স্টাফ রিপোর্টার : তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধাকে গ্রাম অঞ্চলের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নে চালু হলো ‘ইউনিয়ন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’। হড়গ্রাম ও দর্শনপাড়া ইউনিয়নের সাফল্যের পর এবার পারিলা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত এই কেন্দ্র স্থাপন করা হলো। এর মাধ্যমে গ্রামের শিক্ষার্থীরা নামমাত্র খরচে কম্পিউটার এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক আধুনিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পাবে।
সেই লক্ষ্যে শুক্রবার (১ আগস্ট) সকালে পারিলা ইউনিয়ন পরিষদে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন রাজশাহী বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন,“বর্তমান বিশ্বে টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তিকে জানতে হবে। ডিজিটাল দক্ষতা ছাড়া এখন কোনো তরুণই নিজের জায়গা করে নিতে পারবে না। গ্রামের তরুণদের প্রযুক্তি জ্ঞান দিয়ে গড়ে তোলার জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।”
তিনি আরও বলেন,“এই কেন্দ্রের মাধ্যমে স্থানীয় তরুণ-তরুণীরা সরকারি-বেসরকারি চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় ডিজিটাল দক্ষতা অর্জন করবে। এমনকি প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। একে শুধু একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে না দেখে, ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের মূলভিত্তি হিসেবে দেখার সময় এসেছে।”
তিনি আরও আশাবাদ ব্যক্ত করেন,“বিভাগীয় কমিশনারের নির্দেশনায় উপজেলা প্রশাসন এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এটি শুধু পারিলা নয়, ভবিষ্যতে রাজশাহীর প্রতিটি ইউনিয়নে এ ধরনের প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের প্রচেষ্টা থাকবে।”
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পবা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরাফাত আমান আজিজ। তিনি বলেন,“এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আমাদের একটি স্বপ্নের বাস্তব রূপ। ইউনিয়ন পরিষদে বসে শিক্ষার্থীরা এখন প্রযুক্তি শিখতে পারবে—এটা চিন্তা করাও কঠিন ছিল একসময়। আমরা চাই, কেউ পিছিয়ে না থাকুক। তাই এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য এক নতুন সুযোগের দ্বার খুলে দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে পবা উপজেলায় হড়গ্ৰাম ও দর্শনপাড়া ইউনিয়নে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের আগ্ৰহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র শুধু একটি শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা। ভবিষ্যতে এর পরিধি আরও বাড়ানো হবে।”
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের অধীনে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির অর্থায়নে কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কেন্দ্রটিতে একসঙ্গে ২০ জন শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। এটি আধুনিক কম্পিউটার, নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ এবং অন্যান্য মাল্টিমিডিয়া উপকরণে সুসজ্জিত।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা প্রকৌশলী আবু বাশির এবং পারিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ আলী মোর্শেদ, মোনাজাত পরিচালনা করেন- জামায়াতে ইসলামীর পবা থানার আমিন মো. আজম আলী, স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর নেতা হাফেজ নূরুজ্জামান।
এবিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা প্রকৌশলী আবু বাশির বলেন,“প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি গ্ৰামের তরুণ সমাজের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমরা স্থানীয় চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের টিআর কর্মসূচির আওতায় এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এটি একটি সময়োপযোগী ও টেকসই প্রকল্প হবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি।” আমাদের লক্ষ্য ছিল কারিগরি শিক্ষাকে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পৌঁছিয়ে দিয়ে বেকার সমস্যা দূর করা। কেননা বেকার সমস্যা একটা মানবসৃষ্ট আপদ আর আপদ থেকেই দুর্যোগের সৃষ্টি হয়। এখানে প্রশিক্ষক হিসেবে থাকবে একজন দক্ষ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার।
পারিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ আলী মোর্শেদ বলেন,“আমার ইউনিয়নের শিক্ষার্থীরা যেন পিছিয়ে না পড়ে, সেই চিন্তা থেকেই আমরা এই প্রকল্পে সর্বাত্মক সহায়তা করেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। আমাদের ছেলেমেয়েরা যেন শহরের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে, সে পরিবেশ তৈরি করতেই এই পদক্ষেপ।
প্রশিক্ষণ শেষে যারা ভালো করবে, তাদেরকে স্বীকৃতি বা ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার পথও তৈরি করার কথা ভাবছি। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে এই কেন্দ্রকে টিকিয়ে রাখতে এবং সম্প্রসারণে যা যা প্রয়োজন আমরা তা করব।”
ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের যেকোনো শিক্ষার্থী এই কেন্দ্রে ভর্তি হতে পারবে। প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে কম্পিউটার অফিস অ্যাপলিকেশন (এমএস ওয়ার্ড, এমএস এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট), ইমেইল, ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং গ্রাফিক্স ডিজাইনের মতো প্রয়োজনীয় বিষয়।
পারিলা ইউনিয়ন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রর প্রশিক্ষক আব্দুল বারী জানান, হড়গ্রাম ও দর্শনপাড়া ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে পারিলায়ও কোর্সটি সফলভাবে চালানো হবে।
রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী বুলবুল হোসেন নিজের গ্রামেই কম্পিউটার প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়ে উচ্ছ্বসিত। তিনি জানান,“আগে কম্পিউটার শিখতে শহরে যেতে হতো, যাতে সময় ও টাকা দুটোই বেশি লাগতো। এখন নিজের ইউনিয়নেই কম খরচে শেখার সুযোগ পেয়ে আমি খুব খুশি।”
এই ইউনিয়নের রাজশাহী মহিলা কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী উম্মে সালমা বলেন, “একজন ছাত্রী হিসেবে ডিজিটাল যুগে টিকে থাকতে কম্পিউটার জানাটা কতটা জরুরি, তা আমি বুঝি। কিন্তু আমাদের মতো গ্রামের মেয়েদের জন্য শহরে গিয়ে নিয়মিত ক্লাস করে কম্পিউটার শেখাটা বেশ কঠিন। একদিকে কলেজের পড়াশোনা, অন্যদিকে যাতায়াতের সময় ও খরচ—সব মিলিয়ে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।”
তিনি আরও বলেন, “এখন আমাদের ইউনিয়ন পরিষদে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু হওয়ায় সেই চিন্তা দূর হয়েছে। বাড়ির কাছেই এমন আধুনিক পরিবেশে কম্পিউটার শেখার সুযোগ পেয়ে আমি আনন্দিত।”
অভিভাবক জামাল হোসেন বলেন,“আমার মেয়েটা এবার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। এত কম খরচে সে কম্পিউটার শিখবে—এটা ভাবতেই পারিনি।”
এই উদ্যোগ শুধু প্রযুক্তিগত জ্ঞান নয়, বরং গ্রামের শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস, কর্মদক্ষতা ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার পথ তৈরি করে দেবে—এমনটাই মনে করছেন এলাকাবাসী। রাজশাহী অঞ্চলের অন্যান্য ইউনিয়নেও এই ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের দাবি জোরালো হচ্ছে। গ্রামীণ প্রযুক্তি বিকাশের এই ধারা চলমান থাকলে খুব শিগগিরই গ্রাম-শহরের পার্থক্য দূর হয়ে এক ‘ নতুন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে।