“কত অজানারে জানাইলে তুমি কত ঘরে দিলে ঠাঁই/ দূরকে করিলে নিকট বন্ধু পরকে করিলে ভাই।“
কবিগুরুর এই পংক্তি আর যাই করুক রেলের অগ্রযাত্রাকে চিত্রিত করেছে দারুণ ভাবে। ১৮২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। এই দিনে ইংল্যান্ডের ছোট্ট শহর ডার্লিংটনে জর্জ স্টিফেনসনের তৈরি লোকোমোশন-১ নামক বাষ্পচালিত রেলগাড়ি স্টকটন ও ডার্লিংটনের মধ্যে কয়লাবাহী ও যাত্রীবাহী ক্যারেজ নিয়ে যাত্রা করেছিলো। সেদিনের সেই সাদামাটা প্রযুক্তি আজ বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি, মানুষের জীবনযাত্রা, এক কথায় বর্তমান সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিতে পরিণত হয়েছে। রেল যোগাযোগ আজ সভ্যতার মেরুদণ্ড বললেও অত্যুক্তি হবে না বোধ করি। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ছিলো রেলওয়ের ইতিহাসে দুইশো বছর পূর্তির মাইলফলক। বিশ্বব্যাপী দিনটি উদ্যাপিত হয়েছে সাড়ম্বরে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে রেলযাত্রীদের নিকট দিনটি ছিলো আবেগঘন ও স্মরণীয় মুহূর্ত। বাংলাদেশে দিবসটি উদ্যাপনে কোনো আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান চোখে পড়েনি কিন্তু লক্ষ লক্ষ রেলযাত্রী ও পঁচিশ হাজারেরও বেশি রেলকর্মীর নিকট দিনটির গুরুত্ব ছিলো অন্যরকম। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর অনুভূতির মিশ্রণে দিনটি সবার মানসপটে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা, যদিও তার বহিঃপ্রকাশ তেমন একটা ঘটেনি। সাধারণ যাত্রীদের হাজারো অভিযোগ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার ধারাবাহিক দুর্নাম এবং পশ্চাৎপদ প্রযুক্তি ও সীমাবদ্ধ সেবা নিয়ে রেলকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে রেলকে সচল রাখার। পর্দার অন্তরালে তাদের সেই অক্লান্ত প্রচেষ্টার মতো রেলওয়ের দুইশো বছর পূর্তির অনুষ্ঠান উদ্যাপনের আকাঙ্ক্ষাও তেমনি অন্তরালেই রয়ে গেছে।
আঠারো শতকে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ব্যাপকভাবে। এসব পণ্য পরিবহণ ও স্থানান্তরের জন্য পরিবহন ব্যবস্থায় সংকট দেখা দেয়। বিশেষ করে ঘোড়ায় টানা গাড়ি ও নৌপথ কিংবা সড়ক পথে এত বেশী পরিমাণ পণ্য পরিবহন দুষ্কর হয়ে পড়ে। তাছাড়া কাঙ্ক্ষিত স্থানে নৌপথ না থাকা, প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে স্থলপথে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে জটিলতা, অপ্রতুল যানবাহন ইত্যাদি কারণে এ সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করে। এ প্রেক্ষাপটে স্টিফেনসনের রেল প্রযুক্তি দ্রুত বাণিজ্যিক রূপ লাভ করে এবং তা দ্রুত সম্প্রসারিত ও বিস্তৃত হতে থাকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে রেল যোগাযোগ হয়ে উঠে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে স্থাপন করা হয় রেললাইন, লোকোমোটিভের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি পায় বহুগুণ। ১৮৩০ সালে লিভারপুল ও ম্যানচেষ্টারের মধ্যে স্থাপন করা হয় রেলওয়ে, ১৮৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র চালু করে ট্রান্স কন্টিনেন্টাল রেলওয়ে, ১৮৯১-১৯১৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) চালু করে ৯২৮৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে। পর্যায়ক্রমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দুর্গম এলাকাসমূহে চালু হতে থাকে রেলপথ। মানুষের যোগাযোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে। দুর্গম বলে আর কোনো এলাকা অবশিষ্ট থাকে না। স্বল্প সময়ে দূর-দূরান্ত থেকে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে রেলওয়ে সভ্যতার বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণের সময় কমে বিশ্ব হয়ে উঠতে থাকে আজকের গ্লোবাল ভিলেজ।
