নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

ঢাকা শুক্রবার। সন্ধ্যা ৭:৫৪। ১৬ মে, ২০২৫।

ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ দিবস আজ

মে ১৬, ২০২৫ ৩:২১ অপরাহ্ণ
Link Copied!

অনলাইন ডেস্ক : ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ দিবস আজ শুক্রবার। পদ্মার উজানে ভারতের ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরি করে পানি প্রত্যাহারের প্রতিবাদে ১৯৭৬ সালের এই দিনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের লক্ষাধিক মানুষ রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দানে জমায়েত হয়েছিলেন। এখান থেকেই সেদিন মরণ বাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লং মার্চ শুরু হয়েছিল। পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সেদিন লাখো জনতার বজ্রকণ্ঠে যে প্রতিবাদ উঠেছিল তার প্রতিধ্বনি পৌঁছেছিল দিল্লীতে। পানির জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে এটি ছিল এক অবিস্মরণীয় প্রতিবাদের ঘটনা।

রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দান থেকে লাখো জনতার পদযাত্রা শুরু হয়েছিল সকাল ১০টায়। জনতার স্রোত গোদাগাড়ীর প্রেমতলীতে গিয়ে পৌঁছায় দুপুর ২টায়। সন্ধ্যা ৬টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজ মাঠে এসে লং মার্চের যাত্রা বিরতি ঘটে। পরের দিন সকাল ৮টায় পুণরায় যাত্রা শুরু হয়। লাখো মানুষ মহানন্দা নদী পার হন নৌসেতু তৈরি করে। এরপর জমায়েত হয় ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট হাইস্কুল মাঠে।

সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে সেদিন মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না, কারো হুমকিকে পরোয়া করে না’। তিনি বলেন, ‘আজ চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হলো তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির রুখে দাঁড়ানোর জ্বলন্ত নজির। নিঃসন্দেহে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে’। ফারাক্কা বাঁধকে মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের জন্য মরণ বাঁধ বলে ঐতিহাসিক সেই জনসভায় উল্লেখ করলে মুহূর্তেই লাখো মানুষের শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে কানসাট হাইস্কুল মাঠ। আওয়াজ ওঠে ‘ভেঙ্গে দাও-গুড়িয়ে দাও মরণবাঁধ ফারাক্কা’।

গবেষকেরা বলছেন, ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ ষোল আনা সফল হয়েছিল। ফারাক্কা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাতারাতি একটি ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল এই লং মার্চের পর। দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যমত সৃষ্টি হয় ইস্যুকে ভিত্তি করে। ক্রমাগত আন্তর্জাতিক চাপ এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এনে ভারত ১৯৭৭ সালে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি পাঁচসালা চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল।

আরও পড়ুনঃ  জবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে সমাবেশ শুরু

চুক্তিতে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ উপযুক্ত পরিমাণ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েছিল, যা সঠিকভাবেই কার্যকর ছিল। এই চুক্তি অনুযায়ী, বছরের সব থেকে কম প্রবাহের সময়কাল এপ্রিলের শেষ ১০ দিন ফারাক্কার প্রায় ৫৫ হাজার কিউসেক পানির মধ্যে বাংলাদেশ পাবে ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি। আর ভারত পাবে ২০ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি। কোন কারণে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির পরিমাণ কমে এলে বাংলাদেশ তার প্রাপ্য অংশের ৮০ ভাগ অর্থাৎ ২৭ হাজার ৬০০ কিউসেক পানি পাবে। এটি ছিল চুক্তির গ্যারান্টি ক্লস। ৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তিটি জাতিসংঘে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৮২ সালে ৫ বছর মেয়াদি চুক্তি শেষ হলে বাংলাদেশ সেটি নবায়ন করতে চাইলে ও ভারতের আপত্তির কারণে সম্ভব হয়নি।

হুাসেইন মোহাম্মদ এরশাদের সময়ে ১৯৮২ সালের ৭ অক্টোবর নয়াদিল্লীতে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ে চুক্তি নবায়ণ না হয়ে একটি সমঝোতা স্মারকপত্র সাক্ষরিত হয়। সমঝোতায় ১৯৭৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী পানিবন্টনের ব্যবস্থাগুলো বহাল থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে ৮০ ভাগ পানি পাওয়ার গ্যারান্টি ক্লস বাদ দেয়া হয়। এর ফলে গঙ্গার পানি ভাগাভাগির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ চরমভাবে হানিকর পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এর পাশাপাশি ১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে নদী কমিশনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল নেপালকে অন্তর্ভুক্ত করে যৌথ নদী কমিশন গঠনের। ১৯৮২ সালের সমঝোতা স্মারকে সেটিও বাদ দেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশ আর নায্য হিস্যা পায়নি।

সেচের অভাবে ৬ কোটি মানুষ

ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চে অংশ নিয়েছিলেন নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী ও রাজনীতিক মাহমুদ জামাল কাদেরী। ফারাক্কা লংমার্চ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহীর একটি রেস্তোরাঁয় এক সংবাদ সম্মেলনে তারা জানান, যতোই দিন গড়াচ্ছে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব তাদের ভাবিয়ে তুলছে, আতঙ্কিত করছে। প্রতি বছরে শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে বাংলাদেশের গঙ্গা ও পদ্মা নদীতে চরের বিস্তার একটি নিয়মিত ঘটনা। এর পাশাপাশি গঙ্গা-পদ্মার শাখা-প্রশাখা সহ প্রায় শতাধিক নদ-নদী ক্রমান্বয়ে মৃত খালের রূপ নিচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  ভারত-পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক বহিষ্কার

সংবাদ সম্মেলনে মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ভারতের ফারাক্কা ব্যারাজের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের অন্তত ছয় কোটি মানুষ সেচসংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলের প্রায় দুই কোটি এবং দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের আরও চার কোটি মানুষ সরাসরি ক্ষতির শিকার। ফারাক্কার কারণে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পে পানির ঘাটতির ফলে ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। উজান থেকে স্বাদু পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে, যার ফলে মাটির উর্বরতা কমে এসেছে। বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের শতভাগ অগভীর নলকূপ এবং অনেক এলাকার অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। আর্সেনিক দূষণের কারণে অনেক এলাকায় নলকূপের পানি পানযোগ্য নেই।

মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, বর্তমানে প্রতি শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা-পদ্মা নদীর প্রবাহ ভয়াবহভাবে কমে যায়। শতাধিক শাখা নদ-নদী রূপ নিচ্ছে মৃত খালে। নদীর বুকে গরুর গাড়ি চলে, বালুবাহী ট্রাক চলে, অথচ পানি নেই। ১৯৭৫ সাল থেকে গঙ্গা-পদ্মার প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার নৌপথ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। লবণাক্ততার কারণে খুলনা অঞ্চলে ধান উৎপাদন কমে গেছেঠ। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যও স্বাদু পানির অভাবে হুমকির মুখে পড়েছে।

তিনি অভিযোগ করেন, ভারতের উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ ও বিহার রাজ্যে গঙ্গার প্রায় ৪০০ পয়েন্ট থেকে একতরফাভাবে পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আপার, মধ্য ও নিম্ন গঙ্গা ক্যানেল প্রকল্পের মাধ্যমে বিশাল এলাকায় এই পানি সেচে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর শতভাগ দায়ভার ভারতের।

রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরিস্থিতি উল্লেখ করে মাহবুব বলেন, গত ৪০ বছরে গঙ্গার আয়তন অর্ধেকে নেমে এসেছে। পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে, জলজপ্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে। পানি নেই বলে ইলিশ আর আসে না, ডলফিন আর ঘড়িয়াল বিলুপ্তপ্রায়।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে রাজশাহী অংশে গঙ্গার আয়তন কমেছে ৫০ শতাংশ, পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ এবং প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। সুন্দরবনে মিঠাপানির প্রবাহ কমেছে ৯০ শতাংশ। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি গঙ্গায় পানিপ্রবাহ ছিল ৯০ হাজার ৭৩০ কিউসেক, যা ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি এসে দাঁড়ায় ৭৫ হাজার ৪০৯ কিউসেকে। এক বছরের ব্যবধানে পানি কমেছে ১৫ হাজার ৩২১ কিউসেক।

আরও পড়ুনঃ  মাতৃত্বকালীন ভাতা দেওয়ার কথা বলে টাকা আত্মসাৎ, নারী আটক

সংবাদ সম্মেলনে ফারাক্কা সমস্যার সমাধানে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে- ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই একটি শক্তিশালী কমিটির মাধ্যমে এর কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা, নতুন চুক্তিতে ১৯৭৭ সালের মতো গ্যারান্টিক্লজ অন্তর্ভুক্ত করা, যৌথ নদী কমিশনে নেপালকে যুক্তকরণ এবং নির্ধারিত সময়ে বৈঠক করা, অভিন্ন নদীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণে বিশেষজ্ঞ দল গঠন ও ভারতকে তালিকা জানানো, ভারতের একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার বন্ধে আন্তর্জাতিক আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা, জাতিসংঘ বা বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, চীন, ভুটান ও মিয়ানমারকে নিয়ে আঞ্চলিক নদী ফোরাম গঠন করা; গঙ্গা, তিস্তা, বরাকসহ সব নদীর পানি প্রত্যাহারে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং ভারতের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করা।

লং মার্চ দিবসের কর্মসূচি

ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ দিবসের ৪৯তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আজ শুক্রবার রাজশাহীতে র‌্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। বিকেল ৩টায় রাজশাহী কলেজের সামনে থেকে র‌্যালিটি বের করবে ফারাক্কা লং মার্চের ৪৯তম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি। র‌্যালি শেষে বিকেল ৪টায় রাজশাহী কলেজ মিলনায়তনে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।

অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি থাকবেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব, লেখক ও গবেষক বেনজিন খান, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ এবং রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ মু. যহুর আলী। আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ড. ইফতেখারুল আলম মাসউদ। সভাপতিত্ব করবেন উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক নদী গবেষক মাহমুব সিদ্দিকী।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময়ের কথা ২৪ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন somoyerkotha24news@gmail.com ঠিকানায়।