নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

ঢাকা সোমবার। সন্ধ্যা ৭:৫১। ২১ জুলাই, ২০২৫।

অটিজম অভিশাপ নয়, প্রয়োজন সহমর্মিতার হাত

জুলাই ২১, ২০২৫ ২:৪০
Link Copied!

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার সরদর ইউনিয়নের তরুণ আব্দুল পারিশ। ছোটবেলা থেকেই তার আচরণে বিভিন্ন রকম অস্বাভাবিকতা প্রকাশ পেতে থাকে। এ অবস্থাতেই কেটে যায় বছরের পর বছর। এই দীর্ঘসময় আব্দুল পারিশকে কোন ধরণের চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। তার পরিবার প্রথমদিকে বুঝতেই পারেনি পারিশের সমস্যা মূলত কি। পরবর্তীতে তারা পাবনার মানসিক হাসপাতালে গেলেও সেখান থেকে তাকে ফেরত পাঠানো হয়। পারিশের ভাই অহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, “স্বাভাবিক মানুষের যে চলাফেরা, মানুষকে সঙ্গ দেয়া, পারিশ এমন কিছু করতো না। সবসময় একা একা থাকতো। খাবার খেতো না। মায়ের সাথেও খারাপ ব্যবহার করতো।” আব্দুল পারিশের বাড়ি থেকে অল্প দূরত্বে থাকেন আরেক যুবক রঞ্জন চন্দ্রের পরিবার। সেখানে গিয়ে দেখা গেল রঞ্জনের পা শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা। পাঁচ বছর ধরে একই অবস্থায় রাখা হয়েছে তাকে। দুই-তিনমাস পর পর তার পায়ের শিকল খুলে দেয়া হয় বলে জানান তার বাবা রুপন চন্দ্র। কিন্তু শেকল দেয়ার কারণ কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, তার ছেলে আশে-পাশের বাড়িঘরে যায়, লোকজনকে বিরক্ত করে। পরে সবার চাপে তিনি পায়ে শিকল দিয়ে রেখেছেন। ছেলেকে স্কুলেও ভর্তি করলেও অন্য ছাত্ররা অভিযোগ দেয়ায় ফিরিয়ে আনতে হয়। রঞ্জনকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে জানতে পারেন তার ছেলে “অটিজম”-এ আক্রান্ত। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এখনো অনেক পরিবারই আছে যারা অটিজম সঠিকভাবে বুঝতে বা শনাক্ত করতে পারেন না। ফলে সেসব পরিবারের জন্ম নেয়া বিশেষ শিশুটিকে বছরের পর বছর সমাজের সবার কাছ থেকে আলাদা করে রাখা হয়। সামাজিক কোনও আচার অনুষ্ঠানে তাদের অংশগ্রহণ তো দূরের কথা অনেক ক্ষেত্রে সমাজের মানুষেরাও তাদের দূরে সরিয়ে রাখে এক ধরনের কুসংস্কার থেকে।
চিকিৎসকরা বলছেন, অটিজম কোনও রোগ নয়। এটি মস্তিষ্কের বিকাশ জনিত এক ধরনের সমস্যা যার কারণে একটি শিশু সামাজিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরি করতে পারেনা। অটিজমে আক্রান্ত শিশুর ডিএনএ কপি নম্বর ভ্যারিয়েন্ট নামক ত্রুটি বহন করে। কিন্তু দ্রুত শনাক্ত করতে পারলে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারলে এই শিশুরাও অন্যান্য শিশুদের মত উন্নতি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের অটিজম সোসাইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক শতাংশ অটিজম সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বা অটিজম আক্রান্ত মানুষ রয়েছেন। রাজধানীর বিএসএমএমইউ হাসপাতালটির শিশু নিউরোলজি বিভাগে প্রতিদিন দেড়শ থেকে দুইশ অটিজম শিশু চিকিৎসা নিতে আসে। সে হিসেবে নতুন-পুরোনো মিলিয়ে প্রতি মাসে ৩০ হাজারেরও বেশি অটিজমে আক্রান্ত শিশু এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। এ ছাড়া সারাদেশের ৩৪টি মেডিকেল হাসপাতালে অটিজমে আক্রান্তদের চিকিৎসায় একটি করে শিশু বিকাশ-কেন্দ্র রয়েছে। এর বাইরেও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। বিএসএমএমইউ এর ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ১ দশমিক ৭ জন অটিজম আক্রান্ত। গ্রামের চেয়ে শহরে বাড়ছে অটিজম শিশু। গ্রামে প্রতি ১০ হাজারে ১৪ জন। অর্থাৎ প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৪ জন। শহর এলাকায় প্রতি ১০ হাজারে ২৫ শিশু, যা প্রতি হাজারে ২ দশমিক ৫ জন। তবে কন্যাশিশুর চেয়ে অটিজম আক্রান্ত ছেলেশিশুর সংখ্যা আড়াইগুণ বেশি। বর্তমানে দেশে ১৬-৩০ মাস বয়সের শিশুদের মধ্যে অটিজমের হার প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জন। আনুপাতিক হারে তা প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৭।
অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের সামাজিক যোগাযোগ ও দক্ষতার ব্যবহারজনিত সীমাবদ্ধতা এবং পড়াশুনার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যার লক্ষণগুলো শিশুর বয়স তিন বছর হওয়ার পূর্বেই দেখা দিতে শুরু করে। বাবা-মা অনেক ক্ষেত্রে বিষয়গুলো বুঝতেও পারেন না অথবা ধরে নেন এই সমস্যাগুলো শিশুটি বড় হওয়ার সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু অটিজমের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো এমনিতে ঠিক হয় না, বরং বড় হওয়ার সাথে সাথে লক্ষণগুলো বেড়ে যায়। সুতরাং শিশুর মধ্যে অটিজমের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা উচিত। সামাজিক যোগাযোগের বিবেচনায় অটিজম আক্রান্ত শিশুদের কথা বলা এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। তারা অন্যের সাথে আন্তব্যাক্তিক যোগাযোগে সীমাবদ্ধতায় ভোগে বা করতে পারে না। কারণ তারা সাবলিলভাবে ভাষা প্রকাশে অক্ষম। অনেক ক্ষেত্রে শব্দ এবং বাক্য গঠন করতে বা বলতে পারে না। কোন কোন সময় আগে যে শব্দগুলো বলত হঠাৎ করে তা বলা কমে যায় বা সেগুলোও আর বলে না। সামাজিক শুভেচ্ছা বিনিময় করতে পারে না, আবার ছোট করে কথা বলে যেমন, “হাই-বাই” অথবা ছোট আলাপ “আপনি কেমন আছেন?” প্রশ্নের জবাব না দেওয়া, অন্যরা কি বলছে তার প্রতি কোন প্রতিক্রিয়া না দেখানোও অটিজমে আক্রান্তদের মধ্যে দৃশ্যমান। তবে এদের মাঝে সামগ্রিকভাবে সামাজিক অভিবাদনের অভাব দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে অন্যের কথার পুনরাবৃত্তি করে বা অন্যরা যা বলে সেই কথাই হুবহু বলে। পুনরাবৃত্তিমূলক কথা বা ভোকাল স্টেরিওটাইপি পুনরাবৃত্তিপূর্ণ ভোকাল শব্দ বা পুনরাবৃত্তি বাক্য বা কথোপকথন বার বার বলে। যেমন একই শব্দ বা বাক্য বার বার বলা, একই গান বা ছড়া বার বার বলা, অন্যের কথা বার বার বলা ইত্যাদি।
অটিস্টিক শিশুর পড়াশুনা বা একাডেমিক কাজের সময় আচরণগত বিষয়গুলি পর্যবেক্ষণ এবং শ্রেণিকক্ষে অধ্যয়নে সমস্যা দেখা যায়। তারা লেখা ও পড়ার অসুবিধা, বর্ণমালা, সংখ্যা, শব্দ, গাণিতিক গণনা শেখা এবং সামগ্রিকভাবে বিদ্যালযের ক্রিয়াকলাপে সমস্যায় পড়ে। এর মধ্যে ক্লাসে অংশ না নেওয়া, হাত না উঠানো বা শিক্ষকদের প্রশ্নের জবাব না দেওয়া, চুপচাপ ক্লাসে বসে থাকা, ক্লাসে কী বলা হচ্ছে তা না শোনার প্রবণতা উল্লেখযোগ্য। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল থাকে। তারা কী শিখেছে তা দ্রুত ভুলে যায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে তথ্য মনে রাখতে পারে না। অনেক সময় আগে যা শিখেছে তা হঠাৎ করে ভুলে যায় বা আগের শেখা বিষয় গুলো বলতে পারে না। তবে অনেকের ক্ষেত্রে তাদের কোন একটি বিষয়ে দক্ষতা ভাল থাকে।
তাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনে স্বনির্ভর কার্যক্রম যেমন গোসল করা, খাওয়া, জামা কাপড় পড়া ইত্যাদির ক্রিয়াকলাপ অন্তর্ভুক্ত। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের এই ধরনের কার্যকলাপে সহায়তা এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। এসকল কাজের কেবলমাত্র কয়েকটি পদক্ষেপ সম্পাদন করতে পারে তবে পুরো কাজটি নয় উদাহরণস্বরূপ, হাত ধোওয়া, গোসল করা, কাপড় পরা, টয়লেট করা ইত্যাদির মতো দীর্ঘ কোনও কাজ সম্পন্ন করতে পারে না। এগুলির কয়েকটি পদক্ষেপ নিজে করতে পারে তবে পুরো কাজটি শেষ করতে পারে না। যেমন, তারা স্বতন্ত্রভাবে গোসল করবে তবে পুরো শরীর পরিষ্কার করার জন্য সাবান ব্যবহার করবে না। প্রতিদিনের ক্রিয়াকলাপগুলি করার জন্য তাদের বার বার মনে করিয়ে দিতে হয়। শিশুদের প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ করা, জুতা পরা ইত্যাদিসহ সমস্ত ক্রিয়াকলাপের জন্য নিয়মিত তাকে স্মরণ করে দিতে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক বা অত্যধিক আচরণ যেমন- অন্যকে আঘাত করা, নিজেকে আঘাত করা, দেওয়ালে মাথা ঠুকা, নিজের চুল তেলে ছিঁড়া, নিজের হাতে কামড় দেওয়া, অন্যকে থুতু দেওয়ার মতো আচরণ করতে পারে তারা। তারা নিজেরা একা থাকতে পছন্দ করে।
গ্রামের দিকে অনেকেই জানেননা অটিজম কি, সেটা যে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নয় সেটা বুঝে উঠতে পারেনি। অনেকে এখনো বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের পাগল মনে করে, আবার অনেকে মনে করে যে, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, মানে বোকা। কিন্তু এসব ধারণার কোনটাই ঠিক না।।বহুদিনের প্রাচীন ধারণা মোতাবেক বেশিরভাগ পরিবারই তাদের অটিজম আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা বা শিক্ষার বাইরে রাখছে। তবে সে অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এখন অনেক বাবা-মা চিকিৎসার জন্য ছেলেমেয়েদের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসেন। দেশের মেডিকেল কলেজগুলোর ১৬টিতে শিশু-বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে যেগুলোতে অটিজম শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। তবে, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন শহর বা গ্রাম পর্যায়ে রয়েছে কেবল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবন্ধী সাহায্য ও সেবাকেন্দ্র। ফলে অটিজম বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগগুলো শহরে ঘরে ঘরে যতটা পৌঁছে যাচ্ছে, শহরের বাইরের পরিবারগুলোর কাছে তা অনেকটাই দূরবর্তী সুযোগ-সুবিধার মাঝে আটকে আছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে শৈশবে ব্যবস্থা নেওয়া গেলে অটিজম নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশু প্রাপ্তবয়সে অনেকটাই স্বাভাবিক হতে পারে। শৈশবে ব্যবস্থা নেওয়া বলতে বোঝায় জন্মের ১৮ মাস থেকে ৩৬ মাস বয়সের মধ্যে অটিজম শনাক্তকরণ ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে শিক্ষা পরিকল্পনার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শিশুকে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া। এ ধরনের শিশুর প্রধান চিকিৎসা স্পিচ থেরাপি, নিওরোবিহেভিওরাল থেরাপি। অতিরিক্ত আচরণগত সমস্যা, ঘুমের সমস্যা ও শারীরিক সমস্যার জন্য মেডিকেল চিকিৎসা এবং বিশেষ স্কুলে শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে।
অটিজমে আক্রান্ত শিশু ও বয়স্কদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়তার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালে ২ এপ্রিলকে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর পর থেকে প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হচ্ছে। আমাদের দেশেও প্রতি বছর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করে আসছে।
আমাদের দেশে অটিজম সম্পর্কে সাধারণ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই নেতিবাচক। অনেকে এ রোগকে সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ বলে মনে করেন। ফলে অটিজম আক্রান্তদের জন্য সমাজে বসবাস করাটা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। রোগের প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশ পেলে অর্থাৎ শিশুর শৈশবকালেই ব্যবস্থা নিলে অটিস্টিক শিশুদের অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসা সম্ভব। আর এজন্য চাই সবার সচেতনতা। আমরা সচেতন হলেই অটিস্টিক মানুষের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। এই মানুষগুলো পাবে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ।

আরও পড়ুনঃ  বিসিএস পরীক্ষা উপলক্ষ্যে আরএমপির গণবিজ্ঞপ্তি

লেখক: ম. জাভেদ ইকবাল
সিনিয়র উপপ্রধান তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর, ঢাকা।
(পিআইডি ফিচার)

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময়ের কথা ২৪ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন somoyerkotha24news@gmail.com ঠিকানায়।