মাঝবয়সি আরেফিন পারভেজ পেশায় একজন আর্কিটেক্ট। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার একটি আঠারো তলা ভবনের অষ্টম তলার ফ্লাটে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। নামকরা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির প্রধান স্থপতি হিসেবে বিশ বছরের বেশি সময় পার করেছেন। সন্ধ্যার পরে গুলশানের অফিস থেকে ধানমন্ডির বাসায় ফেরার পথে ইচ্ছা করেই কলাবাগান খেলার মাঠের সামনে নিজের গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। ড্রাইভার গাড়িসহ বাসায় ফেরে, আর স্বাস্থ্যসচেতন আরেফিন প্রতিদিন এ পথটুকু হেঁটেই আসেন। আজ বড্ড গরম পড়েছে, এটুকু পথ হেঁটে আসতেই ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়েছেন তিনি। বাসার ড্রয়িং রুমে ঢুকেই দেখেন ঘরের এয়ার কন্ডিশনার চালু রয়েছে এবং টিভিতে চলছে কার্টুন চ্যানেল, তবে ঘরটিতে কেউ নেই। বাড়ির কাজের লোকটির কাছ থেকে জানলেন আরেফিন সাহেবের ছোটোছেলে শুভ এখন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ছে। শিক্ষক আসার পূর্বে সে-ই টিভিতে কার্টুন দেখছিল। তবে পড়তে বসার আগে টেলিভিশন আর এয়ার কন্ডিশনার বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছে। শুভ কেবল বারো বছরের শিশু, সে বিবেচনায় বিষয়টি গুরুতর কোনো অপরাধ নয়। তবুও জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিদ্যুতের অপচয় বন্ধে শিশু বয়স থেকেই সবার সচেতন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন জনাব আরেফিন। তাই রাতের খাবার শেষে সবাই একসাথে টেলিভিশন দেখার এক ফাঁকে পরিবারের সদস্যদের কাছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জ্বালানির বিশ্বময় যে সংকট সে বিষয়টি তুলে ধরলেন। একই সাথে দেশের জাতীয় সম্পদ বিদ্যুতের অপচয় বন্ধে কী করা যেতে পারে সে বিষয়ে আলোচনা করলেন।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক হিসেব থেকে দেখা যায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে গড়ে এক ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হতো ৫ টাকা ৪৭ পয়সা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেই খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ১১ টাকার উপরে। এর সঙ্গে সরবরাহ ব্যয় যুক্ত হলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ হয় প্রতি ইউনিটে ১১ টাকা ৩৮ পয়সা। এক দশক আগের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রির কারণে পিডিবির ইউনিট প্রতি গড়ে ভর্তুকি গত অর্থবছরগুলোতে বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ হচ্ছে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া। গত দশ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে জ্বালানির প্রয়োজন তার বড়ো অংশ আমদানি করতে হয়। ফলে উৎপাদন খরচও ধারাবাহিকভাবে বাড়ে।
পিডিবি ও পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসির তথ্য অনুযায়ী, দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় গত বছরের ৩০ এপ্রিল। সেদিন ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেও ৪৯৯ মেগাওয়াট লোডশেডিং দিতে হয়। আর এ বছর ২৪ এপ্রিল বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ১৬ হাজার ৩৬৪ মেগাওয়াট। তা সত্ত্বেও ঐদিন লোডশেডিং হয়েছে ১৩৯ মেগাওয়াট। সাধারণত, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এপ্রিল মাসে বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়ে যায়। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তিনমাস আগে অর্থাৎ, গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ ভবনে গ্রীষ্মের প্রস্তুতি নিয়ে সভা হয়। সভা শেষে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এবারের গ্রীষ্মে এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে। তবে ২০২৫ সালের এপ্রিলে গড় তাপমাত্রা বিগত বছরের চেয়ে ২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি অতটা খারাপ হয়নি বলে রক্ষা। তবে জাতীয় সম্পদ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার বিকল্প নেই। এইতো কয়দিন আগে মে মাসের ৫ তারিখে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে ঢাকা শহরের একাংশের বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ডেসকো। ডেসকোর বোর্ড চেয়ারম্যান ও পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ কর্তৃপক্ষের (পিপিপি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম সভায় বলেন, বিগত সময়ের অনিয়মে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এখন চরম আর্থিক সংকটে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বিদ্যুতে সরকারের ভর্তুকি প্রতি ইউনিটে পাঁচ টাকা। এ থেকে মুক্তি পেতে হবে। ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে। তাই প্রত্যেককে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি খাতে অস্থিরতা চলছে। বিশ্ববাজারে রাশিয়া জ্বালানি তেল এবং গ্যাসের একটি বড়ো জোগানদাতা। এ যুদ্ধের কারণে জ্বালানির বিতরণব্যবস্থা, বিশেষ করে ইউরোপে অনেকটা বিপর্যস্ত। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় কয়েকগুণ বেড়েছে। মুদ্রাস্ফীতির এ ঊর্ধ্বগতির নেতিবাচক প্রভাব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা থেকে শুরু করে সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়ছে। খাদ্যদ্রব্য, নিত্যব্যবহার্য পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ইত্যাদির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিশ্বের একটা বিরাট জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা হারানোর উপক্রম হয়েছে। জ্বালানি খাতে ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সরকার ব্যয়সংকোচন নীতি গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে। সরকার স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, যোগাযোগ কিংবা সামাজিক খাতে ব্যয় কমিয়ে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয়নির্বাহে জ্বালানি সহায়তা বাবদ অর্থ দিতে বাধ্য হচ্ছে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমদানিকৃত জ্বালানি ওপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ায় পাশাপাশি বিদ্যুৎ অপচয় বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। সরকারি দপ্তরে বিদ্যুৎ অপচয় বন্ধ করতে প্রতিটি দপ্তরে জরিপ করে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ, জ্বালানি সাশ্রয়ী যানবাহন এবং যন্ত্রপাতি ব্যবহার নিশ্চিত করতে উপযুক্ত নীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এছাড়া বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে রাখা ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সবাইকে উৎসাহিত করতে হবে। দোকানপাট, শপিংমল, বিপণিবিতান, পেট্রলপাম্প ও সিএনজি স্টেশনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ, দিনের বেলায় জানালার পর্দা সরিয়ে রাখা ও দিনে আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহারসহ যে কোনো ধরনের আলোকসজ্জা থেকে বিরত থাকার বিকল্প নেই। পিক আওয়ারে রি-রোলিং মিল, ওয়াশিং মেশিন, ওয়েল্ডিং মেশিন, ওভেন ও ইস্ত্রির ব্যবহার বন্ধে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ইজি বাইক, অটোরিকশা ইত্যাদি অবৈধভাবে চার্জিং হতে বিরত রাখা, বাসা-বাড়িতে পরিবেশবান্ধব রুফটপ সোলারটিকে সচল রাখায় বাধ্যবাধকতা আনা দরকার। বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে সাধারণ মানুষকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও তথ্য প্রদানের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির প্রচলন, এগুলোর সহজলভ্যতা ও ব্যবহার নিশ্চিত করা আবশ্যক। বিদ্যুতের পুরো বিপণনব্যবস্থাকে স্মার্ট প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা যেতে পারে । কারণ, স্মার্ট মিটারের মাধ্যমে গ্রাহক প্রতি ঘণ্টায় কত বিদ্যুৎ খরচ হলো, তা জানতে পারে এবং সচেতন হতে পারে। সুইচের ক্ষেত্রে অটোমেশন টেকনোলজি নিয়ে আসতে হবে, যাতে করে নির্দিষ্ট সময় পরে সুইচ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুতের বড়ো গ্রাহক। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের মননে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের বিষয়টি গেঁথে দিতে পারেন শিক্ষকেরা। এসকল প্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক বিশেষ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা যেতে পারে।
আমাদের মানতেই হবে যে, গ্রাহক তার চাহিদানুযায়ী জ্বালানিসহ অন্যান্য ইউটিলিটি সার্ভিস ব্যবহার করবে। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত যাতে ব্যবহার না হয়, সে বিষয়ে তাকে সচেতন হতে হবে। আর সচেতনতা তখনই সৃষ্টি হবে, যখন গ্রাহক পর্যায়ে এবিষয়ে পর্যাপ্ত কারিগরি জ্ঞান বা তথ্য থাকবে। আর গ্রাহককে এ জ্ঞান বা তথ্য প্রদানের দায়িত্ব নিতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবং ইউলিটি সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে। সাশ্রয়ী গ্রাহকের জন্য প্রণোদনা প্রদানের বিষয়টিও চিন্তা করা যেতে পারে। যেমন-যুক্তরাজ্যে ন্যাশনাল গ্রিড কর্তৃপক্ষ তাদের এনার্জি সেভিং স্কিমের আওতায় গ্রাহকদের বিকাল ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ কম ব্যবহার করলে বিদ্যুৎ বিলে ডিসকাউন্ট দেওয়ার কার্যক্রম চালু করেছে।
দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি কয়লা, তেল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) জোগানে ক্রমেই আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে। বর্তমানে ৬৫-৭০ শতাংশ জ্বালানি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। এতে প্রয়োজনীয় অর্থ ও ডলারের জোগান নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ। এক দশক আগেও দেশে বিদ্যুতের জ্বালানি আমদানির পরিমাণ ছিল ২০-২৫ শতাংশ। আমদানিনির্ভর জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাড়ায় যা এখন তা প্রায় ৭০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আগামীতে যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসবে, সেগুলো চালাতে হলে দেশে আমদানি করা জ্বালানির পরিমাণ ৯০ শতাংশের কাছাকাছি চলে যেতে পারে। জ্বালানি আমদানিতে প্রয়োজনীয় বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান করা বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। এখান থেকে অর্থ সাশ্রয় করা গেলে তা দেশের জনগণের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় ব্যয় করার সুযোগ তৈরি হবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে বহুল ব্যবহৃত জ্বালানিগুলোর কোনোটিই নবায়নযোগ্য উৎসের নয়। পৃথিবীতে এসংশ্লিষ্ট সকল উৎসগুলোতে সঞ্চিত জ্বালানি ক্রমেই কমে আসছে। যা আগামীর বিশ্বের জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড়ো ধরনের হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। শক্তির উৎস সীমিত, তাই একজন প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে আরেকজন বঞ্চিত হবে- এটাই স্বাভাবিক । মনে রাখা দরকার, একজনের সাশ্রয় করা বিদ্যুৎ অন্যজনের চাহিদা মেটাতে পারে। তাই আসুন, আমরা সবাই বিদ্যুৎ ব্যবহারে সংযমী হই।
#
লেখক: ম. জাভেদ ইকবাল,সিনিয়র উপপ্রধান তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর