নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

ঢাকা মঙ্গলবার। রাত ১:১১। ২৯ জুলাই, ২০২৫।

চারঘাটের শতবর্ষী ইউসুফপুর কৃষি উচ্চ বিদ্যালয় অফিস সহায়কের কাছে অসহায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা

জুলাই ২৮, ২০২৫ ৫:১৮
Link Copied!

পিন্টু আলী, চারঘাট প্রতিনিধি : রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার শতবর্ষী ইউসুফপুর কৃষি উচ্চ বিদ্যালয় কার্যত জিম্মি হয়ে পড়েছে অফিস সহায়ক আব্দুল হালিমের কাছে। চায়ের সাথে বিষ মিশিয়ে শিক্ষকদের মেরে ফেলার চেষ্টা, শিক্ষকদের নামে মামলা দিয়ে হয়রানি, অফিস সহায়ক পদে চাকরি করেও অপর একটি প্রতিষ্ঠানে নৈশ প্রহরী পদে চাকরি করাসহ নানা অভিযোগ থাকলেও তিনি পুরো প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন একচ্ছত্র ক্ষমতায়। নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলেই বহিরাগতদের নিয়ে এসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হেনস্তা ও সম্মানহানি ঘটাচ্ছেন।

ইউসুফপুর কৃষি উচ্চ বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, চারঘাট উপজেলার ইউসুফপুর গ্রামে পদ্মা নদীর পাড়ে ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষে ১৯২৫ সালের দিকে ইউসুফপুর কৃষি উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। তিন দফা বিদ্যালয়ের ভবন পদ্মার গর্ভে বিলীন হলে নতুন ভাবে আবারও গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৩২ জন ও শিক্ষকের সংখ্যা ২১ জন।

জানা যায়, ১৯৯৫ সালে অফিস সহায়ক পদে চাকরিতে যোগদান করেন আব্দুল হালিম। স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ায় যোগদানের পর থেকে নিজের দায়িত্ব পালন না করে শিক্ষকদের উপরে প্রভাব খাটানো শুরু করেন। এতে শিক্ষকরা প্রতিবাদ করলে তিনি ১৯৯৮ সালে ধর্মীয় শিক্ষক মাওলানা আব্দুল মজিদ ও বিজ্ঞান শিক্ষক আব্দুল হাকিমকে চায়ের সাথে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করেন। ওই সময়ের রেজুলেশন খাতায় বিষয়টি উল্লেখ করা আছে। এমনকি সে এরূপ ঘটনা আর কখনো ঘটবেনা মর্মে ৫০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে বন্ড দেয়। তারপর থেকে শিক্ষকরা হালিমের পরিবর্তে নৈশ প্রহরীকে দিয়ে অফিসের বিভিন্ন কাজ করাতেন।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানান, অফিস সহায়ক পদে চাকরি করা অবস্থাতেই আব্দুল হালিম রাজশাহী টেনিস কমপ্লেক্সে নৈশ প্রহরী পদে চাকরিতে যোগদান করেন। সারারাত নৈশ প্রহরীর দায়িত্ব পালন শেষে সকালে বিদ্যালয়ে এসে শুধুমাত্র ক্লাসরুমগুলোর তালা খুলে দিয়ে ফাঁকা রুম দেখে ঘুমিয়ে যান। শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীরা কোনো কাজের কথা বললেই খারাপ ব্যবহার এমনকি মারতেও তেড়ে আসেন। এ অবস্থায় বিদ্যালয়ের কেউই তাকে কিছু বলতে সাহস করেন না।

আরও পড়ুনঃ  রাজশাহীতে পুলিশের অভিযানে ১ কেজি গাঁজাসহ গ্রেপ্তার ১

এর মধ্যে গত পাঁচ আগষ্ট সরকার পতনের পর আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেন আব্দুল হালিম। সে ৬ আগষ্ট বহিরাগত লোকজন নিয়ে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের ঘরের তালা খুলে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। অফিসরুমের লাইব্রেরিতে থাকা বিভিন্ন বই ও কাগজপত্র ইউসুফপুর মোড়ে নিয়ে গিয়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এরপর ৯ নভেম্বর নৈশ প্রহরীর বাড়িতে চাবি নিতে যায় হালিম। চাবি দিতে না চাইলে সে জোরপূর্বক চাবি নিয়ে এসে অফিস রুমের বিভিন্ন আলমারি ও ড্রয়ারের তালা ভেঙে টাকা নিয়ে যায়। দুটি ঘটনাতেই তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ইমদাদুল ইসলাম থানায় জিডি করেছেন।

স্থানীয় অভিভাবক ও রাজনৈতিক নেতাদের ডেকে বিষয়টি দেখালে আব্দুল হালিম আরো রেগে যান। তিনি স্থানীয় শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক সাইদুল ইসলামকে প্রলোভন দেখান তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ইমদাদুল ইসলাম মাস খানেক পরেই অবসরে যাবেন এরপর তাকে প্রধান শিক্ষক বানাবেন। বিনিময়ে বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের নামে আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। নানা মিথ্যা অভিযোগ তুলে ধরে প্রধান শিক্ষকসহ কয়েকজনের নামে মামলা লিখে এনে সাইদুল ইসলামের সাক্ষর নিয়ে আদালতে জমা দেন হালিম। তবে পরবর্তীতে পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের পর সে মামলা বাতিল হয়েছে। এরপর ১৩ নভেম্বর হালিম নিজে বাদী হয়ে প্রধান শিক্ষক ইমদাদুল ইসলাম ও তার পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও কয়েকজন সহকারি শিক্ষকের নামে আবারও আদালতে মামলা দায়ের করে।

আরও পড়ুনঃ  ডেঙ্গুতে একদিনে ৩ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩৩১

মামলার বাদী সাইদুল ইসলাম বলেন, অফিস সহায়ক আব্দুল হালিম বললো বিদ্যালয়ে সে যা করবে তাই হবে। প্রধান শিক্ষক অবসর নিলে আমাকে প্রধান শিক্ষক বানাবে। বিনিময়ে শুধু কয়েকজন নামে মামলার কাগজে বাদি হিসাবে সাক্ষর দিতে হবে। প্রধান শিক্ষক হবার ইচ্ছে থাকায় আমি রাজি হই। তবে পরে আমি খোঁজ খবর নিয়ে অন্যায় হচ্ছে দেখে আদালতে আবেদন দিয়ে মামলা তুলে নিয়েছি।

সাবেক প্রধান শিক্ষক ইমদাদুল ইসলাম বলেন, চাকরিতে যোগদানের পর থেকেই সে পুরো বিদ্যালয়ে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। সে পাঁচ আগষ্টের পর আরো বেপরোয়া হয়ে গেছে। অফিস সহায়ক সে বিদ্যালয় রক্ষা করার পরিবর্তে সে ভাংচুর করে জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে আগুনে পুড়িয়েছে। আমি গত জানুয়ারিতে অবসর নিয়েছি। কিন্তু তারপরও শান্তিতে নাই। সে আমার নিকট থেকে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে আসছে নয়তো আমার সম্মানহানি ঘটাবে। প্রতিনিয়ত সে বিদ্যালয়ে বহিরাগতদের নিয়ে এসে হট্টগোল করছে। বর্তমান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

স্থানীয় অভিভাবক সেলিম রেজা বলেন, আমার ছেলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। মাঝে মাঝেই শুনি অফিস সহায়ক আব্দুল হালিম সময়মত ক্লাসরুম না খোলায় শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ঢুকতে পারছেনা। সে অন্য জায়গায় সারারাত ডিউটি করে এসে বাড়িতে ঘুমায়। পরে শিক্ষরা বাড়ি থেকে চাবি এনে রুম খোলে। স্থানীয় মাদক কারবারিদের সাথে সখ্যতা থাকায় কেউ হালিমকে কিছু বলতে সাহস করেনা।

আরও পড়ুনঃ  শিগগিরই গঠিত হচ্ছে তথ্য কমিশন

বিদ্যালয়ের বর্তমান সভাপতি মামুনুর রশীদ বলেন, সে শিক্ষকদের তো দুরে কথা আমি বিদ্যালয়ের একজন সভাপতি আমাকে পর্যন্ত সম্মান দেয় না। বিদ্যালয়ে মাঝে মধ্যে গেলে সে আমাকে দেখে নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করে, একটা সালাম পর্যন্ত দেয় না। আমাকে পাত্তা না দিলে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কি অবস্থায় আছে একবার চিন্তা করেন। এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত।

বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, প্রতিদিনই বিদ্যালয়ে বহিরাগতরা এসে নানা রকম ঝামেলা করছে। কেউ সাংবাদিক, কেউ মানবাধিকার কর্মী পরিচয় দিয়ে এটা সেটা বলে নানা রকম আবদার করছে। তাদের সবার সাথে অফিস সহায়ক আব্দুল হালিমের ভাল সম্পর্ক। এ অবস্থায় বিদ্যালয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। আব্দুল হালিমের নানা অভিযোগ রেজুলেশন করা আছে এবং উর্ধতন কতৃপক্ষকে জানানো আছে।

অভিযোগের বিষয়ে অফিস সহায়ক আব্দুল হালিম বলেন, দুই শিক্ষককে কৌতুহলবশত চায়ের সাথে এক ধরনের ট্যাবলেট মিশিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিলাম। দুই জায়গায় দুই সময়ে চাকরি করে এটা কোনো অনিয়ম না। বহিরাগতদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসার বিষয়ে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ে অনিয়ম হলে তা প্রতিরোধ করা সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমার দায়িত্ব। এজন্য অফিস সহায়ক হলেও একজন নাগরিক হিসাবে বিদ্যালয়ের এসব বিষয়গুলোতে আমি নজর রাখি।

এ বিষয়ে চারঘাট উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার মোঃ রাহেদুল ইসলাম বলেন, একসাথে দুই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুযোগ নেই। অভিযোগের বিষয়গুলো তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময়ের কথা ২৪ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন somoyerkotha24news@gmail.com ঠিকানায়।