অনলাইন ডেস্ক : ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত প্রতিটি জায়গার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। স্থানও যুদ্ধের স্মৃতি বহন করে। সেগুলো প্রতীক হয়ে রয়েছে যুদ্ধের নৃশংসতা বা সাহসিকতার। অনেক জায়গা এখনো শনাক্ত করা বাকি রয়ে গেছে।
‘একবিংশ শতাব্দীতে গণহত্যা ও গণসহিংসতা বিষয়ে চতুর্থ আন্তর্জাতিক সম্মেলন: ইতিহাস থেকে শিক্ষা’ শিরোনামের ভার্চ্যুয়াল সম্মেলনে উঠে এসেছে এ আবেদন।
সম্মেলনে দেশে দেশে গণহত্যায় ক্ষমতালিপ্সুদের পাশাপাশি কোনো কোনো জাতি-সম্প্রদায়ও দায়ী থাকে বলে উল্লেখ করা হয়।
ভার্চ্যুয়াল সম্মেলনটি আয়োজন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ। তিন দিনব্যাপী সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ছিল আজ সোমবার। দ্বিতীয় দিনে আলোচনা হয় ‘গণহত্যা ও সহিংসতার স্মৃতি’ বিষয়ে। দুটি অধিবেশনে বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় অংশ নেন ছয়জন।
প্রথম অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। এ অধিবেশনে লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চারজন।
বেসরকারি ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক নাজিবা হক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের প্রতিরোধ ও সহিংসতার স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলোর কথা তুলে ধরেন এবং যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বেদনা ও অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস সারা জীবনের জন্য পাল্টে যায়। এ দেশের মানুষের কাছে যুদ্ধের প্রতিটি দিক নিয়ে আবেগ রয়েছে। কারণ, এর সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িত। তিনি প্রশ্ন রাখেন, স্বাধীনতা উদযাপনের সময়ে আমরা সহিংসতা ও প্রতিরোধের স্মৃতিবিজড়িত সেসব জায়গার প্রতি কি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারছি?
নাজিবা হক বলেন, পাকিস্তানি সেনারা নৃশংসতা চালিয়েছে, এমন অনেক জায়গা এখনো চিহ্নিত হয়নি। গণহত্যা ও সহিংসতার সাক্ষী হয়ে আছে একেকটি জায়গা।
যেসব জায়গায় হত্যা, ধর্ষণ ও লাশ পুঁতে রাখা হয়েছিল, সেসব স্থান যুদ্ধের নির্মমতার সাক্ষী হয়ে আছে। স্থানও যে যুদ্ধের স্মৃতি বহন করতে পারে, তা বোঝা যায় সেগুলো দেখলেই। স্থানগুলো পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংসতা বা এ দেশের মানুষের সাহসিকতার প্রতীক হয়ে আছে।
বিজ্ঞাপন
গণহত্যার পেছনের কারণ ও মনস্তাত্ত্বিক ভাবনা তুলে ধরেন যৌথভাবে জুনায়েদ আহমেদ এহসান এবং মগ্ন মহাপাত্র। তাঁরা দুজনই ভারতের নয়াদিল্লির সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের রিসার্চ স্কলার। তাঁরা লিখিত প্রবন্ধে তুলে ধরেন, নাৎসি বাহিনী থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ এবং হালের রোহিঙ্গা গণহত্যায় বেপরোয়া ক্ষমতা ও রাজনৈতিক মতাদর্শ জড়িত। এই গণহত্যা এক রোগ। এর জন্য শুধু একক ব্যক্তি নয়, একটি সম্প্রদায় বা জাতিও দায়ী হয়। এটা স্পষ্ট, কোনো কোনো জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ ইতিমধ্যে তাদের বোধশক্তি হারিয়েছে এবং এ কারণে গণহত্যা তাদের কাছে আর মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে মনে হয় না। তাঁরা বলেন, ‘হতাশার এই সময়ে গণহত্যা বিপদ নয়, প্রকৃত বিপদ হচ্ছে আমরা যা ভাবি তা পুনর্বিবেচনা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা।’
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) প্রভাষক ফাতেমা তুজ জেহারা ১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ওপর আলোকপাত করেন। তিনি জানান, ওই দুর্ভিক্ষে ১০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। শিক্ষাবিদদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ওই দুর্ভিক্ষের পেছনে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের নীতিও দায়ী ছিল। সে ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে, এটা কি শুধু ক্ষুধার কারণে মৃত্যু ছিল, নাকি এটা অনাহারের মাধ্যমে গণহত্যা ছিল?
দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) উপদেষ্টা (অভিবাসন ও মানবতাবিষয়ক নীতি) এবং সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক।
মো. শহীদুল হক বলেন, মিয়ানমারের নাগরিকদের রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব রয়েছে। তারা চায়, রোহিঙ্গারা তাদের দেশ থেকে চলে যাক এবং আর কখনো ফিরে না আসুক।
মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি গণতন্ত্রের সন্তান নন, তিনি ক্ষমতার সন্তান। তাঁর বাবা ক্ষমতায় ছিলেন এবং ক্ষমতাচ্যুত হন। তাই তিনি যেকোনোভাবে ক্ষমতায় ফিরতে চেয়েছেন। রোহিঙ্গা গণহত্যা তাঁর কর্তৃপক্ষের অধীনেই হয়েছে। তিনি আরও বলেন, চীন মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ। রোহিঙ্গা গণহত্যায় ভূরাজনৈতিক কারণও রয়েছে।
এ অধিবেশনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিপল’স ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি অব রাশিয়ার পিএইচডি শিক্ষার্থী শাহনাজ পারভীন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা গণহত্যা হচ্ছে একধরনের রাজনৈতিক পদক্ষেপ। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য একটি জাতিসত্তার বিরুদ্ধে সহিংসতা ঘটানো হয়েছে।
রোহিঙ্গা বিষয়ে পৃথক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির রিসার্চ ডেটা অ্যানালিস্ট মানসুরা এমদাদ।
সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।