অনলাইন ডেস্ক : রাজশাহী জেলার বাগমারা, তানোর, মোহনপুর, দুর্গাপুর ও পুঠিয়া উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জলাবদ্ধতায় ধ্বসে পড়ছে কাঁচা ঘরবাড়ি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ।
বাগমারা প্রতিনিধি জানান, দ্রুতগতিতে বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় শুক্রবার গোবিন্দপাড়া, নরদাশ, বাসুপাড়া, মাড়িয়া, হামিরকুৎসা ও যোগীপাড়া ইউনিয়নের আরও প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রাম নতুনভাবে বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এনিয়ে এ পর্যন্ত একটি পৌরসভাসহ মোট ১১টি ইউনিয়ন বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। উপজেলায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন বন্যা কবলিত এলাকার শতশত পরিবার। ডুবে গেছে বিভিন্ন সড়ক। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় আরও বিভিন্ন গ্রাম নতুন ভাবে বন্যা কবলিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এতে ওই সব গ্রামের লোকজনের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সরজমিনে বন্যা কবলিত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শুক্রবার দুপুরের পর থেকে বাগমারায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি দেখা দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সোনাডাঙ্গা, গোবিন্দপাড়া ও দ্বীপপুর ইউনিয়ন এবং ভবানীগঞ্জ পৌর এলাকার। দ্রুতগতিতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় শুক্রবার বিকেলে ওসব এলাকার বিভিন্ন গ্রাম নতুনভাবে বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। ঘরের জানালা পর্যন্ত পানি উঠায় শতশত পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। বর্তমানে তাদের নেই কোনো থাকার জায়গা। নেই রান্নার পরিবেশ। এ অবস্থায় অর্ধাহারে-অনাহারে আশ্রয়হীন মানুষগুলো মানবেতন জীবন যাপন করছেন। গবাদিপশু নিয়েও পড়েছেন চরম বিপাকে। কাঁচা বাড়িঘর পড়ে যাওয়ায় অনেক পরিবারই এখন উঁচু ভিটায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা বর্তমানে খোলা আকাশের নিচে গিয়ে বসবাস করছেন।
উপজেলা কৃষি অফিসের দেয়া তথ্য মতে, চলতি মওসুমে দু’দফা বন্যায় বাগমারার বন্যা কবলিত বিভিন্ন এলাকায় কৃষি খাতে প্রায় ৩১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সম্পন্ন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৩ হাজার ৭শ ৫৫ হেক্টর ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ২৬ হাজার ১শ দুই হেক্টর জমির রোপা ও আউশ ধান, ৩ হাজার ৯শ ৩৯ হেক্টর জমির সবজি এবং ৩৫ হেক্টর জমির পানবরজ সম্পন্নরুপে ও ১শ ২০ হেক্টর জমির পানবরজ আংশিক রুপে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ফসলেরও সম্পন্ন ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
বাগমারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাজিবুর রহমান বলেন, বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় আরো নতুন নতুন এলাকা বন্যা কবলিত হচ্ছে। কাজেই কৃষি খাতে বন্যায় ক্ষতির পরিমান আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এলাকা পরিদর্শন শেষে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শরিফ আহম্মেদ বলেন, একটি পৌরসভাসহ মোট ১১টি ইউনিয়ন বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এতে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। তাদের মাঝে এ পর্যন্ত মোট ২৫ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ ও আশ্রয়হীন পরিবারগুলোর পাশে থাকার এবং তাদের পুনর্বাসনের জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনেরও আশ্বাস দেন তিনি।
তানোর প্রতিনিধি জানান, তানোরে পানির নিচে তলিয়ে গেছে রোপা আমন ধান, ডুবে যাচ্ছে বিল কুমারী বিল পাড়ের বাড়িঘর। ফলে, অজানা আতঙ্কে দিন কাটছে বিল কুমারী বিলের পাড়সহ নিম্ন এলাকার ঘর-বাড়িতে বসবাসকারী দরিদ্রদের।
তানোর উপজেলার বিল কুমারী বিলের নিম্ন এলাকায় রোপন করা কয়েকশ হেক্টর জমির রোপা আমন ধান পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার ক্ষতির মুখে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। অপরদিকে কুঠিপাড়া, শীতলীপাড়া ও ড্রেন পাড়াসহ নিম্ন এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ঘর-বাড়িতে বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন অর্ধশত পরিবার।
কৃষকরা বলছেন, বিল কুমারী বিলের ধার ঘেষে নিম্ন এলাকায় প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও কৃষকরা রোপা আমান ধান রোপন করেছেন। এবছর টানা বর্ষণ ও বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিলকুমারী বিলের ধারের কয়েকশ হেক্টর জমির রোপা আমন ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, তালন্দ এলাকার লবাতলা ব্রিজের পশ্চিমের মাঠে রোপন করা রোপা আমন ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সেই সাথে বিলকুমারী বিলের ধারের তালন্দ, কামারগাঁ, দমদমা, গোকুল, ধানতৈড়, কান্টা পুকুর, গুবিরপাড়ার পূর্ব দিকের জমি কুঠি পাড়ার নিচের জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
সেই সাথে আমশো, জিওল, ভন্দ্রখন্ড, বুরুজ এলাকাসহ নিম্ন এলাকায় রোপন করা কয়েক হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ফলে এসব এলাকার কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তারা সরকারের সহায়তার দাবি জানিয়েছেন।
দুর্গাপুর প্রতিনিধি জানান, অপরিকল্পিত পুকুর খননের ফলে টানা কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে দুর্গাপুরের ঝাঁলুকা গ্রামে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় শতাধিক পরিবার। যার ফলে মাটির তৈরি কাচাঁবাড়িগুলো ধসে পড়েছে। মাটিরঘর ধসে পড়ে লোকজন আহত হওয়ায় ওই এলাকায় চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাড়িঘরে পানি উঠায় এলাকাবাসী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট জলাবদ্ধতা দুরীকরণ ও নিষ্কাশনে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেছেন।
স্থানীয়রা জানান, এ বছরে এই এলাকায় অসংখ্য কৃষি জমি নষ্ট করে অপরিকল্পিত পুকুর খনন করা হয়েছে। যার কারণে বিভিন্ন ডোবা-নালার ও ব্রীজ কালর্ভাটের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েকদিনের টানা ভারি বর্ষণে প্রবল জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ঝাঁলুকা গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতেই এখন পানি জমে আছে। সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে ঘরের মেঝে ও বারান্দা পর্যন্ত পানি উঠে গেছে। পানির মধ্যে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী নিয়ে বিপাকে পড়েছেন এলাকাবাসী। গত বুধবার রাতে ঝাঁলুকা গ্রামের আহসান, আইনাল হক, তানজিলা বিবি, গোলাপ ডাক্তার এর কাঁচা মাটির বাড়ি ধসে পড়ে। ঘর ধসে পড়ায় কয়েকজন নারী ও পুরুষ আহত হয়েছেন। ফলে কাঁচা মাটির বাড়ি নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে চরম আতষ্ক বিরাজ করছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, অপরিকল্পিত ভাবে পুকুর খননের ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহসীন মৃধা বলেন, জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসণে এলাকাবাসীর একটি আবেদন পেয়েছি। মূলত সেটা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়। এলাকাবাসীর আবেদন করেছেন যাতে ওই এলাকায় দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়। আবেদন পাওয়ার পরপরই সেটা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা সমবায় কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত পূর্বক যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান ইউএনও।
মোহনপুর প্রতিনিধি জানান, মোহনপুরে বৃষ্টির পানিতে ধ্বসে পড়া মাটিরঘর পরিদর্শন শেষে চার পরিবারকে আর্থিক অনুদান দিয়েছেন রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন। শুক্রবার সকালে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে প্রত্যেক পরিবারকে দশ হাজার টাকা করে অনুদান দেন।
জানা গেছে, টানা বৃষ্টির পানিতে মোহনপুর উপজেলার ঘাসিগ্রাম ইউনিয়নের মহিষকুন্ডি গ্রামের চারটি মাটির বাড়ি ধ্বসে পড়ে। এতে মানুষের ক্ষতি না হলেও ঘরের আসবাবপত্রের ক্ষতি হয়। এছাড়াও আরো বেশকিছু মাটির বাড়িঘর ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। মোহনপুরের বন্যা এলাকা এবং মহিষকুন্ডি গ্রামের চারটি ধ্বসে পড়া মাটির বাড়ি পরিদর্শন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন। তিনি ভূক্তভোগি মানুষের খোঁজ-খবর নেন। ওই ধ্বসেপড়া চারটি পরিবারের কর্তাব্যক্তি ফাতেমা বেগম, আনারুল দেওয়ান, মাছুমা বেগম ও রাশেদা বেগম প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দেন তিনি।
এদিকে পুঠিয়া প্রতিনিধি জানান, পুঠিয়ার শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের বারনই নদী পাড়ের বাড়িঘরে ও মাঠে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। এতে মাঠের আমন ধানসহ বিভিন্ন ফসল তলিয়ে গেছে। ভেঙে পড়ছে কাঁচা ঘরবাড়ি। ওই এলাকার মানুষজন আতঙ্কে মধ্যে দিনাতিপাত করছেন বলে জানান, শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন মুকুল।
3