পুড়ছে মাটি,পুড়ছে জীবন, কালো ধোঁয়ায় বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ, ক্রমেই উজাড় হচ্ছে বন, কৃষির ক্ষতি করে দেশের ভূপ্রকৃতিকে ধ্বংস করে কোনো প্রকার আইনের তোয়াক্কা না করেই মাটি পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট। এতে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, কমছে চাষাবাদের জমি ও গাছ।সবকিছু দেখেও সবাই অসহায়। প্রকৃতির এখন বড়ো সংকট। সংকট থেকে রক্ষা পেতে প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে।আর এ জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে,এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশ ও উন্নয়নের দ্বন্দ্বে সবখানে সবুজ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে, মানুষের হাতে প্রকৃতির নিধনযজ্ঞ চলছে। আমরাই ধ্বংস করছি আমাদের ভভিষ্যৎ।
রাজধানীর গাবতলী হয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ধরে মানিকগঞ্জের দিকে এগোলে সড়কের দুই পাশে শতাধিক ইটভাটা চোখে পড়ে। ফসলি জমি, আবাসিক এলাকা, নদীর পাড় ঘেঁষে এগুলো গড়ে উঠেছে। ইট ভাটার জন্য প্রয়োজন হয় সমতল ভূমি। যে সব জমিতে ইট ভাটা করা হয় সে সব জমিসহ আশপাশের জমিতে কোনো ফসল উৎপন্ন হয় না।পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সাভার ও ধামরাই উপজেলায় ২৮৪টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৬৭টিই অবৈধ। দেশে কম-বেশি ৮ হাজার ইটভাটা রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ শতাংশই অবৈধ। অবৈধ ইটভাটার মধ্যে ঢাকার আশপাশের ১২টি শহরে রয়েছে হাজারেরও বেশি । এসব ইটভাটায় বছরে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ ইট তৈরি হচ্ছে। এসব ইটভাটার জন্য বছরে ১৩ কোটি মেট্রিক টন মাটি লাগে। মূলত কৃষিজমির ওপরের উর্বর অংশ থেকে মাটি কেটে নিয়ে ইট তৈরি করা হয়। ইট তৈরিতে প্রায় ৫৬ লাখ মেট্রিক টন কয়লা ব্যবহৃত হয়। এসব ভাটায় উচ্চ মাত্রার সালফার ব্যবহার করা হয়। সালফারের পরিমাণ যাচাই না করে এসব ইটভাটায় কয়লা ব্যবহার করতে দেওয়ায় এমনটা ঘটছে। এ ছাড়া অনেক ভাটায় টায়ার, প্লাস্টিকও ব্যবহার হয়। এতেও অনেক কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি হচ্ছে। এর ফলে শুধু পরিবেশ নয় দেশে উর্বর কৃষি জমির মাটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং খাদ্য নিরাপত্তার উপর হুমকি সৃষ্টি করছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন,অবকাঠামো তৈরিসহ কর্মসংস্থান সৃজনে ইটভাটার অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। বিপুল জনগোষ্ঠীর এদেশে মানুষের বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সব সময়ই বিবেচনা করতে হয়। প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রোদে শুকানো বা আগুনে পোড়ানো ইট ব্যবহার হয়ে আসছে। যদিও ইট পাথরের মত দীর্ঘস্থায়ী এবং মজবুত নয়; তারপরও সহজলভ্যতা ও অল্প খরচের জন্য এর জনপ্রিয়তা এবং ব্যবহার সর্বাধিক। একটি ভাটা তৈরি করতে কম-বেশি ২ লাখ ৩২ হাজার বর্গফুট জায়গা লাগে। একবার ইটভাটা করলে ঐ জায়গায় আর চাষাবাদ করা যায় না। তাই ইটভাটা তৈরির জন্য বিশাল এলাকার আবাদি জমি ব্যবহার হয়। যার ফলে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। আবার