অনলাইন ডেস্ক : উত্তর আফ্রিকার দেশ সুদানের দারফুর অঞ্চলে গণহত্যা চালাচ্ছে বিদ্রোহী আধাসামরিক বাহিনী আরএসএফ। শহর দখলের পর তাদের ঘরে ঘরে গণহত্যার ভয়াবহ সেই চিত্র ধরা পড়েছে স্যাটেলাইটেও।
মূলত ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের পর স্যাটেলাইটে ধরা পড়েছে রক্তাক্ত দৃশ্য। মানবাধিকার বিশ্লেষকরা বলছেন, মহাকাশ থেকেও দৃশ্যমান এই রক্তাক্ত পরিস্থিতি ২০ বছর আগে শুরু হওয়া দারফুর গণহত্যার চূড়ান্ত অধ্যায়কেই সামনে এনেছে।
শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজ।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, সুদানের দারফুর অঞ্চলে র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) বিদ্রোহীদের হাতে শহর দখলের পর ঘরে ঘরে গণহত্যার ভয়াবহ দৃশ্য ধরা পড়েছে স্যাটেলাইট চিত্র ও যাচাইকৃত ভিডিওতে। আর এই ঘটনাকে নতুন করে গণহত্যার প্রমাণ হিসেবে দেখছেন মানবাধিকার বিশ্লেষকরা।
ইয়েল ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পাবলিক হেলথের হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাব (এইচআরএল) জানিয়েছে, স্যাটেলাইট চিত্রে শহরের বিভিন্ন স্থানে দেহসদৃশ অসংখ্য বস্তু দেখা গেছে। এসব বস্তুর চারপাশে রক্তের দাগ স্পষ্ট। হাসপাতাল, আবাসিক এলাকা, শহরের উপকণ্ঠ এবং সরকারি সেনা ঘাঁটির কাছাকাছি এসব নিথর দেহ শনাক্ত করা হয়।
এইচআরএল-এর মানবাধিকার গবেষক ন্যাথানিয়েল রেমন্ড বলেন, “আরএসএফ শহর দখলের ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই এই গণহত্যা চালায়”। তিনি জানান, তাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, “১.৩ থেকে ২ মিটার দৈর্ঘ্যের হাজারো বস্তু মাটিতে ছড়িয়ে আছে, আর এটি আকার ও আকৃতিতে মানবদেহের সঙ্গে মিলে যায়।”
রেমন্ড আরও জানান, দারাজা উলা এলাকায় আরএসএফ সদস্যরা যানবাহন নিয়ে ঘরে ঘরে অভিযান চালিয়েছে। আর এটি স্যাটেলাইট চিত্র, ভিডিও ও বেঁচে যাওয়া নারীদের সাক্ষ্যের সঙ্গে মিলে গেছে। অনেক নারী জানিয়েছেন, পুরুষদের আলাদা করে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে আরএসএফ।
গবেষকরা আরও বলেন, এসব স্থানের কাছাকাছি আরএসএফ-এর সামরিক যান দেখা গেছে। রক্তের দাগ স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা গেছে, যা হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ বহন করে। নতুন চিত্রে দেখা যাচ্ছে, মৃতদেহের স্তূপ আরও বেড়েছে এবং আগের দেহগুলোও সেখান থেকে সরেনি। অর্থাৎ সেগুলো এখনো মাটিতেই পড়ে আছে।
‘সৌদি হাসপাতাল’ নামের একটি স্থানে অন্তত চারটি দেহের স্তূপ শনাক্ত করা হয়েছে। সেখানে প্রথম দিন মানুষদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল দেখা যায়। আর এর পরের দিন একই স্থানে দেহের স্তূপ দেখা যায়। যা থেকে বোঝা যায় বন্দিদের হত্যা করা হয়েছে।
শহরের পশ্চিমে পালানোর সময় সাধারণ মানুষকেও গুলি করা হয়েছে বলে স্যাটেলাইট চিত্রে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। শহরের প্রতিরক্ষাব্যূহ বরাবরও অন্তত ছয়টি দেহের স্তূপ পাওয়া গেছে, আর তার পাশে দেখা গেছে আরএসএফ-এর সামরিক যান। পরে এসব যান সরে গেলেও মরদেহগুলো রয়েই গেছে।
এইচআরএল-এর বিশ্লেষণে দেখা যায়, আরএসএফ এখন শহরের সেনা ঘাঁটিগুলোও দখলে নিয়েছে। ২৬ অক্টোবরের স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, সুদানি সেনাবাহিনীর ষষ্ঠ ডিভিশনের ঘাঁটিতে অন্তত ১৫টি নতুন বিস্ফোরণের চিহ্ন ও পোড়া দাগ আছে, যা গত ১৫ অক্টোবরের ছবিতে ছিল না।
রেমন্ড বলেন, “আমরা দেখেছি সুদানি সেনারা একই সময়ে ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়েছে। এতে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, সম্ভবত আরএসএফ-এর সঙ্গে চুক্তি করেই তারা রাতের আঁধারে পালিয়েছে, আর সাধারণ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ফেলে গেছে।”
এবিসি নিউজ বলছে, ১৮ মাস ধরে অবরুদ্ধ এল ফাশের শহর এখন পুরোপুরি বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। জাতিসংঘ এই শহরটিকে “দুর্ভোগের কেন্দ্রবিন্দু” হিসেবে আখ্যা দিয়েছ। এখন আরএসএফ শহরে প্রবেশের পর কেউ পালাতে পারছে না। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এটাই হয়তো আরও ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের শুরু।
এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ঘোষণা দেয়, আরএসএফ সুদানে গণহত্যা চালিয়েছে, বিশেষত দারফুর অঞ্চলে। গবেষক রেমন্ড বলেন, “এটাই সেই দারফুর গণহত্যার শেষ অধ্যায়, যা ২০ বছর আগে শুরু হয়েছিল।”
মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের মতে, এবারের আরএসএফ অভিযান আগের তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দারফুরের জামজাম শিবিরে যেমন নির্বিচারে আগুন দেওয়া হয়েছিল, এবার এল ফাশের শহর দখলে তারা পদ্ধতিগতভাবে ব্লক ধরে ধরে অগ্রসর হচ্ছে, ঘরবাড়ি না জ্বালিয়ে দিলেও গণহত্যা চালাচ্ছে তারা।
রেমন্ড জানান, পালাতে সক্ষম হওয়া ব্যক্তিদের সাক্ষ্য থেকে জানা গেছে— পুরুষদের আলাদা করে হত্যা করা হচ্ছে, আর নারীরা ও শিশুরা লুকিয়ে আছে। তিনি বলেন, “এখন হত্যাযজ্ঞ আরও জোরালো হবে। যারা লুকিয়ে আছেন, তারাই হবেন পরবর্তী টার্গেট।”