ভারতীয় উপমহাদেশে রেলের যাত্রা শুরু হয় ১৮৫৩ সালে মহারাষ্ট্রের দুই শহর বোম্বে থেকে থানে পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপনের মাধ্যম। উপমহাদেশে রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিলো মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থ রক্ষা। এ দেশে রেলের যাত্রা শুরু হয় ১৮৬২ সালে যখন কলকাতার-রানাঘাট হয়ে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেল চালু হয়। বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এর বিস্তৃতি হয় দর্শনা থেকে জগতি পর্যন্ত। পরবর্তীতে এই রেললাইন রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিস্তৃত হতে থাকে। এসব রেললাইন স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো এ দেশে উৎপাদিত শিল্পের কাঁচামাল বিশেষ করে পাট, চা, কয়লা, কাঠ ইত্যাদি চট্টগ্রাম ও কলকাতা বন্দরের মাধ্যমে দ্রুত ব্রিটেনে পাঠানো, বিদ্রোহ দমনের জন্য সামরিক সরঞ্জাম ও সৈন্য স্থানান্তর, সাম্রাজ্যের ভিত্তি শক্তিশালী করার জন্য রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ইত্যাদি। উপমহাদেশে রেললাইন স্থাপনের উদ্দেশ্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার স্বার্থ রক্ষা হলেও এতদঞ্চলের মানুষ এর কিছু কিছু সুফল ভোগ করতে পেরেছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষ প্রথমবারের মতো শহরে যাতায়াত করতে পেরেছে, কৃষিপণ্য দ্রুত বাজারজাত করা সম্ভব হয়েছে, নতুন ধরনের কর্মসংস্থান শুরু হয়েছে ইত্যাদি। কিন্তু রেল যোগাযোগ এতদঞ্চলে স্থানীয় উন্নয়নের পরিবর্তে শোষণের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার হয়েছে অধিক মাত্রায়।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) রেল যোগাযোগ ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অল্প কিছু দিনের মধ্যে সীমিত অবকাঠামো, স্বল্প জনবল, অপর্যাপ্ত কোচ ও ইঞ্জিন নিয়ে চালু হয় ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের আগে পর্যন্ত ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে পূর্ণ সক্ষমতা নিয়ে তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। উপরন্তু, মুক্তিযুদ্ধকালে রেল অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে পাক হানাদার বাহিনীর রসদ পরিবহনে ব্যবহৃত রেল নেটওয়ার্কর বিদ্যমান বিপুল সংখ্যক সেতু ধ্বংস করে। স্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেয়, রেললাইন উপড়ে ফেলে, মালবাহী ক্যারেজ, ওয়াগন পুড়িয়ে দেয়, এক কথায় যুদ্ধকালীন সময়ে রেল যোগাযোগ অবকাঠামো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত রেল অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, জনবল সংকট মোকাবিলা, পর্যাপ্ত কোচ, ওয়াগন ও লোকোমোটিভ সংগ্রহ সর্বোপরি পর্যাপ্ত তহবিল সঙ্কটের চ্যালেঞ্জ নিয়ে যাত্রা করে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে উত্তরোত্তর উন্নতি ও সম্প্রসারণ ঘটেছে বাংলাদেশ রেলওয়ের। ১৯৪৭ সালের পূর্বে ভারতবর্ষে রেলওয়ে পরিচালিত হতো তৎকালীন রেলওয়ে বোর্ডের মাধ্যমে। ১৯৭৩ সালে রেলওয়ে বোর্ড বিলুপ্ত করে একে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সাথে সংযুক্ত করা হয়। ১৯৮২ সালে গঠন করা হয় রেলপথ বিভাগ যার সচিব ডিজি-কাম-সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। ১৯৯৫ সালে গঠন কর হয় বাংলাদেশ রেলওয়ে অথরিটি (বিআরএ)। পরবর্তীতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে রেলপথ বিভাগ এবং ৪ ডিসেম্বর ২০১১ সালে পৃথকভাবে রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে রেলওয়ের প্রশাসনিক সংস্কারের পাশাপাশি নতুন নতুন ট্র্যাক নির্মাণ, সেতু নির্মাণ, ট্র্যাক ও সেতু পুনর্বাসন, লোকোমোটিভ ও কোচ সংগ্রহ, মালবাহী ওয়াগন ও ক্যারেজ সংগ্রহের মাধ্যমে রেলের যাত্রী ও পণ্য পরিবহন সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ।
বর্তমানে সারাদেশে প্রতিদিন আড়াই লাখেরও বেশি যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের। পুরাতন ও নিম্নগতির মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজ এবং নতুন স্থাপিত ট্র্যাকসমূহে ব্রডগেজ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। বর্তমানে সারাদেশে সচল রেলরুটের দৈর্ঘ্য ৩৪৯৩.৫৪ কিলোমিটার। এছারা আরও ৬১.৬০ কিলোমিটার মিটারগেজ রেল লাইন অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। দেশে ১৫৬টি মিটারগেজ ও ১৩২টি ব্রডগেজ, মোট ২৮৮টি লোকোমোটিভ রয়েছে। অপরদিকে ক্যারেজ রয়েছে ১৮৩৮টি, এর মধ্যে মিটারগেজ ১২৬৭টি ও ব্রডগেজ ৫৭১টি। এছারা পণ্যবাহী ওয়াগন রয়েছে ৩৭৪১টি তন্মধ্যে ওয়াগন ৩৬১৬টি, লাগেজভ্যান ১২৫টি। আন্তঃনগর, মেইল, কমিউটার ও লোকাল সব মিলিয়ে প্রতিদিন রেলপথে যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা প্রায় ২ লাখ। সংখ্যা ও বিস্তৃতি বিবেচনায় রেলপথ সড়ক থেকে পিছিয়ে থাকলেও জনপ্রিয়তায় রেল এক নম্বরে রয়েছে।
ভবিষ্যতে সকল রেল ট্র্যাক ব্রডগেজে রূপান্তরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের। প্রতিবছর উত্তরোত্তর বাড়ানো হচ্ছে রেলওয়ের বরাদ্দ এবং এ খাতে বিনিয়োগ। যাত্রী পরিবহনে সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। বর্তমানে ট্রেনের শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে মানুষ ঘরে বসেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের টিকিট সংগ্রহ করতে পারছে অনায়াসে। পুরাতন স্টেশনসমূহকে সংস্কার করে আধুনিক স্টেশন ও বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হয়েছে। স্টেশনসমূহে নাগরিক সুবিধা সম্প্রসারিত করা হয়েছে। স্টেশনসমূহে আধুনিক শৌচাগার, ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের মতো নাগরিক বান্ধব সেবা চালু করা হয়েছে। স্টেশনে ও ট্রেনের ভেতর ধূমপান, তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার করা হয়েছে নিষিদ্ধ।
সকল ট্রেনের ডিজিটাল ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করা হয়েছে। ফলে মানুষ ঘরে বসে ইন্টারনেট ব্যবহার করে যেকোনো ট্রেনের তাৎক্ষণিক লোকেশন ও পরবর্তী গন্তব্য স্টেশন সম্পর্কে জানতে পারছে। রেল ট্র্যাক সংস্কার ও পুনর্বাসন-এর ফলে লোড ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি পেয়েছে। উচ্চ গতির আধুনিক লোকোমোটিভ সংযোজনের ফলে ট্রেনের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে যাত্রীদের আরামদায়ক ভ্রমণ নিশ্চিত হয়েছে এবং যাত্রার সময় হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে রেলখাতে যথেষ্ট সংস্কার ও উন্নয়ন হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে উন্নয়ন ও সংস্কারের সুযোগ রয়েছে আরো অনেক। প্রতিষ্ঠার দুইশ বছরে রেল যোগাযোগ উন্নত বিশ্বে বিপ্লব সাধন করেছে। চীনের বেইজিং ও হেবেই প্রদেশের ঝ্যাংজিয়াকুককে সংযুক্তকারী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চালিত ট্রেন ঘণ্টায় ৩৫০ কিলোমিটারেরও বেশি গতিতে ছুটতে সক্ষম। চীন বর্তমানে ম্যাগনেটিক লেভিয়েশন (ম্যাগলেভ) নামক নতুন এক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য কাজ করছে যা যাত্রীদের ঘণ্টায় ৬২০ কিলোমিটারেরও বেশি গতিতে ভ্রমণের সুযোগ করে দেবে। জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ লোকোমোটিভ শিল্পে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। কিন্তু ব্যাপক চাহিদা সত্ত্বেও রেলখাতে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নয়। লোকোমোটিভ শিল্প এ দেশে এখনো সম্পূর্ণই আমদানি নির্ভর রয়েছে। রেলের ইঞ্জিন, কোচ ও ট্র্যাক সংশ্লিষ্ট কোনো নির্মাণ কাজই এ দেশে বিকশিত হয়নি। এক্ষেত্রে দক্ষ জনবলেরও অভাব রয়েছে। তাছাড়া পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশ রেলওয়ে পিছিয়ে থাকায় এখনো পর্যন্ত রেল একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে রয়ে গেছে।
দেশের মোট পণ্য পরিবহনের মাত্র ৪-৫ শতাংশ পরিবহন হয় রেলপথে। অথচ এর পরিমাণ ২০-২৫ শতাংশ হলে রেলওয়ে তার লোকসান কাটিয়ে উঠে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারতো।
উন্নত বিশ্বে যেখানে মোট পণ্যের ৫০-৬০ শতাংশ রেলপথে পরিবহন করা হয় সেখানে বাংলাদেশে রেলপথে ৪-৫ শতাংশ পণ্য পরিবহন এ খাতে পশ্চাৎপদতারই প্রমাণ বহন করে। অথচ রেলপথে পণ্য পরিবহন খরচ সড়ক ও আকাশপথের তুলনায় অনেক কম। এ দেশে মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অন্যতম একটি কারণ উচ্চ পরিবহন খরচ। রেলপথে পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে পরিবহন ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব যা দেশের মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনে সক্ষম।
এছাড়া লোকোমোটিভ শিল্পে আমদানি নির্ভরতা হ্রাস করে স্থানীয়ভাবে সংযোজন ও উৎপাদন কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যেতে পারে। এতে উচ্চমূল্যে রেলওয়ে যন্ত্রাংশ আমদানি হ্রাসের মাধ্যমে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। পার্বতীপুরের কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা (কোলোকা) সীমিত পরিসরে রেলওয়ে যন্ত্রাংশ মেরামতের মাধ্যমে রেলকে সচল রাখতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কেলোকার সক্ষমতা ও কার্যপরিধি বৃদ্ধি করে একে আধুনিক একটি লোকোমোটিভ কারখানায় রূপান্তর করা সম্ভব।
চট্টগ্রামের রেলওয়ে প্রশিক্ষণ একাডেমির আধুনিকায়নের মাধ্যমে রেলওয়ের জন্য দক্ষ জনবল তৈরি করা সম্ভব। সর্বোপরি রেলওয়ে যন্ত্রাংশ, লোকোমোটিভ, কোচ ও ট্র্যাক সম্পর্কিত যন্ত্রাংশের আমদানি নির্ভরতা হ্রাস করে নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। সেই সাথে ট্রেন পরিচালনা ও সিগন্যাল সিস্টেমের আধুনিকায়ন ও পরনির্ভরশীলতা হ্রাস করা অপরিহার্য।
১৮২৫ থেকে ২০২৫, দুইশো বছরে রেলওয়ের উন্নতি হয়েছে আকাশচুম্বী। কয়লাচালিত স্টিম ইঞ্জিন থেকে আজ ইলেকট্রোম্যাগনেটিক প্রযুক্তি রেলকে করেছে সমৃদ্ধ। ঘণ্টায় ১০-২০ কিলোমিটার গতি থেকে আজ ৫০০-৬০০ কিলোমিটার গতিতে চলছে ট্রেন। যাত্রীদের আরাম আয়েশের সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণের জন্য রেলওয়েতে সংযোজিত হচ্ছে নিত্যনতুন প্রযুক্তি। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই প্রতিযোগিতায় অংশীদার হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিন্তু নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা না থাকায় আমদানি নির্ভরতা, দক্ষ জনবলের অভাবে পরনির্ভরশীলতা ও পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে বাংলাদেশ রেলওয়ে বিশ্বের উন্নত ও অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে অনেক। এই পশ্চাৎপদতা ও পরনির্ভরশীলতা অতিক্রম করে রেলওয়ে হয়ে উঠবে স্বাবলম্বী, স্বনির্ভর ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান, রেলের দুইশো বছর পূর্তিতে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: রেজাউল করিম সিদ্দিকী
সিনিয়র তথ্য অফিসার, রেলপথ মন্ত্রণালয়
পিআইডি ফিচার

