নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

বাংলাদেশ শনিবার। রাত ৮:১২। ৮ নভেম্বর, ২০২৫।

যশোরের বেনাপোলে সরব স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট

নভেম্বর ৮, ২০২৫ ৬:৩৩
Link Copied!

মনির হোসেন, বেনাপোল : দেশের চলমান আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রস্তুতির রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে পুঁজি করে সরব হয়ে উঠেছে সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেটগুলো। একদিকে সরকার ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও নির্বাচন কার্যক্রম ও আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণ কর্মকান্ডে ব্যস্ত। অন্যদিকে এই সুযোগ নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লগ্নি করে মাঠ চষছে রাঘোব-বোয়াল শ্রেণির স্বর্ণ চোরাকারবারি চক্র।

সরকার পতনের পর এক বছরেরও বেশি সময় ঘাপটি মেরে থাকার পর সোনা পাচার চক্র ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত ব্যবহার করে চোরাচালানীরা বেনাপোলে স্বর্ণ পাচার জোরেসোরে শুরু করেছে। অতি সম্প্রতি ও বিগত কয়েক মাসে পাচার চেষ্টার সময় অনেকগুলো স্বর্ণ চালান আটক হয়েছে। এরমধ্যে গত এক মাসে যশোর থেকে ৪৯ বিজিবি পাচার চেষ্টার সময় ৪টি চালান জব্দ করেছে।

এর আগের মাসে ১৫ টি সোনার বার উদ্ধার এবং এরও আগে আরো ৩৬টি বার উদ্ধার করে। এছাড়া চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, মহেশপুর ও বেনাপোল থেকে বিজিবি আরো ৭৭ টি বার জব্দ করে, যার মূল্য ১৫ কোটি টাকার উপরে। ওই সব অভিযানে আটকও হয়েছে পাচার চক্রের বেশ কয়েকজন সক্রিয় সদস্য।

একাধিক সূত্রের জোর দাবি, স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটে অনেক নারী সদস্যও রয়েছে। আটক উদ্ধারের পরও অপ্রতিরোধ্য সিন্ডিকেটগুলো। আবার বিশাল অংকের টাকা লগ্নি করে চলেছে নেপথ্যে থাকা রাঘোব-বোয়ালরা। সিআইডির দাবি, স্বর্ণচোরাচালান সংক্রান্ত অনেক মামলায় তদন্তে আটক ব্যক্তি ছাড়াও নেপথ্যের অনেকের নাম আসছে।

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে তথ্য মিলেছে, গত বছরে সরকার পতনের পর স্বর্ণচোরাচালান সিন্ডিকেট স্থবির হয়ে যায়। অনেক বড়বড় চক্র গা ঢাকা দেয়। আর বিরতি দিয়ে তাদের জায়গা দখল করতে থাকে অনেক নতুন সিন্ডিকেট। আর সম্প্রতি দেশে চলমান নির্বাচনী পরিস্থিতিতে দায়িত্বশীল সব সেক্টরের চোখও নির্বাচনের দিকে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকেও ব্যবহার করা হচ্ছে অন্যসব পরিস্থিতি মোকাবেলায়। আর এ সুযোগ পুঁজি করে ঘাপটি মেরে থাকা সিন্ডিকেট ও অনেক নতুন সিন্ডিকেট চোরাচালান শুরু করেছে। বিজিবিসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার ভারতীয় সীমান্ত কেন্দ্রিক সিন্ডিকেট সক্রিয় হতে থাকে। সম্প্রতি ফের সিন্ডিকেটগুলো সোনা চোরাচালানের অন্যতম পথ বা রুট হিসেবে যশোরাঞ্চলের সীমান্ত ব্যবহার করছে। এসব সীমান্তে গত ৩ মাসে অল্প অল্প দিনের ব্যবধানে দেড় ডজন সোনার চালান বিজিবি সদস্যদের হাতে আটক এবং বহনকারী আটক হয়েছে।

তথ্য মিলেছে, গত ২৩ অক্টোবর যশোরে বিজিবির অভিযানে ১৭৩.৭৬ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণের বারসহ একজনকে আটক করে। ওইদিন সকাল ১০টার দিকে সদর উপজেলার চাঁনপাড়া বাজার এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। আটক বাসার শেখ রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার পদমদি গ্রামের সোহেলের ছেলে। এ সময় তার কোমরে বিশেষ কায়দায় লুকানো অবস্থায় স্বর্ণের বারটি উদ্ধার করা হয়। যার আনুমানিক বাজারমূল্য ২৬ লাখ ৮৯ হাজার ১০৯ টাকা। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়।

এরপর গত ২৬ অক্টোবর যশোর বিজিবি অপর একটি অভিযানে মুড়লি মোড় এলাকা থেকে স্বর্ণের বার ও স্বর্ণের আংটিসহ এক পাচারকারীকে আটক করে। এদিন ভোর ৬টা ৩০ মিনিটে ৪৯ বিজিবির অধিনায়ক লেপ্টেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল্লাহ্ সিদ্দিকী, এসপিপি, পিএসসি’র সার্বিক দিক নির্দেশনায় অভিযান পরিচালিত হয়। আটক শেখ অলিউল্লা সাতক্ষীরা সদর উপজেলার মধ্য কোটিয়া গ্রামের শেখ আরিজুল্লার ছেলে। ওই অভিযানে ১ কেজি ২০ গ্রাম ওজনের ৮টি স্বর্ণের বার ও ১.৪৫ গ্রাম ওজনের ১টি স্বর্ণের আংটি জব্দ করা হয়। স্বর্ণের বারগুলো অলিউল্লাহ কোমরে বিশেষভাবে লুকিয়ে রেখছিলেন। এর আগে ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে ৫৮ বিজিবি হাজি ডিলাক্স এক্সপ্রেস বাসে অভিযান চালিয়ে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের স্বর্ণ পাচারকারী সৌরভ বিশ্বাসকে আটক করে। পরে তার সহযোগী রণজিৎ বিশ্বাস নামে একজনকে কোটচাঁদপুর বাজার এলাকা থেকে আটক করা হয়। উদ্ধার হওয়া চারটি স্বর্ণের বারের বাজারমূল্য প্রায় ৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

এদিকে মাস কয়েক আগে সাতক্ষীরা সদরের আলিপুর থেকে নাসরিন নাহার নামে এক নারী স্বর্ণ চোরাকারবারীকে আটক করা হয়। তার শরীরে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় লুকিয়ে রাখা ৬ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার হয়। যার ওজন ৫১৭ গ্রাম ৮৫ মিলি। আনুমানিক বাজার মূল্য ৭৬ লাখ ৭৪ হাজার ৫৩৭ টাকা। সাতক্ষীরা ৩৩ ব্যাটালিয়ন বিজিবি সূত্র জানায়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বাঁকাল চেকপোস্ট বিজিবি ক্যাম্পের জোয়ানরা নাসরিন নাহারকে আটক করেন। এ সময় তার দেহ তল্লাশি করে ছয়টি স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়।

৪৯ বিজিবি যশোর ব্যাটালিয়ন সূত্র আরো জানিয়েছে, গত ১৯ আগস্ট দুপুরে খুলনা-যশোর মহাসড়কের রাজারহাট বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে আফছার আলী নামে এক সোনা পাচারকারীকে আটক ৬৬৩ গ্রাম ওজনের পাঁচটি সোনার বার জব্দ করা হয়। যার বাজার মূল্য ৯৭ লাখ ৫৪ হাজার ৫৬ টাকা। এরপর গত ২১ আগস্ট সকালে খুলনা-যশোর মহাসড়কের মুড়লিমোড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে রুবেল নামে এক ব্যক্তিকে ৫ টি সোনার বারসহ আটক করা হয়।

আরও দেখুনএর আগে ১৮ আগস্ট যশোর সদরের হামিদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে অভিযান চালিয়ে আরও দুই সোনা পাচারকারীকে আটক করে বিজিবি। তাদের কাছ থেকে ৫ টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়। এরপর গত ২৮ আগস্ট কোদালিয়া বাজার এবং সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে তারাগঞ্জ বাজার এলাকায় পৃথক অভিযান পরিচালনা করে বিজিবি। এসময় আটক ব্যাক্তিদের ম্যানিব্যাগ ও কোমরে লুকানো অবস্থায় ৩৬টি স্বর্ণবার উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়াও গত ৭ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় পুকুরের পানি ছেঁকে ২১টি স্বর্ণের বার উদ্ধার ঘটনায় হইচই পড়ে যায়।

সূত্রের দাবি, উদ্ধারের বাইরেও সীমান্তের বিভিন্ন চোরাচালানি ঘাট ও আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট দিয়ে বিপুল পরিমাণ সোনারবার ভারতে পাচার শুরু করেছে চোরাকারবারী সিন্ডিকেটের সদস্য ও বহনকারীরা। সূত্র বলছে, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এসব অভিযানে শুধু বহনকারী শ্রমিকই আটক হয়েছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেটের রাঘব-বোয়ালরা। যারা সম্প্রতি বিশাল অংকের টাকা লগ্নি করে স্বর্ণ চোরাচালান করছে। যথাযথ তদন্ত না হওয়ায় নেপথ্যের গড ফাদাররা আটক হয়নি।

এদিকে সিআইডি যশোর জোনের সূত্র জানিয়েছে, মূলত ভারতের সাথে দেশের যে ৩২টি জেলার সীমান্ত রয়েছে এর মধ্যে যশোর,বেনাপোল, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর এবং কুষ্টিয়া অন্যতম। চুয়াডাঙ্গা জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা জীবননগর। আর যশোরের চৌগাছা, শার্শা, সাতক্ষীরার কলারোয়া, কালীগঞ্জ, সদর, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা, জীবননগর, মেহেরপুরের মুজিবনগর এবং কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার সাথে ভারতীয় সীমান্ত রয়েছে। দেশের অন্যান্য স্থানের সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এসব সীমান্ত এলাকার যোগাযোগ খুবই সহজ। পরিবহন ব্যবস্থাও খুব ভালো। পাশাপাশি সীমান্তের ওপারে ভারতের পশ্চিম বাংলার রাজধানী কোলকাতাও খুব কাছে। সে কারণে পাচারকারীরা এসব সীমান্ত এলাকা দিয়ে সোনা বা অন্যান্য পণ্য চোরাচালানে তুলনামূলক একটু বেশি সক্রিয় থাকে। আর আটক উদ্ধারের রেসিও অনুযায়ী সম্প্রতি চোরাচালন ফের বেড়েছে বলেও প্রতীয়মান হচ্ছে।

সিআইডি যশোর জোনের ইন্সপেক্টর তুষার কান্তি মন্ডল জানিয়েছেন, সাধারণত স্বর্ণ চোরাচালান মামলায় সোনাসহ আটককৃতদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে কিছু তথ্য আসে। আর বেশিরভাগই মুখ খুলতে চায়না। বিগত সময়ে বেশিরভাগ মামলায় সিআইডি কিংবা অন্য সংস্থা নেপথ্যের গডফাদার কারো পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। শুধু যারা স্বর্ণসহ ধরা পড়েন তাদের নাম চার্জশিটে দেখা গেছে। তবে সিআইডির কয়েকটি মামলায় একটু ব্যতিক্রম হবে বলে আশা করছেন ইন্সপেক্টর তুষার মন্ডল।

তিনি দাবি করেছেন, অনেকের সাথে কথা বলেছেন, সীমান্তের সোর্স কাজে লাগিয়েছেন। কয়েকজন গডফাদারের নামও ইতিমধ্যে শনাক্ত হয়ে গেছে। শুধু প্রমাণ পর্যন্ত অপেক্ষা। কেননা প্রথমে যার কাছে মাল পাওয়া যায় তিনি শুধু একটি চিরকুট ও সংকেতের তথ্য দিতে পারেন। এরপর হাতবদল হয় যার সাথে, তার কাছে থেকে প্রথম ব্যক্তি একটি চিরকুট ও সংকেত বিনিময় করেন। কাজেই বহনকারী বা জনেরাই আটক হচ্ছে। পরবর্তী ব্যক্তিকে আটক করা গেলে হয়তো চেহারা দেখে প্রথম বিনিময়কারী চিনতে পারেন মাত্র। বাকিরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকছে। তবে তার এই মামালাটি নিয়ে তিনি আশাবাদী। গডফাদার পর্যন্ত পৌঁছাতে চান। ইতিমধ্যে তদন্ত কাজের অগ্রগতি হয়েছে।

এদিকে, স্বর্ণচালান উদ্ধার ও অভিযানের ব্যাপারে যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেপ্টেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী জানিয়েছেন, জব্দ হওয়া চালানগুলোর বার ঢাকা থেকে সংগ্রহ করে যশোর হয়ে ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। আটককৃতরা ছাড়াও ঘটনার সাথে অন্য কেউ জড়িত আছে কিনা, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, বিজিবির বিশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী গোয়েন্দা তৎপরতা ও আভিযানিক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় যশোর ব্যাটালিয়নের দায়িত্বপূর্ণ সীমান্তবর্তী এলাকায় নিয়মিতভাবে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। স্বর্ণসহ বিভিন্ন ধরনের চোরাচালানী মালামাল জব্দ করতে সক্ষম হচ্ছে। সীমান্তে বিজিবির এ ধরনের আভিযানিক কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময়ের কথা ২৪ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন somoyerkotha24news@gmail.com ঠিকানায়।