নয় (০৯) বছর পেরোলেই একটি মেয়ে তার শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পদার্পণ করে। জীবনের নতুন একটি ধাপে পদার্পণ একটি মেয়ের জন্য যতটা না আনন্দের তার চেয়ে বেশি অস্বস্তিকর। কারণ এই সময়ে একটি মেয়েকে নানারকম শারীরিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই সময়ে যদি মেয়েটির জন্য একটি স্বাস্থ্যসম্মত ও সহায়ক পরিবেশ দেয়া না যায় তাহলে মেয়েটির জন্য পরবর্তী জীবনে নানা জটিলতায় পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
বাংলাদেশের নিয়মানুযায়ী ১০-১৯ বছরের মেয়েদেরকে কিশোরী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই বয়সের মেয়েদের বয়ঃসন্ধি শুরু হতে থাকে। এসময় শরীরে নানা পরিবর্তন ঘটে, যা তাদের শারীরিক পরিপক্বতার স্বাভাবিক ধাপ। শারীরিক গঠনে পরিবর্তন, দ্রুত উচ্চতা বাড়তে থাকে ও ঋতুস্রাব শুরু হয়। এসব পরিবর্তন কিশোরীদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে আসে, যা একজন মেয়েকে ধীরে ধীরে একজন শিশু থেকে নারীতে পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
এই পরিবর্তনগুলোর মাঝে ঋতুস্রাব বিষয়টি একজন কিশোরীর জন্য একেবারেই নতুন একটি বিষয়। এ সম্পর্কে তাকে আগে থেকে অবহিত না করে থাকলে সে হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে পড়তে পারে। ঋতুস্রাব বা মাসিক হলো কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালের একটি স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক পরিবর্তন। সাধারণত ৯ থেকে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে এটি শুরু হয়। প্রতি মাসে নারীদের শরীরে ডিম্বাণু তৈরি হয় এবং গর্ভধারণ না হলে জরায়ুর আস্তরণ রক্তসহ শরীর থেকে বের হয়ে যায়—এই প্রক্রিয়াকেই ঋতুস্রাব বলা হয়। সাধারণত এটি ৩ থেকে ৭ দিন স্থায়ী হয় এবং প্রতি ২৮ থেকে ৩৫ দিন পরপর ঘটে। ঋতুস্রাবের সময় পেটব্যথা, কোমরব্যথা, মাথাব্যথা বা মেজাজের পরিবর্তন দেখা দিতে পারে, যা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। এটি একজন মেয়ের প্রজনন সক্ষমতা শুরুর ইঙ্গিত দেয় এবং নারীত্বের একটি প্রাকৃতিক ও গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন। যেহেতু এই প্রক্রিয়ায় কিশোরী বয়স থেকেই শরীর থেকে দূষিত রক্ত বেরিয়ে যায়। এতে শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে।
ঋতুস্রাবের সময় নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করা এবং প্রয়োজনে তা দিনে কয়েকবার বদলানো উচিত। রক্তস্বল্পতা থেকে রক্ষা পেতে নিয়মিত আয়রন ট্যাবলেট ও ফলিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। এছাড়াও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করা শারীরিক সুস্থতার জন্য উপকারী। শরীর বা মনের কোনো পরিবর্তন নিয়ে যদি দ্বিধা বা অস্বস্তি থাকে, তাহলে তা মা বা অন্য কোনো বিশ্বাসযোগ্য বড় সদস্যদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত। পরিবার, বিশেষ করে মা বা নারী অভিভাবকদের উচিত কিশোরীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা এবং তাদের প্রশ্নের উত্তর নির্ভয়ে ও সহানুভূতির সঙ্গে দেওয়া। এতে করে সে নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে পারে এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে। এই সময়টা একান্ত যত্ন ও সহানুভূতির দাবি রাখে—নিজের শরীরকে বুঝে নেওয়ার ও নতুনভাবে গড়ে ওঠার সময়।
কিশোরী বয়স—একটি রঙিন স্বপ্নের সময়, আবার একইসঙ্গে নানা ধরনের ঝুঁকি ও বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার বয়স। এ বয়সেই একজন মেয়ের আত্মপরিচয়ের বীজ বপন হয়, গড়ে ওঠে তার ভবিষ্যতের ভিত্তি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই বয়সের অনেক মেয়েই এখনো সমাজের বৈষম্য, বাল্যবিবাহ, স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার কিশোরীদের জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে —যা কেবল সমস্যা মোকাবেলায় নয় বরং তাদের ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
এরমধ্যে সরকারের অন্যতম একটি উদ্যোগ হলো কিশোর কিশোরী ক্লাব। স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে চালু হওয়া কিশোর কিশোরী ক্লাব (KKC) বর্তমানে গ্রাম ও শহরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কিশোর ও কিশোরীদের জন্য একটি নিরাপদ এবং কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে উঠেছে। এই ক্লাবগুলোতে মেয়েরা বাল্য বিবাহের পরিণতি, স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক জ্ঞান, ও আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ লাভ করে। পাশাপাশি নেতৃত্ব বিকাশমূলক কার্যক্রম, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নেয়। বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ৪,৫০০ কিশোর-কিশোরী ক্লাব সক্রিয় রয়েছে, যার মাধ্যমে হাজার হাজার কিশোরী তাদের জীবন ও ভবিষ্যৎ গঠনে অংশ নিচ্ছে।
কিশোরী বান্ধব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘Adolescent Friendly Health Services (AFHS)’ কর্মসূচির মাধ্যমে কিশোরীদেরকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়। এই সেবার আওতায় রয়েছে- মাসিক স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে পরামর্শ, আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট বিতরণ, গোপনভাবে স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান পাওয়ার সুযোগ, পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সচেতনতা। এসব কেন্দ্র এখন শুধু চিকিৎসা কেন্দ্র নয়, বরং কিশোরীদের আত্মবিশ্বাসের জায়গা হয়ে উঠছে।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কঠোর আইন ও মাঠপর্যায়ের তৎপরতা বাড়ানো হচ্ছে। ২০১৭ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সরকার এই আইন বাস্তবায়নে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে গঠন করেছে Child Marriage Prevention Committee, যেখানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সদস্যরা কাজ করছে সম্মিলিতভাবে। উঠান বৈঠক, পথনাটক, অভিভাবক সভা— এইসব মাধ্যমে গ্রামের সাধারণ মানুষও এখন জানছে, বুঝছে যে, বাল্যবিবাহ কেবল একটি সামাজিক সমস্যা নয়, এটি একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এতে সমাজের মানুষও বাল্যবিবাহ সম্পর্কে সচেতন হচ্ছেন।
বিদ্যালয়ে মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতায় ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। কিশোরীদের জন্য বড় একটি সংকট দীর্ঘ দিন ছিল মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে লজ্জা ও অজ্ঞতা। এই সমস্যা সমাধানে ‘Menstrual Hygiene Management (MHM)’ কর্মসূচির আওতায় স্কুলে স্কুলে চালু করা হয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা ক্লাস, বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ, পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ টয়লেট ব্যবস্থা। এর ফলে মেয়েরা এখন স্কুলে অনুপস্থিতির হার কমিয়েছে, সচেতন হয়েছে নিজের শরীর সম্পর্কে।
ডিজিটালাইজেশনে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে কিশোরীরা এখন মোবাইল অ্যাপ যেমন Maya, Joltorongo, আপনজন- এর মাধ্যমে গোপনে স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য, সম্পর্ক বা আইনসংক্রান্ত জিজ্ঞাসার উত্তর পাচ্ছে। এগুলো শুধু অ্যাপ নয়, বরং হাজারো মেয়ের সাহসী প্রশ্নের নিরাপদ আশ্রয়।
কিশোরী মানেই আমাদের ভবিষ্যৎ। সরকারি এসব উদ্যোগ আজ প্রমাণ করছে— কিশোরী মানেই দুর্বল কেউ নয়, বরং একেকজন কিশোরী মানে সম্ভাবনার একটি জ্যোতির্বিন্দু। পরিবার যদি তাদের স্বপ্ন দেখতে দেয়, সমাজ যদি সহায়ক হয় আর রাষ্ট্র যদি তাদের পাশে থাকে তাহলে কিশোরী এগিয়ে যাবে বহুদূর। এর সাথে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
#
লেখক: মোঃ নাবিল তাহমিদ ,সহকারী তথ্য অফিসার (প্রোটকল শাখা), তথ্য অধিদফতর, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা।
পিআইডি ফিচার