পিন্টু আলী (চারঘাট) রাজশাহী: দখল ও দূষণে অস্তিত্ব হারিয়ে বিলীন হবার পথে পদ্মা ও যমুনার সংযোগ রক্ষাকারী বড়াল নদী। মরা বড়াল নামেই এই নদীটি এখন বেশি পরিচিত। যে নদীর উৎসমুখ পদ্মা-বড়ালের মোহনা হতে পারতো একটি বিনোদন কেন্দ্র, সেখানে এখন পা ফেলার জায়গা নেই সর্বত্র উৎকট গন্ধ। মানচিত্রে বিশাল আয়তন থাকলেও দুই তীর দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসিক ভবন, মার্কেট, গণশৌচাগারসহ নানা স্থাপনা।
২০০৫ সাল থেকে কয়েক দফা অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ তালিকা করা হলেও রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন কারণে দীর্ঘ প্রায় দুই দশকেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন দখলদার। এ অবস্থায় উৎসমুখেই বড়াল অস্তিত্ব হারিয়ে পানিশূন্য হতে চলেছে নাটোরের চলনবিলসহ রাজশাহী, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের সাত উপজেলার খাল-বিলসহ জলাধারগুলো। বড়াল বাঁচাতে ২২০ কিলোমিটার মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী চালিয়ে আসছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।
তারই ধারাবাহিকতায় গত ১৯ মে বড়াল নদীর উৎসমুখ পরিদর্শনে আসেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি জানান, বড়ালের পানিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে সরকার সমন্বিত পদক্ষেপ নিচ্ছে। বড়ালের সংকুচিত স্থানগুলো খনন ও উৎসমুখের স্লুইসগেট অপসারণ করে স্বাভাবিক পানি চলাচল নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি নদী দখলমুক্ত করা হবে বলে জানান তিনি।
উপদেষ্টার ঘোষণার এক মাসের মধ্যেই চারঘাট স্লুইসগেটের রেগুলেটর কপাট অপসারণ করে নিয়ে গেছে রাজশাহী পাউবো। পদ্মা নদীর বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণ করতে ১৯৮৪ সালে রেগুলেটরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে বড়াল পানিশূন্য হবার অন্যতম কারণ হিসাবে রেগুলেটর স্থাপনকে দায়ী করা হয়। তবে রেগুলেটর অপসারণ হয়েছে কিন্তু নদী দখলদারদের তালিকা হালনাগাদ হলেও সে অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যক্রম নেই পাউবোর।
চারঘাট উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, গত মার্চ মাসে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের নদ-নদী দখলদারদের হালনাগাদ তথ্য চেয়েছিল। সে নির্দেশনা অনুযায়ী চারঘাটের বড়ালের উৎসমুখের বড়াল নদী দখলদার ১০১ জনের তালিকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মাধ্যমে মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে।
তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চারঘাট স্লুইসগেট এলাকায় ২৪ জন, সরদহ এলাকায় ৩ জন, বাটিকামারী এলাকায় ২২ জন ও সবচেয়ে বেশী আড়ানী বড়াল ব্রীজ সংলগ্ন রামচন্দ্রপুর এলাকায় ৫২ জন নদী দখলদার রয়েছেন। কিন্তু নদী দখল করে একের পর এক স্থাপনা নির্মাণ করলেও দখলদারের তালিকায় চারঘাট পৌরসভা ও নদীতে বৃক্ষ রোপণ করলেও বন বিভাগের নাম নেই।
উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ সালে বড়াল নদীর দুই পাড়ের ৬৮ জন অবৈধ দখলদারের তালিকা করা হয়। ২০০৮ সালে সেই তালিকা হালনাগাদ করে ১১৩ জন দখলকারীর তালিকা হয়। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে আবারও সরেজমিন তদন্ত করে ৫৬ জন বড়াল দখলকারীর তালিকা হালনাগাদ করা হয়। সর্বেশেষ তালিকায় ১০১ জনকে দখলদার বলা হয়েছে। প্রতিবার তালিকা হালনাগাদ করার কর তাদের উচ্ছেদের জন্য বিগত ২০ বছরে কয়েক দফা নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) প্রধান করে উচ্ছেদ কমিটিও গঠন করা হয়েছিল, কিন্তু রাজনৈতিক চাপে শেষ পর্যন্ত উচ্ছেদ সম্ভব হয়নি।
