অনলাইন ডেস্ক : নির্বাচনী এলাকার সীমানা সংক্রান্ত আপিল শুনানিতে রবিবার নির্বাচন কমিশনের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনের শুনানি চলাকালে বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা গ্রুপের সঙ্গে বিএনপির অপর গ্রুপ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের মধ্যে পৃথক হট্টগোল ও মারামারির ঘটনা ঘটে।
ইসির সামনে এ ঘটনায় এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতা আতাউল্লাহসহ তিনজন আহত হন। বিএনপির নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হন রুমিন ফারহানা। শুনানিস্থলে গণমাধ্যমকে প্রবেশ করতে না দেওয়ায় প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছে তা নিয়ে ধূ¤্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। ইসির হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলেও পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ করেন সব পক্ষই।
সংবাদ সম্মেলন করে রুমিন ফারহানার গ্রেপ্তার দাবি করেছেন এনসিপি নেতারা। রুমিন ফারহানা বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের জন্য গত ১৫ বছর লড়াই করলাম তারা আমাকে এখন ধাক্কা দেয়, ঠিক আছে ধাক্কার বদলে তো ধাক্কা আসবেই।
শুনানির প্রথম দিনে কমিশন ৮১১ আবেদনের শুনানি সম্পন্ন করেছে। সিইসি এএমএম নাসির উদ্দিন বলেন, আমরা নিরপেক্ষভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৩ আসনের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে শুনানিতে অংশ নেন বিএনপির আলোচিত নেত্রী ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। সেখানে তিনি ইসির খসড়া সীমানার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। এ সময় বিএনপির একটি পক্ষ প্রতিবাদ করলে সেখানে হট্টগোল ও মারামারির ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে বিপক্ষের লোকজন রুমিন ফারহানাকে ধাক্কা দেয় বলে তিনি নিজেই দাবি করেছেন।
এ সময় এনসিপি নেতাকর্মীদের সঙ্গেও পৃথক সংঘর্ষ হয় রুমিন ফারহানার সমর্থকদের। এতে এনসিপির তিনজন আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে দলটি। তারা হলেন- এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতা আতাউল্লাহ, প্রকৌশলী আমিনুল হক চৌধুরী ও মুস্তফা সুমন।
১৫ বছরে যা হয়নি, আজ সেটিই হলো- রুমিন ॥ বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে রুমিন ফারহানা বলেন, গত ১৫ বছর যাদের জন্য লড়াই করেছি সেই বিএনপির নেতাকর্মীরাই ধাক্কা দিয়ে আমাকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করল। যেই বিএনপির নেতাকর্মীদের জন্য গত ১৫ বছর লড়াই করলাম তারা আমাকে এখন ধাক্কা দেয়, ঠিক আছে ধাক্কার বদলে তো ধাক্কা আসবেই।
তিনি বলেন, অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো এখানে একটি মারামারি হয়েছে। আশা করেছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে যিনি আছেন তিনি গু-া-পা-া নিয়ে ইসিতে ঢুকবেন না। কিন্তু তারা গু-া নিয়ে ইসিতে এসেছেন। এই আসনের প্রার্থী তার গু-া-পা-া সদলবল নিয়ে ইসিতে এসে মারামারি করেছেনÑ এটা খুবই লজ্জাজনক। এতে কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে।
রুমিন ফারহানা বলেন, আমরা সব সময় বলেছি ২০০৮ সালের আগের সীমানায় আমরা ফিরতে চাই। আমিও মনে করি ২০০৮ এর আগে যে সীমানা ছিল সেখানেই আমাদের এখন ফিরে যাওয়া উচিত। মাঝখানে ১৫ বছর একটা ফ্যাসিস্ট সরকার ছিল যারা তাদের নিজস্ব ভোট কারচুপির জন্য নিজস্ব সুবিধা অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ করেছে। সেই সীমানা আমরা মানি না। সে জন্য আমরা বলেছি ২০০৮ এর আগে যে সীমানা ছিল, খালেদা জিয়ার ইচ্ছা ছিল সেখানে যাওয়া হোক।
এনসিপি কর্মীদের সঙ্গে হাতাহাতি প্রসঙ্গে রুমিন ফারহানা বলেন, উনি যেহেতু পরিচিত মুখ নন, সুতরাং উনি জামায়াত না এনসিপি আমার জানা নেই। তবে ওনার লোকজন প্রথমে আমাকে ধাক্কা দিয়েছে। আমার লোকজন তো বসে থাকবে না, কারণ আমি একজন নারী। আমার লোকজনকে মারধর করেছে, তখন আমার লোকজন জবাব দিয়েছে।
এর আগে রবিবার দুপুর ১২টার দিকে নির্বাচন ভবনে শুনানির শুরুতে সিইসি এএমএম নাসির উদ্দিন বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণে আমরা পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি। আইন অনুযায়ী খসড়া সীমানা নিয়ে দাবি আপত্তির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আপনাদের আবেদনগুলো আমরা বিবেচনায় নিয়েছি। এখন শুনানিতে যৌক্তিক বিষয়গুলো তুলে ধরবেন। শুনানি উপলক্ষে নির্বাচন ভবনে নিরাপত্তা জোরদার করেছে সংস্থাটি। নিয়ম মেনে আবেদনকারীদের নির্বাচন ভবনে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে। চারদিন শুনানি শেষে ইসির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে। দাবি আপত্তি নিষ্পত্তি শেষে ৩০০ আসনের সংসদীয় সীমানা গেজেট প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ॥ এ আসনটি ২০২৪ সালে ছিল সরাইল ও আশুগঞ্জ নিয়ে। এবার করা হয়েছে সরাইল ও আশুগঞ্জ উপজেলা এবং বিজয়নগর উপজেলার বুধস্তি, চান্দুয়া ও হরষপুর ইউনিয়ন নিয়ে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ ॥ এ আসনটি ২০২৪ সালে ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও বিজয়নগর মিলে। এবার করা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর এবং বিজয়নগর উপজেলার ইছাপুর, চম্পানগর, পত্তন, দক্ষিণ সিঙ্গারবিল, বিষ্ণপুর, চর ইসলামপুর ও পাহাড়পুর ইউনিয়ন নিয়ে। ইসিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৩ আসনের খসড়া প্রকাশের পর পক্ষে-বিপক্ষে আবেদন জমা পড়ে।
রুমিন ফারহানা বিএনপির আওয়ামী বিষয়ক সম্পাদক- হাসনাত ॥ এদিকে রুমিন ফারহানাকে বিএনপির আওয়ামী বিষয়ক সম্পাদক আখ্যা দিয়ে জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, বিএনপির আওয়ামী লীগ বিষয়ক সম্পাদক যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে রুমিন ফারহানা একজন। তিনি শেখ হাসিনার কাছে ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন করেছিলেন। আমার মনে হয় হাসিনার পতনে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছেন তিনি। নির্বাচনে হু-া-গু-াগিরি করলে রুমিন ফারহানাকে ভারতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি।
নির্বাচন কমিশনের শুনানিতে মারামারির পর সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, আমরা বিএনপির আওয়ামী বিষয়ক সম্পাদকদের বলব, আপনারা জনগণের পালসকে বুঝুন, নতুবা আবার বাংলাদেশ সংকটের দিকে যাবে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই না বিএনপি গু-াতন্ত্র কায়েম করছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমানকে এখনো আমরা সম্বোধন করছি, সম্মান দেখাচ্ছি। কিন্তু তিনি যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন এবং রুমিন ফারহানা যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন আমরা ধরে নিচ্ছি বিএনপির হাইকমান্ডের ইনস্ট্র্রাকশনে এসব কথা বলছেন।
নির্বাচন কমিশনে রুমিন ফারহানার ভূমিকার তীব্র নিন্দা জানিয়ে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আজকের নির্বাচন কমিশনে যেই ঘটনা ঘটেছে সেই বিষয়ে বিএনপি কি অবস্থান নেয় সেটির প্রতি আমরা নজর রাখব। পুলিশ সদস্য যারা রয়েছেন আমরা আপনাদের প্রতি আবেদন জানাব আপনারা দয়া করে ক্ষমতামুখী হবেন না।
অবিলম্বে রুমিন ফারহানার গ্রেপ্তার দাবি করে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব জয়নুল আবেদীন শিশির বলেন, নির্বাচন কমিশন বারবার দাবি করছে তারা স্বাধীন। স্বাধীন এ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ শুনানিতে রুমিন ফারহানা সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছেন দাবি করে তিনি বলেন, কমিশন যদি স্বাধীনই হয় তবে রুমিন ফারহানাকে গ্রেপ্তার করে শাস্তির আওতায় আনা হোক। তা না হলে নির্বাচন কমিশন যে নিরপেক্ষ নয় সেটিই প্রমাণিত হবে।
৮১১ আবেদনের শুনানি সম্পন্ন ॥ সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে রবিবার প্রথম দিনে ১৮টি আসনের ৮১১টি আবেদনের শুনানি সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচন ভবনের অডিটরিয়ামে সিইসি নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ইসির প্রকাশিত খসড়ার বিপক্ষে ৪২৯টি এবং পক্ষে ৩৮২টি আবেদনের শুনানি হয়েছে। প্রথম দিনের শুনানি শেষে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জনসংযোগ পরিচালক মো. শরিফুল আলম সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
আজ খুলনা অঞ্চলের ৯৮টি, বরিশাল অঞ্চলের ৩৮১টি ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২০টি দাবি আপত্তির শুনানি হবে। আগামীকাল ২৬ আগস্ট ঢাকা অঞ্চলের ৩১৬টি দাবি-আপত্তির শুনানি হবে। রংপুরের সাতটি, রাজশাহীর ২৩২টি, ময়মনসিংহের তিনটি, ফরিদপুরে ১৮টি এবং সিলেট অঞ্চলের দুটি দাবি আপত্তির শুনানি হবে ২৭ আগস্ট।
গত ৩০ জুলাই ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে খসড়া প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। এতে ভোটার সংখ্যার সমতা আনতে গিয়ে গাজীপুর জেলায় একটি আসন বাড়িয়ে ছয়টি করা হয় এবং বাগেরহাটের আসন চারটি থেকে কমিয়ে তিনটির প্রস্তাব করা হয়।
সীমানায় পরিবর্তন আনা হয় মোট ৩৯টি আসনে। এগুলো হলোÑ পঞ্চগড়-১ ও ২; রংপুর-৩; সিরাজগঞ্জ-১ ও ২; সাতক্ষীরা-৩ ও ৪; শরীয়তপুর-২ ও ৩; ঢাকা-২, ৩, ৭, ১০, ১৪ ও ১৯; গাজীপুর-১, ২, ৩, ৫ ও ৬; নারায়ণগঞ্জ-৩, ৪ ও ৫; সিলেট-১ ও ৩; ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৩; কুমিল্লা-১, ২, ১০ ও ১১; নোয়াখালী-১, ২, ৪ ও ৫; চট্টগ্রাম-৭ ও ৮ এবং বাগেরহাট-২ ও ৩ আসন। ইসির প্রকাশিত ওই খসড়ার তালিকার ওপর গত ১০ আগস্ট পর্যন্ত আপত্তি আহ্বানও করা হয়। নির্ধারিত সময় গত ১০ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৮৩টি আসনের সীমানা নিয়ে এক হাজার ৭৬০টি দাবি-আপত্তি জমা পড়ে ইসিতে। এগুলো নিষ্পত্তি করে চূড়ান্ত সীমানা প্রকাশ করবে ইসি।
এর আগে বাগেরহাট-১ মোল্লারহাট-ফকিরহাট-চিতলমারী; বাগেরহাট-২ বাগেরহাট সদর এবং কচুয়া; বাগেরহাট-৩ রামপাল এবং মোংলা, বাগেরহাট-৪ মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা; এই চারটি আসন ছিল বাগেরহাটে। খসড়ায় বাগেরহাট-১ আসনে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। বাগেরহাট সদর, কচুয়া, রামপাল নিয়ে বাগেরহাট-২ আসন এবং মোংলা, মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলা নিয়ে বাগেরহাট-৩ আসন প্রস্তাব করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ৬৪ জেলার গড় ভোটার নির্ধারণ করা হয়েছে চার লাখ ২০ হাজার ৫০০। এটা ধরে জেলায় একটি আসন বাড়ালে তা গাজীপুরে হবে। এ গড়ের কম বাগেরহাটে একটি কমালে সমতা চলে আসে। দুই জেলার আসনই এফেক্টেড হয়েছে। আর কোথাও ঝামেলা নেই। ৩৯টি আসনে অ্যাডজাস্টমেন্ট রয়েছে।