পিন্টু আলী, চারঘাট (রাজশাহী) : রাজশাহীর সীমান্তবর্তী চারঘাট উপজেলার মিয়াপুর গ্রামের বাসিন্দা তারেকুল ইসলাম। পেশায় একটি ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করতেন৷ গত বৃহস্পতিবার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৪৬ পিচ ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেটসহ তাকে আটক করে। পরবর্তীতে তাকে মাদক মামলা দিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। কারণ ইয়াবার বিকল্প হিসাবে ব্যবহৃত ‘ট্যাপেন্টাডল হাইড্রোক্লোরাইড’ নামের ভয়ংকর এই ট্যাবলেট বিক্রি করতেন তিনি।
দেশের মাদক পরিবহনের অন্যতম রুট হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলো। প্বার্শবর্তী ভারত থেকে চোরাইপথে নানা কায়দায় এ পথে দেশে আসছে ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেট। এরপর মাদক কারবারি, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি ও ফার্মেসী গুলোর মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রান্তে। ইয়াবার চেয়ে কম দাম ও গ্রামগঞ্জে হাতের নাগালে পাওয়ায় এখন আসক্তদের প্রথম পছন্দে পরিণত হয়েছে এই ট্যাবলেট। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেট ইয়াবার চেয়ে বহুগুণ ক্ষতিকর। এটি সেবনে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে।
জানা যায়, ব্যথা নিরাময়ের জেনেরিক ওষুধ ট্যাপেন্টাডল পাঁচ বছর আগেও বৈধ ওষুধ ছিল। দেশের আটটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এটি বাজারজাত করতো। দেশের বাজারে ১০-১৪ টাকায় বিক্রি হতো প্রতি পিস ট্যাবলেট। নেশা হিসেবে ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রস্তাব মতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ ট্যাপেন্টাডল বাতিলের সুপারিশ করে। ২০২০ সালে ট্যাপেন্টাডল নিষিদ্ধ করা হয়।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ট্যাপেন্টাডল ওষুধে অ্যামফেটামিন রয়েছে, যার কারণে এটিকে নেশাদ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করে।মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৬৫ ধারা অনুযায়ী ওই আইনে ‘খ’ শ্রেণির মাদকদ্রব্য হিসেবে টাপেন্টাডলকে তফসিলভুক্ত করা হয়েছে।
জানা যায়, বাংলাদেশে এটির উৎপাদন নিষিদ্ধ হলেও প্রতিবেশী ভারতে এখনও এটি বৈধ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। দেশে উৎপাদন না হওয়ায় কালোবাজারে অতিরিক্ত মূল্য হওয়ায় ভারত থেকে এসব সরবরাহ করছে মাদক ব্যবসায়ীরা। এজন্য দেশে নিষিদ্ধ হলেও ওষুধটির ব্যবসা বন্ধ হয়নি। জেলা, উপজেলার গ্রামের বিভিন্ন ফার্মাসিতে এখনও এটি বিক্রি হচ্ছে। মাদক কারবারিরা সীমান্ত পেরিয়ে দেশে এনে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
গত ৪ জুন (বুধবার) মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার শিবপুর এলাকায় রবিউল ইসলাম নামে একজন ফার্মেসীর মালিকের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৩০০ পিচ ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেট উদ্ধার করে মামলা দায়ের করে।
গত ১৪ মে একই এলাকায় র্যাবের একটি দল অভিযান চালিয়ে ফারুক শেখ (৩৪) নামে এক মাদক কারবারিকে ২৮০ পিচ ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেটসহ আটক করেছে।
এর আগে ১২ মার্চ র্যাবের একটি দল অভিযান চালিয়ে একই উপজেলার বেলপুকুর এলাকার আশরাফুল ইসলাম (২৯) কে ৭৯৩ পিস ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেট সহ আটক করেছে।
গত ২৮ জানুয়ারি চারঘাটের ভায়ালক্ষীপুর এলাকার মাসুদ রানা নামের এক ব্যক্তির ফার্মেসী দোকান ও বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৩১০ পিস ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেট উদ্ধার করেছে পুলিশে জেলা গোয়েন্দা শাখা। গত কয়েক বছরে জেলা জুড়ে এরকম শত শত অভিযান চালিয়েছে আইনশৃংখলা বাহিনী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি জানান, প্রতি পিস ট্যাপেন্টাডল হাইড্রোক্লোরাইড ১০০ এমজি পাশের দেশ ভারতে খুচরা মূল্য ১১ টাকা ৫০ পয়সা। চোরাকারবারিরা নদী পথে জেলেদের মাধ্যমে এই ট্যাবলেট এনে দ্বিগুণ (২৪-২৫ টাকা) দামে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছে দিচ্ছে। সেগুলো তিনগুন (৩৫-৪০ টাকা) দামে ফার্মেসী গুলোতে সরবরাহ করছে প্রতিনিধিরা। ফার্মেসি মালিকরা সেগুলো মাদকসেবীদের কাছে প্রতি পিস ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেন। লাল-হলুদসহ বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে এই ট্যাবলেট। যেহেতু এগুলো ওষুধ সেজন্য ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা পরিবহন করলে কেউ সন্দেহ করেনা।
ঔষধ প্রশাসন রাজশাহীর দেয়া তথ্যমতে, জেলায় ৪ হাজার ১০০টি অনুমোদিত ওষুধের ফার্মেসি আছে। এছাড়াও গ্রাম-গঞ্জে আরো শত শত অনুমোদনহীন ফার্মেসি রয়েছে। এসব কোনো দোকানেই ওষুধ কিনতে প্রেসক্রিপশনের প্রয়োজন হয়না। এ সুযোগে বিশেষ করে উপজেলা পর্যায়ের দোকানগুলোতে ট্যাপেন্টাডলের মত নেশাদ্রব্য ওষুধগুলো বিক্রি হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে ফিরে এসে চারঘাট উপজেলা সদরের মেহেদী হাসান বলেন, ধনী-গরিব সব শ্রেণির লোকজন এখন এই ট্যাবলেট সেবন করছে। অধিকাংশ ফার্মেসিতেই এই ওষুধ পাওয়া যায়। তবে নিম্ন থেকে মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা বেশি খায়। দাম কম হওয়ায় তাদের কাছে এটা ইয়াবার বিকল্প। কেউ কাঁশির সিরাপের সাথে মিশিয়ে আবার কেউ ইয়াবার মত করে সেবন করছে।
সাবেক চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আশিকুর রহমান বলেন, এই ট্যাবলেট সেবনের কারণে তরুণরা মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। মাঝে মধ্যেই তারা হাত-পা নিস্তেজ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এটা সেবনে জৈবিক শক্তি হ্রাস পায়। কিডনি ড্যামেজসহ নানারকম জটিল উপসর্গ দেখা দেয়। এমনকি অতিরিক্ত সেবনে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে সেবনকারীর হঠাৎ মৃত্যুও হতে পারে।
চারঘাট উপজেলা মাদক প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, নামে-বেনামে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি, হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ফার্মেসিগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরা টার্গেট পুরণ করতে না পারায় ঠিকমত বেতন পাননা। এ সুযোগে তারা ফার্মেসিগুলোতে ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেট ও বিভিন্ন কাঁশির সিরাপ সরবরাহ করে আয় করার চেষ্টা করছেন। এতে মাদক কারবারি খুব সহজেই ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি ও ফার্মেসিগুলোর মাধ্যমে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
ঔষধ প্রশাসন রাজশাহী জেলার ঔষধ তত্ত্বাবধায়ক মোঃ শরিফুল ইসলাম বলেন, ট্যাপেন্টাডল আমাদের দেশের উৎপাদন ও বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এজন্য ফার্মেসিগুলোতে নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি আমারা মালিকদের বিভিন্ন সচেতনতা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। যেন তারা অবৈধ এসব ওষুধ ফার্মেসিতে না রাখেন।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর রাজশাহী (সার্কেল-খ) এর পরিদর্শক সাইফুল আলম বলেন, অন্য মাদকের উৎপাত কিছুটা কমলেও সে তুলনায় ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেটের নেশা বেড়েছে। প্রতি মাসেই দু একটি এই ট্যাবলেটের মামলা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও শুধুমাত্র গত মাসেই এই ট্যাবলেট সেবনে নেশাগ্রস্ত ২৭ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সহযোগিতায় এই ট্যাবলেটের বিস্তার কাজ করা হচ্ছে।