স্থানীয় বড়াল রক্ষা আন্দোলন ও পরিবেশকর্মীরা বলছেন, বড়াল দখলের তালিকায় ১০১ জন দেখানো হলেও বাস্তবে দখলদারের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম তালিকায় যুক্ত করা হয়নি। তালিকার ১০১ জন দখলকারীর মধ্যে ৫২ জনই আড়ানী রামচন্দ্রপুর এলাকায়। কারণ স্থানীয় সাবেক সাংসদ ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের নিজ বাড়ি সেখানে হওয়ায় সেখানকার মানুষ বিনা বাঁধায় নদী দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এখনো দখল কাজ চলমান আছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, চারঘাট বাজারের হোটেলগুলোর বর্জ্য, পৌর শহরের ড্রেনের দূষিত আবর্জনা, হাসপাতালের বর্জ্য ও বাসা বাড়ির টয়লেটের বর্জ্যও ড্রেনের মাধ্যমে ফেলা হচ্ছে বড়াল নদীতে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন মরা নদীর পাড়ের বাসিন্দারা। স্থানীয়দের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠান চারঘাট পৌরসভা নদী দখল করে গণশৌচাগার, রাস্তা ও মার্কেট নির্মাণ করেছে। বন বিভাগ নদীর মধ্যে বনায়নের গাছ রোপণ করেছে। উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে প্রকাশ্যে চলছে এসব দখল ও দূষণ।
চারঘাটের রামচন্দ্রপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আড়ানী ব্রীজ সংলগ্ন জায়গায় এখনো নদীর ভেতরে পিলার বসিয়ে ছাদ দেওয়া পাকা মার্কেটের নির্মাণ কাজ চলছে। স্থানীয় প্রশাসন একাধিকবার অভিযানে গেলেও নির্মাণ কাজ বন্ধ করেননি দখলদার ব্যক্তি। কাজটি করছেন স্থানীয় বাসিন্দা রকি ইসলাম। তিনি বলেন, বিগত সময় ক্ষমতাসীনরা ইচ্ছেমত দখল করে নদীটিকে মেরে ফেলেছে। তখন কেউ বাঁধা দেয়নি। বাজারে বসার জায়গা নেই এজন্য ঘর করছি এখানে আমরা স্থানীয়রা বসে গল্প-আড্ডা করবো।
একই অবস্থা দেখা গেছে বাটিকামারী এলাকায়। স্থানীয় ইমদাদুল ইসলাম ও আব্দুর রহমান বড়াল নদী দখল করে দোকানঘর নির্মাণ করেছেন কিছুদিন আগে। তারা দুজন বলেন, অনেকেই নদীর পাশে দোকান করেছে আমরাও করেছি। কিন্তু সব জমি তো নদীর না। সরকারের জমি হলে সরকার কখনও চাইলে তখন দেখা যাবে।
বড়াল রক্ষা আন্দোলন চারঘাট উপজেলার সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, নদী দখল করে পৌরসভা তিনটি গণশৌচাগার ও পৌর মার্কেট নির্মাণ করেছে। নদীর ভেতর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করেছে। নদীর জমিতে আবাসন গড়ে তোলা হয়েছে। দখলদারের তালিকায় এসবের নাম নেই। বড়ালে প্রাণ ফেরাতে যে উদ্যোগই নেওয়া হোক যদি দখলদারদের উচ্ছেদ করা না যায় তবে সব প্রচেষ্টা বৃথা যাবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এস এম মিজানুর রহমান বলেন, উপদেষ্টা মহোদয় বড়ালের চারঘাট উৎসমুখ পরিদর্শন করার পর বড়ালের নাব্যতা ফেরাতে উনার উদ্যোগ শুনে আমরা আশাবাদী হয়েছি। এর মধ্যে অন্যতম বড়ালের দু পাড় দখলমুক্ত করা। এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পুনরায় তার কাছে বড়াল সংলগ্ন সাতটি উপজেলা থেকে লিখিত আবেদন করছি।
চারঘাট স্লুইসগেট সংলগ্ন বড়ালের উৎসমুখের পাশেই চারঘাট পৌরসভা তিনটি গণশৌচাগার ও নদীর ভেতর দিয়ে চলাচলের পাকা সড়ক নির্মাণ করেছে। পৌর মার্কেটও নির্মাণ করেছে নদীর জমি ভরাট করে। পৌরসভা কতৃপক্ষ ৪২ নং চারঘাট মৌজায় ৫টি দাগে ৪ একর, ৩০ নং আরজে সাদীপুর মৌজায় ২টি দাগে ২.৫০ একর জায়গা দখল করেছে। বড়াল নদের সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করেছে চারঘাট পৌরসভা, কিন্তু তালিকায় পৌরসভার নাম নেই।
পৌরসভা এত পরিমাণ নদীর জমি দখল করলেও তালিকায় পৌরসভার নাম না থাকার বিষয়ে পৌরসভা ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আনন্দ কুমার দাস বলেন, দখলকারীদের পূর্বের যে তালিকা ছিল সে তালিকায় পৌরসভার নাম ছিল না। এজন্য নতুন করে পৌরসভাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। পৌরসভাকে অন্তর্ভুক্ত করতে উর্ধতন কতৃপক্ষের নির্দেশনা পেলে সে অনুযায়ী সার্ভেয়ারসহ সরেজমিন পরিমাপ করে তা বাস্তবায়ন করা হবে।
পৌরসভার নদী দখল করে গণশৌচাগার, মার্কেট ও রাস্তা নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে তৎকালীন দায়িত্বে থাকা পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, লিখিত কোনো অনুমোদন নিয়ে নির্মাণকাজ হয়নি। তবে স্থানীয় প্রশাসনের নিকট থেকে মৌখিক অনুমোদন নিয়ে জনস্বার্থে এসব উন্নয়ন কাজ করা হয়েছে।
১০১ দখলকারীর মধ্যে ৫২ জন দখলকারী সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বাড়ি আড়ানী রামচন্দ্রপুর এলাকার। মূলত প্রতিমন্ত্রীর প্রভাবেই সেই এলাকায় নদী দখল হয়েছে বেশি। রামচন্দ্রপুর এলাকায় সবচেয়ে বেশি ৩০ শতক জায়গা দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেছেন নওশাদ আলী নামে স্থানীয় এক আ’লীগ নেতা। শাহরিয়ার আলমের আস্থাভাজন হিসাবে পরিচিত থাকায় কেউ তাকে বাঁধা দেওয়ার সাহস পায়নি। এছাড়াও স্থানীয় আ’লীগ নেতা মাহাতাব আলী, আশরাফুল আলী, রানা ইসলাম ও জসিম উদ্দিন সেখানে জায়গা দখল করেছেন।
এ বিষয়ে নওশাদ আলী বলেন, আমি শুধু জমি দখল করেছি এমন তো না। অনেকেই করেছে, আমিও সামান্য কিছু জায়গায় দোকান করেছি। সরকার চাইলে জায়গা ফাঁকা করে দেবো।
গত পাঁচ আগষ্টের পর আড়ানী ব্রীজ সংলগ্ন জায়গায় প্রায় তিন শতক জায়গা দখল করে পাকা পিলার তুলে দোকানঘর নির্মাণ করছেন ছাত্রদল নেতা রকি ইসলাম।
দখলকারীদের তালিকা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে নদী রক্ষা কমিশনে পাঠানো হয়েছে ২৭ মার্চ।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ রাহাতুল করিম মিজান বলেন, আমি সদ্য যোগদান করেছি। নদী দখলকারীদের তালিকার বিষয়ে আমার জানা নেই। পূর্বে তালিকা পাঠানো হয়ে থাকলে সেখানে কোনো ভূল ত্রুটি থাকলে সে বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে সমাধান করা হবে।
চারঘাট পৌরসভার মত আড়ানী পৌরসভাও বড়ালের জায়গা দখল করেছে। চারঘাটের কালুহাটি-রুস্তুমপুর ব্রীজের পাশে প্রাশ ১০০ শতক জায়গা দখল করে পৌরসভার স্যানেটারী ল্যান্ডফিল গড়ে তোলা হয়েছে। তবে দখলকারীদের তালিকায় চারঘাট পৌরসভার মত আড়ানী পৌরসভারও কোনো নাম নেই।
নদীর দখলদারদের বিষয়ে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী পার্থ সরকার বলেন, মাননীয় উপদেষ্টার নির্দেশনা অনুযায়ী বড়াল নদীর স্লুইসগেটের রেগুলেটর অপসারণ করা হয়েছে। এখন নদীর পানি স্বাভাবিক ভাবে প্রবাহিত হবে। দখলদারের সংখ্যা ১০১ জনের চেয়ে বেশি, পর্যায়ক্রমে সব দখলদারই তালিকায় আসবে। উচ্ছেদ কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া, আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি।