অনলাইন ডেস্ক : দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র শুক্রবার রোমে ওমানের মধ্যস্থতায় পঞ্চম দফা পরমাণু আলোচনা করেছে, তবে এতে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
তবে উভয়পক্ষই আলোচনাকে ‘গঠনমূলক’ বলে আখ্যায়িত করেছে এবং আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
তেহরান থেকে এএফপির এক প্রতিবেদনে আলোচনার অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হওয়ার প্রধান কারণগুলো তুলে ধরেছে:
– সমৃদ্ধকরণ –
ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম এখনও মূল বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো সন্দেহ করে যে ইরান পরমাণু অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা করছে। তবে ইরান এই অভিযোগ অস্বীকার করে থাকে।
তেহরান দাবি করে, তার পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ ও বেসামরিক লক্ষ্যেই পরিচালিত।
আলোচনায় ওয়াশিংটনের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে থাকা মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ ইরানের সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিয়েছেন।
আলোচনার আগেই উইটকফ বলেছিলেন, ওয়াশিংটন ‘ইরানের জন্য এক শতাংশ সমৃদ্ধকরণ ক্ষমতাও মেনে নিতে পারে না’।
তেহরান এর জবাবে জানিয়েছে, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ‘অপরিবর্তনীয়’ এবং এমন দাবি একটি চুক্তিকে অসম্ভব করে তোলে।
ইরানের প্রধান আলোচক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি টুইটারে লিখেছেন, ‘শূন্য পারমাণবিক অস্ত্র = চুক্তি সম্ভব। শূন্য সমৃদ্ধকরণ = চুক্তি অসম্ভব।’
বিশেষজ্ঞদের মতে পঞ্চম দফার আলোচনায় উভয়পক্ষের রেড লাইন সরাসরি মুখোমুখি হয়েছে।
‘এই দফার আলোচনা ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নিয়ে একে অপরের প্রকাশ্য রেড লাইন একেবারে মুখোমুখি হয়েছে’, বলেন সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির সিনা তুসি।
ইরান এখনও একমাত্র অ-পরমাণু রাষ্ট্র যারা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে। এটি ২০১৫ সালের চুক্তিতে নির্ধারিত ৩.৬৭ শতাংশ সীমা অতিক্রম করেছে, তবে এটি অস্ত্র তৈরির উপযোগী মাত্রা ৯০ শতাংশের নিচে।
২০১৫ সালের চুক্তিটি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে বাতিল করেন।
– ‘বিভ্রান্তিকর অবস্থান’ –
ইরান চাইছে আলোচনার বিষয় যেন কেবল তার পরমাণু কর্মসূচি এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ওমানে শুরু হওয়া প্রথম দফা আলোচনা (১২ এপ্রিল) থেকে তেহরান এই অবস্থান বজায় রেখেছে।
তেহরান বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র ‘অযৌক্তিক’ দাবি তুলছে এবং মার্কিন কর্মকর্তারা পরস্পরবিরোধী বার্তা দিচ্ছেন।
আরাকচি সতর্ক করেছেন, এই ধরনের ‘বিভ্রান্তিকর অবস্থান’ অব্যাহত থাকলে ‘আলোচনা আরও জটিল হয়ে উঠবে’।
আলোচনার আগে বিশ্লেষকরা ধারণা করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়েও কথা বলতে পারে।
তারা মনে করেন, তেহরানের ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ সমর্থনের বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে। এই অক্ষের মধ্যে রয়েছে লেবাননের হিজবুল্লাহ, গাজায় হামাস এবং ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা।
২৭ এপ্রিল ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রকে চুক্তিতে কেবল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নয়, বরং ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নকেও অন্তর্ভুক্ত করতে আহ্বান জানান।
তবে ইরান স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, এসব অ-পরমাণু ইস্যু আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করা চলবে না, কারণ এসব তার সার্বভৌম অধিকার ও প্রতিরক্ষা চাহিদার অন্তর্গত।
– নিষেধাজ্ঞা –
কূটনৈতিক তৎপরতা চলাকালেও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
তেহরান বলেছে, ওয়াশিংটনের এই ‘শত্রুসুলভ আচরণ’ তার সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আলোচনার ঠিক আগে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
বুধবার যুক্তরাষ্ট্র ইরানের নির্মাণ খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, এটি পারমাণবিক, সামরিক বা ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত হতে পারে—এই যুক্তিতে।
‘এই নিষেধাজ্ঞাগুলো মার্কিন কূটনৈতিক সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে’, এক্স-এ পোস্ট করেন ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাঈল বাকায়ি।
এপ্রিলের শেষদিকে তৃতীয় দফা আলোচনার আগে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তেল ও গ্যাস খাতেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
– সামরিক হুমকি –
২০১৫ সালের চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার পর এটিই ছিল তেহরান-ওয়াশিংটনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ। এর আগে মার্চে ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির কাছে চিঠি পাঠিয়ে কূটনৈতিকভাবে সমাধানে উৎসাহ দেন, তবে আলোচনায় ব্যর্থ হলে সামরিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেন।
তেহরানও পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
শুক্রবার ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মোহাম্মদ বাগেরি বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো ভুল পদক্ষেপের পরিণতি হবে ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তানের মতো।’
এর আগে সিএনএন এক প্রতিবেদনে জানায়, ইসরাইল ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
জাতিসংঘকে পাঠানো এক চিঠিতে আরাগচি বলেন, ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোতে যদি জায়নবাদী রেজিম কোনো হামলা চালায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রও এতে জড়িত থাকবে এবং এর আইনি দায় নিতে হবে।’
মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস জানায়, রোমে শুক্রবারের আলোচনার ঠিক আগে উইটকফ ইসরাইলি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
ইরানের রক্ষণশীল দৈনিক ‘কায়হান’ শনিবার লিখেছে, ‘ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর সমন্বয় এই আলোচনাকে অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’