অনলাইন ডেস্ক : আসন্ন ফুটবল মৌসুমে সার্ক অঞ্চলের ফুটবলারদের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে বাংলাদেশি হিসেবে গণ্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাফুফে। কোনো দেশের ফুটবলাররা অন্য দেশের ঘরোয়া লিগে অংশগ্রহণ করলে তারা বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবেই বিবেচিত হন। অথচ সেখানে বাফুফে সার্ক অঞ্চলের ফুটবলারদের দেশি হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে।
বাফুফের এই সিদ্ধান্তে বেশ বিস্মিত হয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক জাহিদ হাসান এমিলি। তিনি বলেন, ‘সার্কের খেলোয়াড়দের দেশি হিসেবে গণ্য করলে আমাদের ফুটবলারদের জায়গা কমবে। সার্কের অন্য কোনো দেশে এখনও আন্তঃপারস্পরিক এই নিয়ম বাস্তবায়ন হয়নি, সেখানে বাংলাদেশ আগে করার কোনো যৌক্তিকতা দেখছি না। এশিয়ান কোটার মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সাফ কোটাও চালু করতে পারে।’
জাতীয় দলের সাবেক আরেক ফুটবলার ও কোচ জুলফিকার মাহমুদ মিন্টু বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করার অনুরোধ জানালেন, ‘বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল। আমার দৃষ্টিতে এটা আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা দরকার। নেপাল ও ভুটানের লিগে ফুটবলারদের সম্মানী কম। ফলে বাংলাদেশের ফুটবলারদের সেখানে যাওয়ার সুযোগ কম, অন্যদিকে সেই দেশের ফুটবলারদের যদি বাংলাদেশের ক্লাবগুলো অল্প খরচে আনতে পারে তখন বাংলাদেশের ফুটবলারদের জায়গা সংকুচিত হয়ে যাবে।’
সাবেক জাতীয় ফুটবলার ও কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক প্রায় পাঁচ দশক ঘরোয়া ফুটবলের সঙ্গে রয়েছেন। নতুন নিয়মের ফলে বাংলাদেশের ফুটবলারদের জন্য উভয় সংকট দেখছেন তিনি, ‘আমার একান্ত ব্যক্তিগত ভাবনা সার্কের যদি দুইজন খেলোয়াড়ও একটি দল নিবন্ধন করে তাহলে সেখানে বাংলাদেশের দুইজন খেলোয়াড় বাদ পড়ল। লোকাল দুইজন খেলোয়াড় দলই পেল না। রেজিস্ট্রেশন করা সার্কের দুই জনের মধ্যে একজনও যদি অন্তত খেলে তাহলে মাঠে খেলার সুযোগ কম পাবে লোকাল একজন।’
পুরান ঢাকার ক্লাব রহমতগঞ্জের কোচ কামাল বাবু বাফুফের নতুন আইনের আরও কঠিন বাস্তবতা দেখিয়েছেন, ‘কালকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনজন বিদেশি একাদশে খেলবে। এর পাশাপাশি একজন অনূর্ধ্ব-২০ খেলোয়াড়কে রাখতে হবে। এরপর যদি আবার সার্কের দুই-তিন জন খেলোয়াড় খেলার সুযোগ পায়, লোকাল হিসেবে তাহলে একাদশে বা মাঠে প্রকৃত বাংলাদেশি খেলোয়াড় থাকে মাত্র ৪-৫ জন।’ ঘরোয়া ফুটবলে অন্যতম পরিচিত কোচ কামাল বাবু এই আইনের ভিন্ন উদ্দেশ্যও দেখছেন, ‘নতুন এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অবশ্যই কারও ভিন্ন কোনো স্বার্থ রয়েছে। এতে দেশের ফুটবলের প্রকৃত অর্থে ইতিবাচক প্রভাব পড়ার সুযোগ দেখছি না।’
দেশের অন্যতম শীর্ষ কোচ মারুফুল হক বাংলাদেশ পেশাদার লিগের টেকসই নিয়ম নেই যে সেটা বিশেষভাবে তুলে ধরলেন, ‘২০০৭ সাল থেকে পেশাদার লিগ শুরু হয়ে প্রায় দেড় যুগ অতিবাহিত হয়েছে। এখনও লিগের কাঠামো, নীতিমালা কোনো কিছুই সুনির্দিষ্ট হয়নি। সেই আগের মতোই ট্রায়াল এন্ড এরর ভিত্তিতে চলছে। এতে উন্নয়ন সম্ভব নয়।’
