অনলাইন ডেস্ক : তিনি রাজশাহীকে সবসময় বুকে ধারণ করতেন। তার শেষ ইচ্ছে ছিল রাজশাহীর মাটিতেই শায়িত থাকবেন। কিংবদন্তি শিল্পী এন্ড্রু কিশোর জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেও একদিনের জন্য রাজশাহীকে ভুলেননি। জন্ম, শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের শত স্মৃতি বুকে ধারণ করেই গত ৬ জুলাই সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে ৬৫ বছর বয়সে লক্ষ কোটি ভক্তকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে পরলোকে চলে যান এন্ড্রু কিশোর।
শিল্পীর স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী অধ্যাপক দীপকেন্দ্র নাথ দাস বলছিলেন, এন্ড্রু কিশোর রাজশাহীর কথা, রাজশাহীর বন্ধুদের কথা, রাজশাহীর সব শ্রেণী পেশার মানুষের সঙ্গে মিশতেন। সময় কাটাতেন। তুমুল ব্যস্ততার সময়েও ছুটে আসতেন রাজশাহীতে। সবাইকে ডেকে নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠতেন। রাজশাহীতেও ব্যক্তি এন্ড্রু কিশোর ছিলেন সবার ভালোবাসার মানুষ।
শেষবার রাজশাহীতে ফিরে নিজেই বলেছিলেন আমি রাজশাহীর মাটি ও মানুষের মাঝে থাকতে চাই। আমার শেষদিনও যেন রাজশাহীর সুর্যালোকে আলোকিত থাকে সেটি আমার শেষ ইচ্ছে। অধ্যাপক দীপক দাস আরও বলেন, অত্যন্ত সরলপ্রাণ মানুষ এন্ড্রু কিশোরকে রাজশাহীর মানুষ আজীবন মনে রাখবে।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশক থেকে সংগীতের বলয়ে যার জাদুকরি কণ্ঠ দর্শক-শ্রোতাকে মাতিয়ে রাখে, যার অব্যাহত ধারা একবিংশতেও সমান বহমান ছিল। সেই শৈল্পিক সুরেলা কণ্ঠ আজ চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেছে। প্রায় তিন প্রজন্মের জনপ্রিয় এই কিংবদন্তি শিল্পীর কী অভিমান ছিল, তা কারো জানা নেই! তবে তিনি হয়তো তার অগণিত শ্রোতা ও ভক্ত অনুরাগীর কাছে সে কষ্ট ইচ্ছে করেই জানাননি। এমনকি ক্যান্সার আক্রান্ত হাওয়া পর তার রুগ্ন শরীরটাকেও কারও সামনে প্রকাশ করতে চাননি। রাজশাহী আসার পর সবাইকে তার সঙ্গে দেখা না করতে অনুরোধ জানান।
মৃত্যুর ঠিক একদিন আগে নিজের জন্য কফিন তৈরির কথাও বলেছিলেন সহধর্মীনিকে। তিনি এও বলে গেছেন, তার মৃত্যুর পর কী কী করণীয় হবে। তার মরদেহ কোথায় নেওয়া হবে, কোথায় হবে না। এতটাই মানসিক শক্তি ছিল যে, তিনি কোথায় চিরনিদ্রায় থাকতে চান তাও বলে গেছেন। এমন বড় মাপের শিল্পীর চিরপ্রস্থান মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে সবার। বেঁচে থাকতে যার কণ্ঠ সারা বাংলায় আলোড়ন তুলেছে, সেই বলিষ্ঠ নান্দনিক সুরেলা ছোঁয়া আর পাওয়া যাবে না।
প্রাণঘাতী ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে নয় মাস সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন এন্ড্রু কিশোর। উপমহাদেশের এই গুণী শিল্পীর শেষ ইচ্ছাতেই তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। আবাসভূমি রাজশাহীতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মাটি আর মানুষের অবিস্মরণীয় এই সন্ধিই হয়তো তার কণ্ঠকে শৈল্পিক সাবলীলতায় অনুপম করে তুলেছিল। একজন এন্ড্রু কিশোর হয়ে উঠেছিলেন ‘প্লেব্যাক সম্রাট’।
এরপরও এন্ড্রু কিশোর সময় পেলেই রাজশাহীতে ছুটে আসতেন। বিশেষ করে ২০১১ সাল থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর একবার যেতেনই। ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর শিষ্য ছিলেন তিনি। তাই রাজশাহীতে ‘ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু স্মৃতি সংসদ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন এন্ড্রু। নিজেই ছিলেন সেই সংগঠনের সভাপতি। তার উদ্যোগেই নিয়মিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো সেখানে। যতই ব্যস্ততা থাক আর যেখানেই থাকুন না কেন সেই অনুষ্ঠানে হাজির হতে তিনি রাজশাহীতে ছুটে যেতেনই। ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর সুরবানী সংগীত বিদ্যালয়ের ছাত্র কখনও ওস্তাদকে ভুলে যাননি।
সে সময়ে একই ওস্তাদের শিষ্য ছিলেন- সুরকার ও সংগীত পরিচালক ইথুন বাবু, রিজিয়া পারভীন, এম এ খালেক, ইফফাত আরা নার্গিস, রফিকুল আলম ও আরও অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। মৃত্যুর আগে বলা যায় একরকম ওসিয়ত করেই তিনি এই সংগঠনের ভার দিয়ে গেছেন বাল্যবন্ধু রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. দ্বীপকেন্দ্রনাথ দাসের ওপরে। এখন ‘ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু স্মৃতি সংসদ’র পরবর্তী সভাপতি তিনিই।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কণ্ঠশিল্পী মঈনুল ইসলাম জানান, সব কিছুই আগের মত আছে। কেবল আমাদের এন্ড্রু কিশোর নেই! তার জন্য সবকিছুই যেন কাঁদছে! মৃত্যুর আগে এন্ড্রু তার সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করে গেছেন। এন্ড্রু কিশোরের বাল্যবন্ধু রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. দ্বীপকেন্দ্রনাথ দাস এখন ‘ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু স্মৃতি সংসদ’র পরবর্তী সভাপতি।
মঈনুল ইসলাম আরও জানান, রাজশাহীতে এ সংগঠন তৈরির পর ত্রৈমাসিক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করা হতো। পরিকল্পনা অনুযায়ী একেকটি অনুষ্ঠানে রাজশাহীর প্রত্যন্ত এলাকার একটি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। প্রতিটি অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব উপস্থিত থাকতেন। গান শুরুর আগে ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর জীবনের ওপর আলোচনা হতো। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সংগীতের প্রতিভা অন্বেষণের জন্য এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। আর যেখানেই থাকতেন আর যত ব্যস্তই থাকতেন এতে যোগ দিতে ছুটে আসতেন এন্ড্রু কিশোর। সংগীতের মাধ্যমে মানুষ গড়ার ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর কাজটি ধরে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি।
বন্ধুর এমন চলে যাওয়ায় বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন ড. দ্বীপকেন্দ্রনাথ দাস। তিনি বলেন, ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয়ের এর ছাত্র ছিলাম আমরা দুজনই। সেখান থেকেই আমাদের পথচলা। তার সঙ্গে ‘তুই-তুকারি’ সম্পর্কই ছিল। কিন্তু যখন আমি শিক্ষকতায় আসি, তখন কিন্তু কিছুদিন পর সে আর আমাকে নাম ধরে ডাকতো না। বলতো, স্যার কেমন আছো? তখন ‘তুমি’ হয়ে গেলাম। পরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কিরে, তুই আমাদের সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি করে দিলি? সে বললো, ‘না, দূরত্ব নয়। তুমি একজন প্রফেসর মানুষ, তোমার তো সমাজে একটা মূল্যায়ন আছে। আমরা যদি তোমাকে সম্মান না দেই তাহলে অন্যরা কীভাবে সম্মান দেবে?’ এই যে একটা ব্যাপার, এই জিনিসটা আমার এখন খুব মনে পড়ছে!
এন্ড্রু কিশোর সঙ্গীত জগতে এতো উচ্চতায় উঠেও নিরহংকারী ছিলেন উল্লেখ করে ড. দ্বীপকেন্দ্র নাথ বলেন, সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, আমরা অনেক সময় দেখি, কেউ একজন বড় শিল্পী হয়ে গেলে তার মধ্যে একটা ‘অহংবোধ’ চলে আসে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে চায় না। কিন্তু এই দিকটা আমার বন্ধু কিশোরের মধ্যে ছিল না। সে আমার সঙ্গে ক্যাম্পাসে গিয়ে রিকশাওয়ালার সাথেও ছবি তুলেছে। মানুষের প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধাবোধ ছিল। জীবনের অন্তিম সময়েও বলে গেছে ‘ভালো থেকো, সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো।’ এন্ড্রুর যে শূন্যতা সৃষ্টি হলো, তা আর পূরণ হওয়ার নয়।
রাজশাহীতে জন্মেও নিজের পৈতৃক কোনো বাড়িঘর ছিল না শিল্পীর। মহিষবাথানের মাতৃসম বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের সেই বাসাটাই ছিল শিল্পীর সুখ-দুঃখের শেষ গন্তব্য। ঢাকা থেকে ফিরেও এই বাসাতেই থাকতেন। রাজশাহীর পদ্মা আবাসিক এলাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট নিলেও সেই বাসাতে থাকার সুযোগ হয়নি এন্ড্রু কিশোরের। গত বছর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার খরচ জোগাতে অ্যাপার্টমেন্টটি জরুরিভাবে বিক্রি করে দেন। সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে ঢাকার বাসায় কয়েকদিন থাকলেও রাজশাহীতে চলে আসেন এন্ড্রু কিশোর। বোনের বাসাতেই তার ঠাঁই হয় যেখানে কেটেছে তার শৈশব কৈশোর। ছেলে মেয়ে নিয়ে এসেও তিনি রাজশাহীর এই বাসাতেই উঠতেন।
শিল্পীর বোন ডা. শিখা বিশ্বাস জানান, কিশোরকে তিনি মায়ের স্নেহ মায়া মমতা ভালোবাসায় বড় করেছেন। এত বছর বয়সেও এন্ড্রু ছিল তার কাছে সেই অবলা সন্তানের মতোই। খাবার বায়না ধরতেন, শিশুসূলভ আচরণ করতেন। গান করতেন। শিল্পীর গভীর স্মৃতি মমতা এখন শুধুই তাকে কাঁদাচ্ছে।
মৃত্যুর পর উপমহাদেশের কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের মরদেহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে। তার ছেলে সপ্তক ৮ জুলাই অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছেন। একই দেশ থেকে মেয়ে সংজ্ঞা আসবেন ১৩ জুলাই। এরপর ১৫ জুলাই এন্ড্রু কিশোরের শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।