ইটভাটায় সৃষ্ট তাপের কারণে ভাটার আশেপাশের অঞ্চলে ফসল উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। কৃষকেরা তাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম ফসল উৎপাদন করে। ফসলি জমিতে ইটভাটা তৈরি ও জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি দিয়ে ইট বানানোয় জমি উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা নিয়মের তোয়াক্কা না করে জমির উপরের স্তরের মাটি ইট তৈরিতে ব্যবহার করছে। এতে পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ মাটি ইট তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাধারণত মাটির পৃষ্ট থেকে গভীরে পুষ্টি উপাদান ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। ফলে ঐসব ফসলি জমিতে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ফসল উৎপাদন সম্ভব হয় না। এ ছাড়াও ইট প্রস্তুত খাত দেশের গ্রিনহাউস গ্যাসের সবচেয়ে বড়ো উৎস। এ খাতে বছরে ২২ লাখ টনেরও বেশি কয়লা ও ১৯ লাখ টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়, যা বছরে প্রায় ৯০ লাখ টন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে। যার প্রভাব দেশের বায়ুর ওপর পড়ছে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের পরিবেশ সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০২৩ অনুযায়ী, বৃহত্তর ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস ইটভাটা। ঢাকায় রান্নার চুলায় ব্যবহৃত জৈবসামগ্রী যেমন কাঠ, পাতা, গোবর ও জ্বালানি থেকে আসে বায়ুদূষণের ২৮ শতাংশ। এ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৪ শতাংশ, ইটভাটা থেকে ১৩ শতাংশ, রাস্তার ধুলা থেকে ১৩ শতাংশ, শহরের বর্জ্য পোড়ানো থেকে ১১ শতাংশ এবং যানবাহন থেকে ৫ শতাংশ দূষণ হয়। বাকি ৬ শতাংশ দূষণ অন্যান্য উৎস থেকে। বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে। এছাড়াও ইটভাটা সৃষ্ট দূষণের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা শহরের বস্তুকণা দ্বারা বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা ৫৮ শতাংশ দায়ী। এ ছাড়া সড়ক ও মাটি থেকে সৃষ্ট ধুলা দ্বারা ১৮ শতাংশ, যানবাহনের জন্য ১০ শতাংশ, বিভিন্ন জিনিসপত্র পোড়ানোর জন্য ৮ শতাংশ ও অন্যান্য কারণে ৬ শতাংশ বায়ু দূষিত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা বেশি আছে এমন মেগাসিটির তালিকায় ঢাকার অবস্থান তৃতীয়। এই তালিকায় প্রথম ও দ্বিতীয় হচ্ছে দিল্লি ও কায়রো । বায়ুদূষণের কারণে মানুষের শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে। হাঁপানি মতো রোগ দেখা দিচ্ছে ঘরে ঘরে। এছাড়াও ফুসফুসে বিভিন্ন রোগসহ ধুলাবালু থেকে অ্যালার্জি, চুলকানির মতো বিভিন্ন চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে।
বাংলাদেশে সাধারণত বছরের অক্টোবর থেকে মার্চ মাসকে ইট তৈরির জন্য উপযুক্ত সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইট ভাটার মালিকেরা কৃষকদের লোভ দেখিয়ে এককালীন কিছু টাকা দিয়ে চাষাবাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জমির উপরি অংশের মাটি কেটে নিয়ে যায় ইট তৈরির জন্য। ইট তৈরির জন্য কাঙ্ক্ষিত মাটি হলো দোআঁশ বালি, বেলে দোআঁশ বা বেলে কাদামাটি ।
