তরুণ কবি ময়নুল ইসলাম শাহ্ তাঁর ‘তারুণ্যের উৎসব ২০২৫’ কবিতায় লিখেছেন ‘নতুন চিন্তা, নতুন প্রেরণা, নতুন পথের গান, তারুণ্যের শক্তি আজ জাগাবে কোটি প্রাণ।’ বাস্তবিকই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তারুণ্যের মধ্যেই সর্বদা লুকায়িত সব বাধাবিপত্তি, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার উজ্জীবিত শক্তি। পৃথিবীর যত মহৎ কর্ম সাধিত হয়েছে, মুক্তির উদ্যম হাওয়া যত প্রান্তর বেয়ে প্রবাহিত হয়েছে তার প্রত্যেকটির পেছনে অসামান্য অবদান রয়েছে তরুণদের। তাই বলা হয়, ‘তারুণ্যেই শক্তি, তারুণ্যেই মুক্তি’। তারুণ্যের চোখে বিশ্বকে জয় করার ইতিহাস বারবার আমাদের তরুণদের অবদানকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ তারুণ্যে ভরপুর একটি দেশ।সভ্যতার ক্রমবিকাশের পথে তারুণ্যের এই শক্তির ইতিবাচক ভূমিকা সব সময়ই গুরুত্ব বহন করেছে। আমাদের জনগোষ্ঠীর বড় অংশই তরুণ ও যুবক। একই সঙ্গে শুধু সংখ্যাতেই নয়, সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। জুলাই গণঅভ্যুত্থান এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ২০২৪ এর ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বাপর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, ন্যায়ের পক্ষে জাগরণ, অন্যায়ের প্রতিবাদে তারুণ্যের শক্তি শুধু পরীক্ষিতই হয়নি, মুক্তির পথও বাতলে দিয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রে ।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সর্বদা তরুণদের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি বারেবারে উপদেশ দিই, পুরোনোদের বাদ দাও। পুরোনোদের চিন্তা দিয়ে কিছু হবে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো দুনিয়ার কথা বলছি। তোমাদের মধ্যে যে শক্তি আছে, সৃজনশীলতা আছে, সেটাকে কাজে লাগাতে হবে।’চুরাশিতেও টগবগে তারুণ্যে ভরপুর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখনও প্রাণবন্ত, কর্মমুখর। বয়সের ভারে ন্যুব্জ না হয়ে বরং তিনি তারুণ্যকে অবগাহন করেছেন। তারুণ্যের শক্তিতে বিশ্বাসী বলেই এখনো তিনি নিজেই একজন টগবগে তরুণ।তাঁর কর্মযজ্ঞে তরুণদের প্রতি রয়েছে এক ধরনের নির্ভরতা ও বিশ্বাস। তিনি বিশ্বাস করেন তরুণরাই পারে এবং তরুণরাই পারবে। আর এ কারণেই তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্ব তারুণ্যের কণ্ঠস্বর। কারণ তিনি তরুণদের ভাষা পড়তে পারেন, বুঝতে পারেন এবং তাঁদের চিন্তাকে মূল্যায়ন করেন।
প্রচলিত ঘুণে ধরা ব্যবস্থা, দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতায় গড়ে ওঠা সমাজকে বদলাতে হবে। এ জঞ্জাল সমাজ পরিষ্কার করতে পারে একমাত্র সমাজ সচেতন তরুণরাই। কারণ তাঁরা সৃজনশীল, তাঁরা নতুন ভাবনা ভাবতে পারে, তাঁরা বৃত্তের বাইরে গিয়ে নতুন কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে এবং তা বাস্তবায়নও করতে পারে। চীন, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় আমাদের তুলনায় তরুণসমাজ খুব কম। প্রাকৃতিক সম্পদ এবং মাটির উর্বরতাও সীমাবদ্ধ। সেসব দেশের যুবকেরা তাঁদের সৃজনশীলতা দিয়ে এই অল্প সম্পদকে পরিণত করেছে বিশাল সম্পদে। আর এজন্যই জাতির উন্নতি, অগ্রগতিতে প্রয়োজন উপর্যুক্ত তরুণসমাজ। যারা সমাজ ও দেশের কল্যাণে অবদান রাখবে। দেশের যাবতীয় সম্পদকে উর্বর করবে। রাষ্ট্রীয় সংহতি, বিকাশে পাহারাদার হবে। জনগণের কল্যাণে তারা অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। মানবতা রক্ষার্থে অকাতরে জীবন চালিয়ে দেবে। হাসিমুখে যন্ত্রণা লাঘব করবে।
আগামীর বাংলাদেশের সমাজ হবে জ্ঞান ও তথ্যভিত্তিক। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরিতে এগিয়ে আসতে হবে তরুণদের। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। সমতার ভিত্তিতে একটি প্রগতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের দেশকে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আগামীর বাংলাদেশ হবে সবার জন্য নিরাপদ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মাথায় রেখে দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্যহীন দেশ গড়ে তুলতে হবে। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে।যুবকদের প্রযুক্তিতে দক্ষ করে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনকে বিবেচনায় রেখে পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। আগামীর বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে শান্তি ও সম্প্রীতির বাংলাদেশে। আগামীর বাংলাদেশ হবে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ,যেখানে থাকবে না কোনো অসাম্য ও বৈষম্য, প্রত্যেক মানুষ তার মৌলিক অধিকার তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ পাবে।
বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি বড় চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি দমন। স্বাধীনতার এতোগুলো বছর অতিবাহিত হলেও দেশে এখন পর্যন্ত দুর্নীতি ও অনিয়মের চর্চা রোধ করা যায়নি। বিভিন্ন সময়ে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও সত্যিকার অর্থে তেমন কোন কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। দুর্নীতি দমন কমিশনকে কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকার্যের ধীরগতি ও দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ নতুন নয়।এটাও বন্ধ করতে হবে। এটা রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব না হলেও কাজ শুরু করা দরকার। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে চলমান শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ও মানোন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। বিশেষত, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, টিকাদান কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রসারের মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনেক দূর এগিয়েছে। তবে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, বিশেষত চিকিৎসা ব্যয়,যা ইতিমধ্যে সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে । বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রধানত সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিভক্ত। সরকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে । তবে এসব প্রতিষ্ঠানে সবসময়ই চিকিৎসকের স্বল্পতা, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও সরঞ্জামের অভাব থাকে। শহরাঞ্চলে উন্নতমানের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থাকলেও তা ব্যয়বহুল হওয়ায় সাধারণ জনগণের পক্ষে এ সুবিধা প্রায়শই গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। ওষুধের উচ্চমূল্য যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা সব সময় নিশ্চিত করা যায় না। । বর্তমানে দেশের বেশির ভাগ মানুষ কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিমার আওতায় নেই, যা চিকিৎসা ব্যয় বহনে তাদের জন্য বড় বাধা সৃষ্টি করে।সবার জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু করার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা দরকার।
দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে বাড়াতে হবে বৈদেশিক বাণিজ্য। বাংলাদেশকে করতে হবে বাণিজ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বৈদেশিক আমদানি কমিয়ে গড়ে তুলতে হবে রপ্তানিনির্ভর দেশ। দেশের অর্থনীতিকে করতে হবে শক্তিশালী। দেশের আর্থিক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সমস্যাগুলো অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিবেচনা করে সমাধান করতে হবে। জনশক্তি রফতানির জন্য কারিগরি দক্ষতা বাড়াতে হবে। বিশ্ববাজারে দক্ষ শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদা, সেটার সুযোগ নিতে হবে। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তন এনেছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা, নারীর ক্ষমতায়ন, উন্নত পুষ্টি এবং ঋণগ্রহীতার সন্তানদের উন্নত শিক্ষার ব্যবস্থা করা। দারিদ্র্যপীড়িত এবং নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য অনেক সুবিধা তৈরি করে দেশের আর্থসামাজিক ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে ক্ষুদ্রঋণ । পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন, নারী উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান তৈরি, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ এবং পুঁজি বিনিয়োগে সুবিধাসহ দেশের অর্থনীতির সূচককে ত্বরান্বিত করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনের মহান দায়িত্ব তরুণদেরই বহন করতে হবে। সমাজের অনগ্রসর ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তরুণ প্রজন্ম সম্মিলিতভাবে পৃথিবীকে বদলে দেবে। তারা সরকারের অপেক্ষায় বসে থাকবে না। সেই নতুন বিশ্ব গড়তে এখন থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশের কাছে বিশ্বকে বদলে দেওয়ার মতো দুর্দান্ত সব আইডিয়া আছে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সারিতে অপেক্ষমাণ বাংলাদেশ। টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ এবং কল্যাণকর রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তরুণদের কার্যকর ভূমিকা রাখার এখনই সময়।
লেখক: ইমদাদ ইসলাম
জনসংযোগ কর্মকর্তা, খাদ্য মন্ত্রণালয়
পিআইডি ফিচার