নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

ঢাকা শনিবার। সন্ধ্যা ৬:৫১। ২৪ মে, ২০২৫।

আমে চাঙা রাজশাহীর গ্রামীণ অর্থনীতি

মে ২৪, ২০২৫ ২:৫১ অপরাহ্ণ
Link Copied!

স্টাফ রিপোর্টার : দেশে প্রতিবছরই বাড়ছে আমের বাগান ও উৎপাদনের পরিমাণ। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে কয়েক বছর ধরে রপ্তানিও হচ্ছে। গত দুই দশকে রাজশাহী অঞ্চলের চার জেলায় আমবাগানের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে। আম হয়ে উঠেছে লাভজনক বাণিজ্যিক কৃষিপণ্য। উদ্ভাবিত উন্নত জাত ছাড়াও অনুকূল মাটি ও জলবায়ুর কারণে রাজশাহী অঞ্চলের জেলাগুলোয় আমবাগান বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আমকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে অঞ্চলজুড়ে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ ড. আজিজুর রহমানের মতে, সারা বছরই আমবাগানকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড চলমান থাকলেও বছরের এ মৌসুম, বিশেষ করে মে থেকে আগস্ট-চার মাস রাজশাহী অঞ্চলে আমকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য বিরাজ করে। চলতি মৌসুমে রাজশাহীসহ অঞ্চলের চার জেলায় ১২ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন আম ফলনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর বাণিজ্য মূল্য প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।

গাছ থেকে আম নামানো, পরিবহণ, মজুতকরণ, চালান, প্যাকেজিংসহ আমকেন্দ্রিক কর্মযজ্ঞে ৩ লক্ষাধিক মানুষের মৌসুমি কর্মসংস্থান হয়। সবমিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার আমকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। ইতোমধ্যে রপ্তানি বাণিজ্যে যুক্ত হচ্ছে আম। বাংলাদেশের আম এখন বিদেশের বাজারেও পৌঁছে যাচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি তথ্য বিভাগের সূত্রমতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বৈরী আবহাওয়া না থাকায় এবার আমের ফলন বেড়ে ২৮ লাখ মেট্রিক টনে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

কৃষি বিভাগের মতে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লক্ষণীয়ভাবে আমবাগান বাড়লেও এখনো উৎপাদনে আধিপত্য ধরে রেখেছে রাজশাহী অঞ্চলের জেলাগুলো। দেশের মোট আম উৎপাদনের অর্ধেকই হয় রাজশাহীসহ আশপাশের চার জেলায়। এর মধ্যে সর্বাধিক ৪ লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে। আমের রাজা ফজলি আমের সিংহভাগই এখানে উৎপাদিত হয়। এ জেলায় শত বছরের প্রাচীন ফজলি আমের বাগান রয়েছে। ফজলি আম আকারে বড় এবং অধিক ফলন হওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ এখনো শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে।

আরও পড়ুনঃ  বাগমারায় নারীর বিরুদ্ধে যুবকের পুরুষাঙ্গ কাটার অভিযোগ

চলতি মৌসুমে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে নওগাঁ জেলায়। এরপর রাজশাহী জেলায় ২ লাখ ৮৫ হাজার ৮৪৩ মেট্রিক টন ফলনের আশা আছে। নাটোরে ১ লাখ ৩৪ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ম্যাঙ্গো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবীব বলেন, আম উৎপাদনে দেশের শীর্ষ জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৯৭ জন বাণিজ্যিক চাষি রয়েছেন। মান্ধাতা আমলের ব্যবস্থা থেকে বাগান ব্যবস্থাপনা আধুনিক হয়ে ওঠায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের গুণগতমানের পাশাপাশি বেড়েছে ফলনও।

তিনি আরও বলেন, যুগ বদলের ফলে এখন আমের বাণিজ্যিক মূল্য বেড়েছে। রপ্তানি বাজার অনুসন্ধানের পাশাপাশি আমে নির্ভর কৃষিশিল্প গড়ে ওঠার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বিপুল এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব হলে আমই রাজশাহী অঞ্চলের গ্রামীণ ও কৃষি অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইতোমধ্যে রাজশাহীতে দেশি জাতের নামে পরিচিত গুটি ও গোপালভোগ মোকামে আসতে শুরু করেছে। চার জেলার মধ্যে রাজশাহীর আম আগে পাকে। এরপর চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরের আম বাজারে ওঠে পর্যায়ক্রমে। নওগাঁর আম্রপালি মোকামে আসে জুনের মাঝামাঝিতে। রাজশাহী অঞ্চলে আম কেনাবেচার বৃহৎ মোকাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট বাজার। রাজশাহীর বানেশ্বর, বাঘা, আড়ানী, চারঘাট ও নাটোরের লালপুর মোকামে ইতোমধ্যে আম আসা শুরু হয়েছে। আমকে কেন্দ্র করে জমে উঠতে শুরু করেছে মোকামগুলো। আমচাষি, বাগান ব্যবসায়ী, আড়তদার, চালানি ব্যাপারী, শ্রমিক, পরিবহণ মালিক ও বহন শ্রমিক এবং ঝুড়ি তৈরির কর্মযজ্ঞে মুখর হয়ে উঠেছে এসব মোকাম।

কানসাট আম মোকামের চালানি ব্যাপারী শহিদুল ইসলাম বলেন, আমই আমাদের জীবন-জীবিকার অন্যতম চালিকাশক্তি। এখানে মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত আম বাণিজ্য জমজমাট থাকবে। এখন গুটি ও লক্ষণা আম বাজারে এসেছে। এরপর ক্ষীরসাপাতি, ন্যাংড়া, ফজলি, বারি-৪, গৌড়মতি, আম্রপালি এবং শেষে আশ্বিনা জাতের আম বাজারে উঠবে। আমচাষি থেকে শ্রমিক, প্রচলিত পরিবহণ চালক থেকে ভ্যানচালক, ঝুড়ির কারিগর, কুরিয়ার সার্ভিস, ব্যাংক-বিমা, হোটেল-রেস্তোরাঁর বাণিজ্যে এলাকার অর্থনীতি চাঙা হয়ে উঠবে হাটবাজার ও বড় মোকামগুলো।

আরও পড়ুনঃ  আলটিমেটাম দিয়ে আন্দোলন স্থগিত করলেন ইশরাক

রাজশাহীর বানেশ্বর মোকামের ব্যাপারী মোজাম্মেল হোসেন বলেন, আম হচ্ছে আমাদের টাকার ফল। বাগান মালিকরা যেমন এক মৌসুমে আম বিক্রি করে কয়েক লাখ টাকা ঘরে তোলেন; একইভাবে একজন আমপাড়া শ্রমিক, রিকশা-ভ্যানচালক, ঝুড়ির কারিগর এই কয়েক মাসে ছয় মাসের জীবিকা নির্বাহের মতো টাকা আয় করেন। এ মৌসুমে অনেকেই অনলাইনে আমের ব্যবসা করে ভালো লাভের মুখ দেখেন। আমের কারণে আমাদের সারা বছরের সংসার খরচ উঠে আসে। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ নির্বাহ হয়। বানেশ্বর বাজারের আমের চালানি ব্যাপারী আবু সাঈদ জানান, এই একটা মৌসুমের কয়েক মাসের জন্য তিনি বাজারের ওপর একটি বড় আড়ত করেছেন। এই তিন মাসে তিনি কয়েক লাখ টাকার কমিশন ব্যবসা করবেন। আবু সাঈদ চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট ও কিশোরগঞ্জে কমিশনে আম চালান করেন। তার আড়তে আম পরিবহণ প্যাকিং, চালান, ঝুড়ি তৈরি ইত্যাদি কাজে ২০ জন শ্রমিক কাজ করেন। এসব কাজ করে তারা প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা আয় করেন।

চাষি ও কৃষি বিভাগের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, এ অঞ্চলের নওগাঁ জেলায় আমকেন্দ্রিক বাণিজ্য জেলার অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। নওগাঁর সাপাহার এখন আম কেনাবেচা এবং চালানের বড় মোকামে পরিণত হয়েছে। ধানপ্রধান নওগাঁ জেলার সাপাহার ও পোরশাসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় হাইব্রিড জাতের আম্রপালি আমের ব্যাপক ফলন হয়েছে গত কয়েক বছরে। এবারও এই এলাকায় আমের বাম্পার ফলনের আশা রয়েছে।

আমকে কেন্দ্র করে সাপাহার এখন গ্রামীণ বাণিজ্যিককেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ আম বেচাকেনা, আমদানি, চালান নিয়ে কয়েক মাস ব্যস্ত সময় পার করে। সাপাহার থেকে প্রতিদিন তিন শতাধিক ট্রাক আম চালান হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। আম বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে সাপাহারে স্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা।

আরও পড়ুনঃ  বলিউড ছাড়ছেন আথিয়া শেঠি

একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাপাহার শাখার কর্মকর্তা সাবিরুল ইসলাম বলেন, নওগাঁর আম জুনের মাঝামাঝি বাজারে আসে। তখন ব্যাংকগুলোয় বিপুল লেনদেন হয় প্রতিদিন। এবারও তারা আমকেন্দ্রিক লেনদেনের আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, ধান-আলুর পর কৃষি অর্থনীতিতে আমের অবদান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাজশাহী অঞ্চলে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ আমকেন্দ্রিক কৃষিশিল্প গড়ে তোলার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। মৌসুমের কয়েক মাস নয়, সরকার ও উদ্যোক্তারা চাইলে সারা বছরই আমকেন্দ্রিক কৃষি অর্থনীতি সচল থাকতে পারে। বিশেষ করে আমকেন্দ্রিক কৃষিশিল্পে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে রাজশাহী অঞ্চলে বছর বছর বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত হলেও খুব সামান্য পরিমাণ আম বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্পও রয়েছে। এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আরিফুর রহমান বলেন, রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনে চাষিদের সহায়তা করা এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। প্রতিবছরই কিছু কিছু পরিমাণ আম বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এতে আমের বাণিজ্য সম্ভাবনা বেড়েছে।

জানা যায়, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বিদেশে আম রপ্তানির বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। ব্যুরো অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার হোসেন আম রপ্তানির সম্ভাবনা দেখতে ২০ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কয়েকটি বাণিজ্যিক আমবাগান পরিদর্শন করেন।

তিনি বলেন, রাজশাহী অঞ্চলে আমবাগানের ব্যাপক সম্প্রসারণ হলেও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিদেশে আম রপ্তানি করতে হলে বিশেষ কিছু মাণদণ্ড অনুসরণ ও রক্ষা করতে হয়। আমরা চাষিদের প্রণোদনাও দিয়ে থাকি। এ বছরও কিছু পরিমাণ আম বিদেশে যাবে। তবে কত পরিমাণ কোন দেশে যাবে, ঠিক এ মুহূর্তে নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময়ের কথা ২৪ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন somoyerkotha24news@gmail.com ঠিকানায়।