অনলাইন ডেস্ক : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘প্রতিটি ইস্যুতে ঐক্য না হলেও জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য জরুরী’।
তিনি বলেন, ‘আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি জনগণের রায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে জাতীয় সরকার গঠন করে দেশ এবং জনগণের উন্নয়নের প্রতিটি কর্মসূচি বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে। একটি দুর্নীতিমুক্ত, নিরাপদ, মানবিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সুমহান লক্ষ্যে দেশের গণতন্ত্রকামী প্রতিটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রতিটি রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ।’
আজ মঙ্গলবার জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের শোক ও বিজয়ের প্রথম বর্ষপূর্তির বিশেষ অনুষ্ঠানে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি উদ্বোধক হিসেবে বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ সব কথা বলেন।
তারেক রহমান বলেন, ‘প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মসূচিগত পার্থক্যের কারণে ফ্যাসিবাদী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য মনে হলেও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি জাতীয় স্বার্থে আমরা সবাই এক। হাজারো শহীদের রক্তস্নাতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী এই জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে। ৫ই আগস্ট এর জ্বলন্ত উদাহরণ। প্রত্যেকটি ইস্যুতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ঐক্যমত হওয়া জরুরি নয় তবে অবশ্যই জাতীয় স্বার্থে ঐক্যমত থাকাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী দিনে আর কোন অপশক্তি যাতে বাংলাদেশকে তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করার দুঃসাহস না দেখায়, সংবিধান লঙ্ঘনকারী পতিত পরাজিত পলাতক তাবেদার অপশক্তি যাতে আর মাথা ছাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, দেশ এবং জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে আর কেউ যাতে অপতৎতাপরতা চালাতে না পারে এই ব্যাপারে ঐক্যমত্য থাকতে হবে।’
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের দল বিএনপি বিশ্বাস করে এইসব বিষয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্য অটুট রয়েছে ভবিষ্যতেও তা অটুট থাকবে ইনশাআল্লাহ।
তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আসুন প্রতিশোধ প্রতিহিংসা নয়, শহীদদের কাঙ্খিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য শুরু হোক আলোর প্রতিযোগিতা, শুরু হোক ভালোর প্রতিযোগিতা….ফ্যাসিবাদ্যের অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে গণতন্ত্রের আলোয় ফিরুক বাংলাদেশ।’
‘আমি আবারো আল্লাহর দরবারে সকল শহীদদের আত্মার মাগফরত কামনা করছি। চিকিৎসাধীন এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।’
আজ বিকাল তিনটায় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বিএনপির উদ্যোগে ‘গণঅভ্যুত্থান ২০২৪ : জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও শহীদদের সন্মানে এই বিশেষ অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ওপর নির্মিত ‘জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ বিএনপির বিভিন্ন স্তরের কয়েক হাজার নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে মিলনায়তনটি কানায় কানায় পূর্ণ ছিলো।
অতিথির প্রথম সারিতে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের নিহত শহীদ পরিবারের সদস্যরা বসেন। তাদের হাতে ছিলো শহীদ প্রাণপ্রিয় সদস্যদের নিয়ে সদস্যদের ছবি।
শহীদ পরিবারের সদস্যদেরকে বিএনপির পক্ষ থেকে ক্রেস্ট তুলে দেন বিএনপি মহাসচিব।
নির্বাচনের জন্য সরকার সক্রিয় রয়েছে উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘ফাঁসিবাদের পতনের পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের জনগণের সরাসরি ভোটে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান লক্ষে সক্রিয় রয়েছে।’
‘একই সঙ্গে রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কার কার্যক্রমের পাশাপাশি বিতাড়িত ফ্যাসিস্টদের বিচার কার্যক্রমও শুরু করেছে। রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে সংস্কার ও বিচার কার্যক্রম চলমান প্রক্রিয়া। রাষ্ট্র এবং সমাজে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নিশ্চিত রাখার স্বার্থে জনরায় নির্বাচিত ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক সরকারও পরবর্তীকালীন সরকারের শুরু করা কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। সুতরাং একটি ইস্যুকে আরেকটি ইস্যুর সঙ্গে শর্তের বেড়াজেলে আবদ্ধ না করে ফেলা যৌক্তিক বলে গণতন্ত্রকামী জনগণ বিশ্বাস করে বা মনে করে।’
সংখ্যানুপাতিক ভোট প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, ‘ কোন কোন রাজনৈতিক দল সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থার দাবি তুলেছেন। বিশ্বের কোন কোন দেশে সংখ্যাক নির্বাচনী ব্যবস্থার বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় এবং ভৌগোলিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই মুহুর্তে বাংলাদেশের জন্য এই ব্যবস্থাটি কতটুকু উপযোগী অথবা উপযোগী কিনা সেটি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখার জন্য আমি সকলের প্রতি অনুরোধ রাখবো।’
‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থাকে শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত রাখতে হলে বাংলাদেশকে তাবেদার মুক্ত রাখতে হলে এই মুহুর্তে জনগণের ঐক্য সবচাইতে বেশি প্রয়োজন। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা দেশে ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তিমূলক সমাজ এবং অস্থিতিশীল সরকার সৃষ্টির কারণ হয়ে উঠতে পারে কিনা এই বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে আরো একবার ভেবে দেখার জন্য আমি সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিনীত আহবান এবং অনুরোধ করব। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থার আড়ালে পুনরায় দেশের রাজনীতিতে নিজেদের অজান্তেই পতিত পরাজিত অপশক্তি পুনর্বাসনের পথ সুগম কারণ করে দেওয়া হচ্ছে কিনা এ বিষয়টিও আমাদের প্রত্যেকের অত্যন্ত সিরিয়াসলি ভাবা দরকার।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি নিত্য নতুন ইস্যু যদি আমরা সামনে নিয়ে আসতে থাকি এর সুযোগে ষড়যন্ত্রকারীরা আবারো মাথা চাড়া দেয়ার সুযোগ পাবে।’
তারেক রহমান বলেন, ‘যেযসব বীর সন্তানরা বাংলাদেশের জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। যেসব মানুষগুলো চোখ হারিয়ে চিরতরে অন্ধ হয়ে গিয়েছেন। হাত পা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। মাসের পর মাস অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তাদের এই আত্মত্যাগকে বিবেচনায় নিয়ে আমি বিএনপিসহ বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং সমর্থক শুভাকাঙ্ক্ষীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি আহ্বান জানিয়ে বলতে চাই আসুন আমরা যিনি যার ইচ্ছামতন শর্তের তালিকা না বাড়িয়ে শহীদদের চেতনায় বাংলাদেশকে উপলব্ধি করি।’
‘চোখ হারানো যোদ্ধার অন্তদৃষ্টি দিয়ে বাংলাদেশকে দেখার চেষ্টা করি চিকিৎসাধীন এবং আহতদের আর্তনাদ এর সঙ্গে একত্রত হয়ে শহীদদের আকাঙ্ক্ষার আলোয় বাংলাদেশকে আমরা গড়ে তুলি।’
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান, শোক ও বিজয়ের বর্ষপূর্তি পালন কমিটির আহ্বায়ক বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সভাপতিত্বে এবং অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন ও অধ্যাপক নাহরিন খানের যৌথ পরিচালনায় আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, সালাহ উদ্দিন আহমদ, জাতীয় পার্টি(কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জাতীয় গণফ্রন্টের টিপু বিশ্বাস, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, নেজামী ইসলাম পার্টির একেএম আশরাফুল হক, এবি পার্টির মজিবুর রহমান মঞ্জু, এনসিপির আজিজুর ইসলাম আদিব, হেফাজতে ইসলামের মাওলানা জোনায়েদ আল হাবিব,এনডিএমের ববি হাজ্জাজ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মাওলানা মঞ্জরুল হক আফেন্দি, বাংলাদেশ জাসদের নাজমুল হক প্রধান, খেলাফত মজলিশের মাওলানা আহমেদ আলী কাশেমী, গণঅধিকার পরিষদের রাশেদ খান এবং জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান, শোক ও বিজয়ের বর্ষপূর্তি পালন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান বক্তব্য রাখেন।
এই অনুষ্ঠানে গুম হওয়া ইলিয়াস আলীর সহধর্মিনী তাহসিনা রশদীর লুনা, ফ্যাসিবাদ সরকারের আমলে নির্যাতনের শিকার চিকিৎসক সাখাওয়াত হোসেন সায়ান্থ, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময়ে পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাইদের ভাই রমজান আলী, মীর মুগ্ধের বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান, ওয়াসীমের বাবা শফিউল আলম, ইয়ামিনের বাবা মহিউদ্দিন, ফারহান ফাইয়াজের ছোট বোন ফারিন, আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ, পুরানা ঢাকায় বিশ্বজিৎ দাশের বাবা আনন্দ দাস, আবদুল্লাহ বিন জাহিদের মা ফাতেমাতুজ জোহরা, নুরুজ্জামান জনির ছোট ভাই মনিরুজ্জামান হীরা, পারভেজ হোসেনের মেয়ে আবিদা ইসলাম হৃদি, কাজী ফাহমীম জাফরের মা কাজী লুলুল মাকমিম, গুম থেকে বেঁচে যাওয়া বিএনপি গণশিক্ষা বিষয়ক সহ-সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকার খোকন এবং ‘মায়ের ডাক’ এর আহ্বায়ক সানজিদা ইসলাম তুলি, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গু নাভিল, পুলিশের গুলিতে চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়া রেদোয়ান হোসেন রিয়াদ বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, এজেডএম জাহিদ হোসেন, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, ন্যাপ ভাসানীর আজহারুল ইসলাম, বিএলডিপির শাহাদাত হোসেন সেলিম, কল্যাণ পার্টির শামসুদ্দিন পারভেজ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মুফতি মহিউদ্দিন ইকরামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন পেশার নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।-বাসস