গতকাল বাফুফে সভার পর লিগ কমিটির চেয়ারম্যান ও ফেডারেশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি ইমরুল হাসান সার্ক অঞ্চলের ফুটবলারদের দেশি হিসেবে গণ্য করার কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন, সার্ক অঞ্চলের ফুটবলাররা একে অন্যের লিগে অংশগ্রহণ করলে সেই দেশের স্থানীয় হিসেবে গণ্য হবে বলে সাফে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশে যেমন ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার ফুটবলাররা খেলার সুযোগ পাবেন, তেমনি অন্য দেশেও বাংলাদেশের ফুটবলাররা সেখানকার স্থানীয় ফুটবলার হিসেবে গণ্য হবেন। বাফুফের কালকের এই সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমে দেখে নেপালের কয়েকজন সাংবাদিক এই প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়েছেন। তাদের কাছে পাল্টা জিজ্ঞেস করে জানা গেছে, নেপাল ফুটবল ফেডারেশন এই বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি।
এদিকে, ভারতের কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ভারত ফুটবল ফেডারেশনও এমন কোনো আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেয়নি। সাফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন এই বিষয়ে বলেন, ‘সাফের সভায় এই বিষয়টি আলোচনা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকেই এমন প্রস্তাবনা আসলেও আনুষ্ঠানিক কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। সাফের ফেডারেশনগুলোকে অফিসিয়াল বার্তা দেওয়া হয়নি এখনও।’
সার্ক অঞ্চলের ফুটবলারদের দেশি হিসেবে গণ্য করলে ফুটবলের টেকনিক্যাল একটি প্রভাব তো রয়েছেই। এর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় বিষয়ও রয়েছে। ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের ফুটবলাররা ভিসা নিয়ে বিদেশি নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে অবস্থান করেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সরকার যেখানে দেশের বাইরের ফুটবলারদের বিদেশি হিসেবে গণ্য করছে, সেখানে ফুটবল ফেডারেশন তাদের লোকাল/দেশীয় স্বীকৃতি প্রদান করছে। যা দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। বাফুফে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কোনো আলাপ করেনি বলে জানা গেছে।
দেশের শীর্ষ ফুটবলাররা জাতীয় দলের ক্যাম্পে যোগ দিচ্ছেন আজ (শনিবার)। ফলে তারা এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। সাবেক হলেও এই বিষয়ে ফুটবলারদের পদক্ষেপের আভাস দিলেন এমিলি, ‘কাল দেখলাম ফেডারেশন বলল ক্লাবগুলোর সঙ্গে সার্ক অঞ্চলের খেলোয়াড়দের সংখ্যা নির্ধারণ করবে। ক্লাবের অবস্থান দেখার পর ফুটবলাররা তাদের অবস্থান জানাবে। আমরা ইতোমধ্যে আলোচনা করছি।’
ফুটবলারদের অধিকার ও স্বার্থ আদায়ের সংগঠনের জন্য ফুটবল খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতির সৃষ্টি হয়েছিল। গত এক যুগে ফুটবলারদের নানা ঘটনায় এই সংগঠনের কার্যকরী ভূমিকা দেখা যায়নি। কাগজে-কলমে এই সংগঠনের সভাপতি এখনও ইকবাল হোসেন। যিনি এক যুগ আগেই ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছিলেন।