নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

ঢাকা শনিবার। রাত ৯:৪৩। ১৭ মে, ২০২৫।

ডিজিটাল নেশা: ভয়ঙ্কর বাস্তবতায় গেমিং আসক্তি

মে ১৭, ২০২৫ ৪:১৮ অপরাহ্ণ
Link Copied!

একসময়ের ক্লাসের সবচেয়ে প্রাণচঞ্চল ছাত্র তালহার (ছদ্মনাম) ইদানিং পড়ার টেবিলে মন বসে না, বইয়ের অক্ষরগুলো যেন ঝাপসা লাগে। এখন তার সব মনোযোগ আটকে গেছে মোবাইল গেমে। পড়ার টেবিলে বসতে তার একঘেয়ে লাগে, কিন্তু ভার্চুয়াল জগতের এই যুদ্ধের রোমাঞ্চ তাকে ধরে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এখন আর সে পড়াশোনায় আগের মতো নিয়মিত হতে পারছে না। রাত জেগে খেলার কারণে দিনে ক্লান্ত থাকে, ফলে ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারে না। প্রায়ই তার শিক্ষকদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। সময়মতো খাওয়াদাওয়াও করছে না, খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে গিয়েছে। তালহার আগের সেই আনন্দময়, সচল জীবনটা হারিয়ে যেতে বসেছে মোবাইল পর্দার পেছনে।
এটি শুধু তালহার গল্প নয়, বরং এখনকার দিনের বহু কিশোর- কিশোরীর বাস্তবতা। এ বাস্তবতার ফলে শুধুমাত্র শারীরিক বা শিক্ষাগত দিক নয়, তাদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশও আশঙ্কাজনকহারে ব্যাহত হচ্ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই বিশ্বে সময়ের দাবীতে এখন বেশিরভাগ শিশু-কিশোরদের হাতে বইয়ের বদলে মোবাইল, মাঠের বদলে তারা পেয়েছে ভার্চুয়াল জগত। প্রযুক্তি আমাদের হাতে এনে দিয়েছে অসংখ্য সুবিধা, কিন্তু এর অপব্যবহার আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছে এক ভয়াবহ নেশার দিকে Ñ গেম অ্যাডিকশন বা গেমের প্রতি আসক্তি।
বর্তমান যুগে অনেকক্ষেত্রেই গেম আর কেবল একটি বিনোদন নয়, অনেকের জন্য এটি হয়ে উঠেছে এক ধরনের নির্ভরতা, যা ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনযাপন, শিক্ষা, পারিপার্শ্বিকতা, সম্পর্ক ও মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) এ অবস্থাকে গেমিং ডিসঅর্ডার (এধসরহম উরংড়ৎফবৎ) স্বীকৃতি দানপূর্বক এটিকে একটি মানসিক ব্যাধি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
গেমিং ডিসঅর্ডারকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে কোনো ব্যক্তির এমন আচরণ হিসেবে যেখানে ব্যক্তির গেম খেলার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়, অন্যান্য কার্যকলাপের থেকে গেমিংকে অগ্রাধিকার দিতে থাকে এবং নানা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে উপলব্ধি করা সত্ত্বেও গেমিং চালিয়ে যেতে থাকে, এমনকি অনেকক্ষেত্রে তাতে আরও জড়িয়ে পড়তে শুরু করে। গেমে অতিরিক্ত আসক্তির এই প্রবণতা শুধু সময়ের অপচয়ই নয়, বরং শরীর, মন ও সামাজিক জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত গেম খেলার ফলে ঘুমের ব্যাঘাত, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, মাথাব্যথা, অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধির মতো নানাবিধ শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। মানসিকভাবে তৈরি হয় উদ্বেগ, অনিয়ন্ত্রিত রাগ এবং বিষণ্নতার মতো নানা জটিলতা। ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ এন্ড নিউরোসায়েন্সেস (ঘওগঐঅঘঝ) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গেম অ্যাডিক্টদের মধ্যে ৬২ শতাংশ মানসিক চাপ বা অবসাদে ভোগে এবং প্রায় ৪৫ শতাংশের মধ্যে আত্মঘাতী প্রবণতাও তৈরি হয়।

আরও পড়ুনঃ  জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব দাবি মেনে নিয়েছে সরকার

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৪ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ১২ শতাংশ কিশোর- কিশোরী সমস্যাজনক গেমিং (চৎড়নষবসধঃরপ এধসরহম) এর ঝুঁকিতে রয়েছে, যার মধ্যে ছেলেদের হার ১৬ শতাংশ এবং মেয়েদের ৭ শতাংশ। একই বছর ৬ লাখ ৪১ হাজার ৭৬৩ জন কিশোর- কিশোরীর উপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে এ ডিসঅর্ডারের প্রাদুর্ভাব শতকরা ৮ দশমিক ৬ ভাগ (গ্লোবাল মেটা অ্যানালাইসিস রিপোর্ট)। এ ধরনের আরও কিছু গবেষণার আলোকে বলা যায়, গড় হিসেবে প্রতি ১০ জন কিশোরের মধ্যে একজন এই সমস্যায় ভুগছে।
বাংলাদেশেও পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। ইন্টারনেট সেফটি ইনিশিয়েটিভ নামক একটি সংগঠনের ২০২৩ সালে বাংলাদেশে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ১২-১৮ বছর বয়সী কিশোরদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ প্রতিদিন গড়ে ৩ ঘণ্টার অধিক সময় মোবাইল গেমে ব্যয় করে।
কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, এই আসক্তির কারণে একটি পরিবার, এমনকি একটি সমাজের উপরও গভীর প্রভাব পড়ে। অভিভাবকরা যখন সন্তানকে সময় না দিয়ে বরং মোবাইল বা ট্যাব হাতে তুলে দিয়ে তাদের শান্ত রাখার চেষ্টা করেন, তখন নিজের অজান্তেই তারা একটি সম্ভাব্য আশঙ্কার বীজ বপন করেন। শিশুরা ভার্চুয়াল জগতে হারিয়ে যেতে থাকে, ফলে পরিবার ও বন্ধুদের থেকে দূরত্ব তৈরি হয়, সামাজিকতাবোধ গড়ে ওঠা ব্যাহত হয় সর্বোপরি বাস্তবজগত তাদের কাছে অর্থহীন মনে হয়।
ব্যাপকভাবে এ আসক্তি বৃদ্ধির কারণ প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে বেশিরভাগক্ষেত্রেই একাকীত্ব বা সামাজিক যোগাযোগের অভাব, মানসিক চাপ ভুলে থাকার চেষ্টা, অবসর কাটাতে সৃজনশীল বিনোদনের অভাব, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে গেম কনটেন্টের প্রভাব, অভিভাবকদের পর্যাপ্ত মনোযোগের অভাব, পারিবারিক কলহ প্রভৃতি কারণে এ সমস্যার উদ্রেক হয়ে থাকে। মনে রাখতে হবে, শিশুরা জন্ম থেকে গেমার হয়ে ওঠে না – আমরা নিজেরা, আমাদের পরিবেশ, আমাদের ভালোবাসার ভুল রূপ অথবা অবহেলা তাদের ওই পথে ঠেলে দেয়।
গেমিং ডিসঅর্ডার বা সমস্যাজনক গেমিং এর প্রধান লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে Ñ দিনে ৬ ঘণ্টার অধিক গেমে থাকা, গেম না খেলতে পারলে অনিয়ন্ত্রিত উদ্বেগ বা রাগান্বিত হয়ে পড়া, স্বাভাবিক কাজকর্ম ও সামাজিক মেলামেশায় অনাগ্রহ, পরিবার ও বন্ধুদের সাথে দূরত্ব তৈরি হওয়া, বারবার গেম খেলার নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করেও তা বজায় রাখতে না পারা।
এ সমস্যার সমাধানে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন পরিবারের সদস্যবৃন্দ। অভিভাবকদের উচিত সন্তানের সাথে নিয়মিত সময় কাটানো, একসঙ্গে খেলা বা গল্প করা এবং তাদেরকে মাঠে খেলতে ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে উৎসাহ দেয়া। প্রযুক্তি ব্যবহারে সীমা নির্ধারণ করা জরুরি। এক্ষেত্রে নিজেরা উদাহরণ হতে হবে। যদি বাবা-মা সারাদিন মোবাইলে ব্যস্ত থাকেন, সন্তানের কাছে ধীরে ধীরে এটিই স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। তাই পারিবারিকভাবে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
গেম খেলা আনন্দের জন্য- নেশার জন্য নয়। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে সচেতনভাবে নয়তো তা আমাদেরকেই ব্যবহার করবে। তাই প্রযুক্তির ব্যবহার হোক ইতিবাচক, বাস্তব জীবনের বিকল্প নয় বরং জীবনগঠনে সহায়ক।
লেখক: শারমিন জাহান স্মিতা,তথ্য অফিসার,পিআইডি রাজশাহী#

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময়ের কথা ২৪ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন somoyerkotha24news@gmail.com ঠিকানায়।