চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি : চাঁপাইনবাবগঞ্জ খাদ্য বিভাগে গড়ে উঠেছিল দুর্নীতির এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সদ্য বদলি করা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জান মোহাম্মদ তার অধীনস্থ খাদ্য পরিদর্শক ও সদর খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাকিলা নাসরিনকে নিয়ে দুর্নীতির এই জুটি গড়েছিলেন। তাদের দুর্নীতির চিত্র সামনে আসার পর এ জুটি ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছে খাদ্য বিভাগ। বদলি করা হয়েছে জান মোহাম্মদকে। আর ব্যাখা তলব করা হয়েছে সাকিলার কাছে।
সোমবার (১২ মে) পর্যন্ত নতুন কর্মস্থলে যাননি জান মোহাম্মদ। তিনি সদর উপজেলার আমনুরা খাদ্যগুদামে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েবের চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে বাধা দেওয়ায় খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও খাদ্য পরিদর্শক রেশমা ইয়াসমিনকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন। তদন্ত কমিটি করা হলে প্রাথমিক তদন্তেই ঘটনার সত্যতা মিলেছে।
খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সদর খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাকিলা নাসরিনকে নিয়ে দুর্নীতির জুটি গড়েছিলেন জান মোহাম্মদ। দুজনে মিলে অবৈধভাবে আয় করেছেন লাখ লাখ টাকা। এ জন্য তিনি বদলি হতে চান না। তবে খাদ্য বিভাগ এই দুর্নীতির জুটি ভাঙতেই জান মোহাম্মদকে দূরবর্তী স্থানে বদলি করে।
সম্প্রতি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহন আহমেদ জেলা শহরের বিভিন্ন ওএমএসের ডিলারদের দোকান পরিদর্শন করেন। তখন তিনি দেখতে পান, গুদাম থেকে সরবরাহ করা চালের বস্তায় ‘বিতরণকৃত’ লেখা স্টেনসিল মার্ক দেওয়া হয়নি। অথচ গুদাম থেকে খাদ্যশস্যসহ বস্তা বের করার সময় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নামসহ এই স্টেনসিল দেওয়া বাধ্যতামূলক। এই স্টেনসিল দেওয়ার জন্য শ্রমিক বিল বরাদ্দ থাকে। স্টেনসিল না দেওয়া হলেও ৮৫ হাজার টাকা বিল তুলে নেওয়া হয়। এ নিয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সাকিলা নাসরিনের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেন। শ্রমিক বিল তুললেও কেন বস্তায় স্টেনসিল দেননি তার জবাব দিতে বলা হয়েছে সাকিলাকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্টেনসিল না দিলেও প্রতিমাসেই ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা শ্রমিক বিল প্রস্তুত করেন সাকিলা। আর পেয়িং কর্মকর্তা হিসেবে এই বিল অনুমোদন করতেন জান মোহাম্মদ। পরে বিলের টাকা ভাগবাঁটোয়ারা করে নিতেন দুজনে। সদর গুদামে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন ধান-চাল কেনা হয়। বেশ কয়েকজন মিলার জানিয়েছেন, জান মোহাম্মদের কথা বলে টনপ্রতি ২০০ টাকা আদায় করেন সাকিলা নাসরিন। একইভাবে বস্তা সরবরাহকারী ঠিকাদারদের কাছ থেকেও টাকা আদায় করেন তিনি।
সূত্র আরও জানায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর গুদাম থেকে প্রতিমাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল পরিমাণ রেশনের চাল বরাদ্দ থাকে। এই চাল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী না নিয়ে গিয়ে গুদামেই বিক্রি করে দেয়। কম দামে এই চাল কিনে নেন জান মোহাম্মদ ও সাকিলা। পরের মৌসুমে সরকার যখন বেশিদরে চাল সংগ্রহ করে, তখন এই চালকে আবার সংগ্রহ দেখানো হয়। এই ব্যবসা করেও বিপুল টাকা লাভ করেন জান মোহাম্মদ ও সাকিলা নাসরিন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাদ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ডিও’র মাধ্যমে যেসব টিআর-এর চাল বরাদ্দ হয় তার সবটাই জান মোহাম্মদ দিতেন সদর গুদাম থেকে। প্রতিটি ডিও ছাড়ের সময় জান মোহাম্মদ বরাদ্দপ্রাপ্তদের কাছ থেকে ২০০ টাকা নিতেন। একইভাবে চাল ছাড়ের সময় ২০০ টাকা নেন সাকিলা নাসরিন। আবার গভর্নমেন্ট শর্টেজ (জিএস) দেখিয়েও সদর গুদাম থেকে সরকারি ধান-চাল আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে দুজনের বিরুদ্ধে।
সূত্র জানায়, গুদামে মজুত খাদ্যশস্য শুকিয়ে ৬ মাসে ০.৫ শতাংশ ওজন কমতে পারে। এটি সরকারিভাবেই স্বীকৃত। নিয়ম না থাকলেও সাকিলা নাসরিন সংগ্রহের সময় কৃষক ও মিলারদের কাছ থেকে জিএস হিসেবে বাড়তি ওজন নেন। কিন্তু ৬ মাস পর ঠিকই জিএস দেখিয়ে ওজনে কারসাজি করেন। কৃষকের কাছ থেকে নেওয়া বাড়তি খাদ্যশস্য বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগও আছে সাকিলার বিরুদ্ধে। আর এর ভাগ পেতেন খাদ্য নিয়ন্ত্রক জান মোহাম্মদ। এ বিষয়ে কথা বলতে সদর খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাকিলা নাসরিনকে ফোন করা হয়। পরিচয় দেওয়ার পর তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পওে আর ফোন ধরেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাকিলা ও জান মোহাম্মদের এমন দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। আগে থেকেই অধীনস্থদের গালিগালাজে অভ্যস্ত জান মোহাম্মদ। এর আগে তিনি শিবগঞ্জ উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তখন তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছিল। ২০২৩ সালে শিবগঞ্জে ২১ হাজার ৪৬১টি খাদ্যবান্ধব কার্ডের ডাটাবেজ এন্ট্রি বাবদ ১ লাখ ৭ হাজার ৩০৫ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছিল। কিন্তু তিনি পার পেয়ে যান।
শিবগঞ্জে থাকা অবস্থায় সালেমা খাতুন নামের এক সহকারী উপ-খাদ্য পরিদর্শককে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেছিলেন জান মোহাম্মদ। ২০২০ সালের ২ নভেম্বর বিষয়টি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রককে জানিয়ে বদলির আবেদন করেছিলেন সালেমা খাতুন। চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মুহাম্মদ মিজানুর রহমান অসাদচরেণর অভিযোগে জান মোহাম্মদের কাছে ব্যাখা তলব করেছিলেন। এছাড়া সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করায় ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর তার কাছে ব্যাখা তলব করেছিলেন তৎকালীন জেলার সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক অন্তরা মল্লিক। কিন্তু বার বার পার পেয়ে গেছেন জান মোহাম্মদ।
অভিযোগগুলোর বিষয়ে জান মোহাম্মদ বলেন, আমার চাকরির বয়স ৩৬ বছর। অভিযোগ উঠতেই পারে। যে কেউ মিথ্যা অভিযোগ দিতে পারে। বাস্তবে সত্যতা কতটুকু সেটা বিষয়। এখন রেশমা ইয়াসমিন আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে। আমিও সঠিক তদন্ত চাই।
জেলার ভারপ্রাপ্ত খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহন আহমেদ বলেন, আমি দুইমাস হলো এখানে এসেছি। জান মোহাম্মদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ থাকলেও কেন এতদিন তিনি শাস্তি পাননি তা জানি না। তবে আমি আসার পর রেশমা ইয়াসমিনের লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তারপর কমিটি করে তদন্ত করেছি। রিপোর্টও পেয়েছি। এতে ঘটনার সত্যতা উঠে এসেছে। আমি এটা ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে পাঠাব। তারা ব্যবস্থা নেবেন বলে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন।
সাকিলার সঙ্গে জান মোহাম্মদের দুর্নীতির সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের বিষয়গুলো আমি জানি না। তবে সম্প্রতি আমি শ্রমিক বিল তুলে নিলেও স্টেনসিল না দেওয়ার একটা অনিয়ম পেয়েছি। তার প্রেক্ষিতে ব্যাখা তলব করেছি। শুনেছি, তিনি জবাব দিয়েছেন। কিন্তু অফিসিয়ালি এখনও সেটা পাইনি। তার জবাব দেখার পরে ব্যবস্থা নেব।