমা যেমন মেধাবি তেমনি সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী। সাধারণত আমাদের সমাজে যা হয়, এখানেও তাই হলো বছর দুই এর মধ্যে শুরু হলো পারিবারিক অশান্তি। ততোদিনে নাছিমার কোল আলো করে এসেছে এক পুত্র সন্তান। পারিবারিক অশান্তি মিমাংসার নানারকম চেষ্টা হলেও সব ভেস্তে যায়, মেম্বার পরিবারের অসহযোগিতার কারণে। বাধ্য হয়ে আদালতে  মামলা করেন নাছিমা। শুরু হয় আর এক বিড়ন্বনা। অর্থের অভাবে মামলা চালাতে হিমশিম খেতে হয় নাছিমার। আর এদিকে মেম্বার পরিবারের অত্যাচার বেড়ে যায় বহুগুণে। দিনের বেলা সবার সামনে নাছিমার বাবার গাভি নিয়ে যায় মেম্বারের লোকেরা। কোন প্রতিবাদই কাজে আসে না। নাছিমা বাধ্য হয়ে জেলা লিগাল এইড অফিসে যোগাযোগ করেন। জেলা লিগাল এইড অফিসের কর্মকর্তারা সবকিছু শুনে নাছিমাকে আইনি সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং একজন আইনজীবীকে দায়িত্ব দেন।

আমাদের সংবিধানের ২৭, ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে প্রতিটি নাগরিকের জন্য সমান আইনি সুরক্ষা, আইনের চোখে সমতা ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। তবে আর্থসামাজিক বাস্তবতায় দরিদ্র, প্রান্তিক ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষে সব সময় এ সুযোগ পাওয়া সম্ভব হয় না। বিচারিক ব্যয়, মামলা পরিচালনার জটিলতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহানুভূতির অভাবে তারা বিচারহীনতার গহ্বরে হারিয়ে যায়। এই প্রেক্ষাপটে, ২০০০ সালে প্রণীত ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন’ অনুসারে ২০০৯ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (এনএলএএসও) সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করে, যার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে আর্থিকভাবে অক্ষম বিচারপ্রার্থীদের বিনা খরচে আইনজীবী ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করা। আইনটি অধিকতর যুগোপযোগী করে গত ৭ জুলাই, ২০২৫ আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।

লিগ্যাল এইড শুধু বাদিকে আইনগত সহায়তা প্রদান করে না, আসামির পক্ষেকেও আইনগত সহায়তা প্রদান করে থাকে। সাধারণভাবে মনে করা হয়, লিগ্যাল এইড কেবল বাদি বা অভিযোগকারী পক্ষের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু বাস্তবে লিগ্যাল এইড এর ফৌজদারি ও দেওয়ানি দুই ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত বা আসামি পক্ষকে আইনি সহায়তা দেওয়ার সুযোগ রয়েছ। অনেক সময় আর্থিক সমস্যার কারণে দারিদ্র্য আসামি নিজে আইনজীবী রাখতে পারেন না। ফলে দীর্ঘ দিন জামিন মেলে না। লিগ্যাল এইড অফিসের সহায়তায় বিনা খরচে আইনজীবী পেলে সে জামিন পায় বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পায়। কিছু গুরুতর মামলায় বিচারপ্রার্থীর পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকলে, আদালত লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে একজনকে নিয়োগ দেন। মূল কথা হলো দরিদ্র, প্রান্তিক ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষে সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা প্রদান করে থাকে লিগাল এইড।

আরও পড়ুনঃ  জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে রেমিট্যান্স : প্রধান উপদেষ্টা

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এর তথ্য মতে ২০০৯ সাল থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (এনএলএএসওর) এর মাধ্যমে ১১ লাখ ১০ হাজার ৩৬ জন বিচারপ্রার্থী সরকারি খরচে আইনি সহায়তা পেয়েছেন । এ সময়ে ২ লাখ ৩ হাজার ৩২ টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ায় ১ লাখ ১২ হাজার ৯১৩ টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে ২ লাখ ১২ হাজার ৩৫৯ জন প্রতিকার পেয়েছেন। দরিদ্র বিচারপ্রার্থীদের জন্য ১৮৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়েছে। এছাড়া, দেশব্যাপী জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি, থানা লিগ্যাল এইড কমিটি ও শ্রম আদালতগুলোতেও এই সেবা সম্প্রসারিত হয়েছে। আইনগত সহায়তা গ্রহণের জন্য সেবা গ্রহীতাদের জন্য অনলাইন আবেদন পদ্ধতি ও হেল্পলাইন (১৬৪৩০) চালু করা হয়েছে।

পেশাদার আইনগত পরামর্শ ও বিচার ব্যবস্থার প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে অনেক বিচারপ্রার্থী মনে করেন, লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে মামলা করলেই ন্যায়বিচার মানে তাঁদের পক্ষে রায় আসবে। এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। লিগ্যাল এইড কেবল বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে আইনগত সহায়তা ও প্রতিনিধি নিয়োগ নিশ্চিত করে। আদালত প্রমাণ, আইন ও বিচার বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়। এখানে জয়-পরাজয় বা বিচারের রায় পক্ষে বা বিপক্ষে আসার বিষয়টি নির্ভর করে বিজ্ঞ আদালতে উপস্থাপিত তথ্য, সাক্ষ্য ও আইনি যুক্তির ওপর। ‘সরকারি আইনি সহায়তা’ মানে রাষ্ট্রীয় পক্ষপাত নয়।

আরও পড়ুনঃ  ৭৩ পর্যবেক্ষক সংস্থাকে নিবন্ধন দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন

গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ অনুযায়ী, প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে গঠিত হয় গ্রাম আদালত, যা ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দেওয়ানি বা ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত ছোটোখাটো বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারে। বিচার হয় স্থানীয়ভাবে, পাঁচ সদস্যের একটি প্যানেলের মাধ্যমে, যার মধ্যে একজন চেয়ারম্যান এবং উভয় পক্ষের মনোনীত সদস্যরা থাকেন। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য দ্রুত, স্বল্পখরচে ও সহজলভ্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গ্রাম আদালত একটি বিকল্প বিচারব্যবস্থা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এটি প্রথাগত আদালতের ভার কমিয়ে সহায়ক ভূমিকা রাখছে এবং লিগ্যাল এইড বিচারব্যবস্থার একটি কার্যকর অংশ হয়ে উঠছে। ২০২৩ সালে সারাদেশে গ্রাম আদালতের মাধ্যমে কম-বেশি ৭০ হাজার মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। যার মধ্যে ৬৫ শতাংশ মামলায় উভয় পক্ষ আপসে সন্তুষ্ট হয়েছে।

২০০০ সালের ৬ নম্বর আইনে বেশকিছু সংশোধন এনে আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করা হয়েছে। এ অধ্যাদেশে ১৫ক, নতুন এ ধারায় স্পেশাল মেডিয়েটরগণের তালিকা বিষয় বলা হয়েছে। আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশের ২১খ ধারায় ‘কতিপয় ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক মামলাপূর্ব মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ার উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এ ধারার উপধারা (১) আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, মামলাপূর্ব মধ্যস্থতা বিষয়ে এই আইনের বিধানাবলি কার্যকর হবে। (২) এই আইনের তফসিলে বর্ণিত বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে, সংক্ষুব্ধ পক্ষকে আবশ্যিকভাবে উক্ত বিরোধ প্রথমে লিগ্যাল এইড অফিসে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে আবেদন করিতে হবে, এবং মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হইলে বিরোধের কোন পক্ষ প্রয়োজনে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে। ৩ উপ-ধারা (২) অনুসারে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে মামলা দায়েরকারীকে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট আদালতে বাধ্যতামূলকভাবে দাখিল করতে হবে। (৪) উপ-ধারা (২) অনুসারে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে মামলাপূর্ব মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ায় ব্যয়িত সময় তামাদির মেয়াদ গণনার ক্ষেত্রে বাদ যাবে। (৫) এই আইনের অধীন মধ্যস্থতা কার্যক্রম গ্রহণের ক্ষেত্রে চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার, লিগ্যাল এইড অফিসার বা ক্ষেত্রমত, স্পেশাল মেডিয়েটর এর অধিক্ষেত্র সমগ্র জেলা ব্যাপী নির্ধারিত হবে।’

আরও পড়ুনঃ  নয়াদিল্লির ৩ শতাধিক স্কুলে বোমা হামলার হুমকি

এছাড়াও ধারা ২১গ এ বলা হয়েছে, মধ্যস্থতা-চুক্তির কার্যকারিতা। (১) পক্ষগণের সহি/স্বাক্ষর ও মধ্যস্থতাকারীর স্বাক্ষরক্রমে সম্পাদিত এবং চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার কর্তৃক প্রত্যয়িত প্রতিটি মধ্যস্থতা চুক্তি চূড়ান্ত, বলবৎযোগ্য এবং পক্ষগণের উপর বাধ্য করা হবে। (২) উপ-ধারা (১) এর অধীন চুক্তি আদালতের ডিক্রি অথবা ক্ষেত্রমত, চূড়ান্ত আদেশ হিসেবে গণ্য হবে এবং এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতের মাধ্যমে উক্ত ডিক্রি বা আদেশ জারি করা যাবে। এই আইনের অধীন মামলাপূর্ব মধ্যস্থতা কার্যক্রম চলমান অবস্থায় বিশেষ কোন ব্যবস্থা গ্রহণের কারণ উদ্ভূত হইলে লিগ্যাল এইড অফিস প্রয়োজনীয় আদেশ বা নির্দেশ দিতে পারবে এবং উক্ত আদেশ বা নির্দেশ বাস্তবায়নে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবিধিবদ্ধ সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে।’

আইনের ভাষা জটিল। সবার পক্ষে এটা বুঝা সম্ভব না। সচেতনতার অভাবে নাছিমাদের মতো কত মানুষ হয়রানির স্বীকার হচ্ছেন অথচ এই সহায়তাটুকু পেলে কত মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে, তা জানলে আরও অনেকেই এগিয়ে আসবেন। দেশের জনগণকে সচেতন করতে এবং আইনগত সহায়তা নেওয়ার জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন তথ্য অধিদফতর, গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের জেলা তথ্য অফিস, চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তর, বেতার, টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা নিয়মিত প্রচার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। জাতীয় আইনগত সহায়তা কার্যক্রমকে প্রান্তিক জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য, পৌর মেয়র, কাউন্সিলর ও উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। এড়াও জুম্মার নামাজের সময় উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে ইমাম সাহেব এ বিষয়ে সচেতনতামূলক বক্তব্য রাখতে পারেন। ঠিক একইভাবে দেশের মানুষকে সচেতন করতে পারলে কেউ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হবে না। কারো মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে না। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। ঠিক একইভাবে দেশের মানুষকে সচেতন করতে পারলে কেউ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে না, কারও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে না, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। এভাবেই গড়ে উঠবে একটি প্রকৃত কল্যাণ রাষ্ট্র।

লেখক: ইমদাদ ইসলাম
চিফ ফিচার রাইটার, তথ্য অধিদফতর
পিআইডি ফিচার

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময়ের কথা ২৪ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন somoyerkotha24news@gmail.com ঠিকানায়।