ইট তৈরির জন্য প্রথমে কাদামাটি তৈরি করে সেটাকে ছাঁচে ফেলে কাঁচা ইট রি করা হয়। এরপর রোদে শুকিয়ে তারপর প্রায় ১১০০°C তাপমাত্রায় পোড়ানো হয়। একটি বড়ো ইটভাটায় একবারে কম-বেশি ৫ লাখ ইট পোড়াতে ২৩ – ২৪ দিন সময় লাগে। ফিক্সড চিমনি পদ্ধতিতে প্রতিটি ইট তৈরিতে ৪২৮ গ্রামের বেশি কার্বন-ডাইঅক্সাইড বায়ুমণ্ডলে যোগ হয় অর্থাৎ এক হাজার ইট উৎপাদনে প্রায় ৪২৮ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে যোগ হচ্ছে। যা পরিবেশ দূষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এছাড়াও ইট ভাটার প্রভাবে আশপাশে তুলনামূলকভাবে বৃষ্টিপাতও কমে গেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে চিমনি দিয়ে নির্গত কালো ধোঁয়া প্রবাহিত হওয়া। কালো ধোঁয়া এবং অধিক কার্বন-মনোক্সাইড গ্যাসের প্রভাবে আকাশে কোনো ধরনের মেঘ পুঞ্জীভূত হতে পারে না, বরং আকাশের মেঘটাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বৃষ্টিপাতে বিগ্ন ঘটায়।
সরকার ইট তৈরির অদক্ষ পদ্ধতি ব্যবহার না করে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর গুরুত্বারোপ করছে। পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনে সনাতন পদ্ধতিতে ইট উৎপাদন বন্ধ করে আধুনিক পদ্ধতিতে ইট উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই।ইটের পরিবর্তে ব্লক ইট ব্যবহারে সকলকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য চেষ্টা চলছে। দেশে দেড়’শরও বেশি ব্লক ইটের কারখানা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে হয়েছে ৮৮টি কারখানা। এসব কারখানা দেশের মোট ইটের চাহিদার ৫ শতাংশও মেটাতে পারছে না। দেশের সুনামগঞ্জ, ছাতক, দিনাজপুর ও নেত্রকোণা থেকে এবং ভারত ও ওমান থেকে আমদানিকৃত বালি ও পাথর পে-লোডারের মাধ্যমে দেয়া হয় হুপারে। এর সঙ্গে মেশানো হয় সিমেন্ট। স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেশিনের মাধ্যমে বিভিন্ন অনুপাত অনুযায়ী মেশানোর পর হাইড্রোলিক প্রেশারের মাধ্যমে বিভিন্ন ডাইসে আকারে তৈরি হয় ব্লক ইট। এগুলো ব্যয়-সাশ্রায়ী, টেকসই ও মজবুত।
পৃথিবীজুড়ে পরিবেশ ও উন্নয়নের দ্বন্দ্বে সবুজ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে, মানুষের হাতে প্রকৃতির নিধনযজ্ঞ চলছে। উন্নত বিশ্বে বর্তমানে অবকাঠামো নির্মাণে পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদেরও অবকাঠামো নির্মাণে পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের ইটভাটাগুলোকে ইট কারখানায় রূপান্তরিত করতে হবে। এ ধরনের উন্নত প্রযুক্তির কারখানার নাম ‘ইকো ব্রিকফিল্ড’।ইকো ব্রিকফিল্ডে ইট তৈরিতে ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় না, ফলে কার্বনের ঝুঁকি নেই বললেই চলে এবং মাটি সাশ্রয় হয় ৭০ ভাগ, খরচও কম। এতে কাঁচা ইট তৈরির ঝামেলা নেই । এর ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস এবং বায়ু দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাবে দেশ। অনিয়ন্ত্রিত দূষণ থেকে বাঁচবে মানুষের জীবন , পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পাবে এবং প্রকৃতি ফুলে-ফসলে, বৃক্ষে লতায় সুশোভিত থেকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের জীবন রক্ষা পাবে।
লেখক:ইমদাদ ইসলাম
জনসংযোগ কর্মকর্তা, খাদ্য মন্ত্রণালয়
পিআইডি ফিচার