নিজেই অনুষ্ঠানের প্রধান আয়োজক, নিজেই প্রধান অতিথি! আয়োজকের কেউ কেউ আবার বিশেষ অতিথি! বাংলাদেশের সভা-সমাবেশে প্রচলিত এমন অদ্ভুত রীতির সঙ্গে আমরা দীর্ঘদিন থেকে পরিচিত। বিষয়টি হাস্যকর হলেও এটি এখন আমাদের সংস্কৃতির অংশ। সভা-সমাবেশে প্রচলিত আরও কিছু অসংগতি রয়েছে। শুধু আমাদের চিন্তাশক্তি ও ভাষাজ্ঞানকে কাজে লাগালে এসব অসংগতি দূর করা সম্ভব।
সভা-সমাবেশের মূল উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেওয়া কিংবা অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করা। কিন্তু সভা-সমাবেশের আড়ালে মর্যাদা ও কর্তৃত্ব প্রদর্শনের এক ধরনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সরকারি-বেসরকারি দপ্তর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক অঙ্গন—সবখানেই রয়েছে এই প্রবণতা। কোথাও কম, কোথাও বেশি। এই প্রবণতা এখন প্রথায় পরিণত হয়েছে।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে—কীভাবে এমন অসংগত প্রথার জন্ম হলো? এর উত্তর হয়তো লুকিয়ে আছে আমাদের মানসিক গড়নে। আমরা শব্দের বৈচিত্র্য তৈরি করতে পারিনি। ‘প্রধান অতিথি’ ও ‘সভাপতি’ ছাড়া আর কোনো সমার্থক পরিভাষা আমাদের মাথায় কখনো আসেনি। ফলে একবার চালু হয়ে যাওয়া পরিভাষা আজ প্রথায় পরিণত হয়েছে। আরেকটি কারণ হচ্ছে, আমাদের প্রথা মেনে চলার মানসিকতা। কোনো কিছু একবার প্রচলিত হলে আমরা তা যুক্তি দিয়ে বিচার না করে অন্ধভাবে মেনে নিই। ফলে আয়োজকের অতিথি সাজার মতো হাস্যকর পরিস্থিতিও আমাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আয়োজকদের অতিথি হওয়ার হাজারো ঘটনা বলে শেষ করার মতো নয়। জেলাপ্রশাসন আয়োজিত সভায় দেখা যায়, জেলাপ্রশাসকই প্রধান অতিথি; অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক সভাপতি। কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে অধ্যক্ষ প্রধান অতিথি; উপাধ্যক্ষ সভাপতি। যেখানে নবীন শিক্ষার্থীরাই অতিথি হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা, সেখানে অধ্যক্ষের প্রধান অতিথি হওয়া বড়োই বেমানান। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরেও একই অবস্থা। কোনো অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তাঁর নিজের পাশের কক্ষে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হয়ে যান। অথচ তিনি নিজেই মতবিনিময় সভার মূল আয়োজক। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশেও একই দৃশ্য। কোনো রাজনৈতিক দলের উপজেলা পর্যায়ের সমাবেশে প্রধান অতিথি থাকেন ওই রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্ট উপজেলা শাখার সভাপতি। এটি নিজের ঘরে নিজেকে অতিথি ভাবার মতো অদ্ভুত এক প্রথা।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন—এই প্রথা থেকে বের হওয়ার উপায় কী? চিন্তাশক্তি ও ভাষাজ্ঞানকে কাজে লাগালে উপায় বের করা সম্ভব। সভা-সমাবেশের ব্যানারে ‘প্রধান অতিথি’র বিকল্প হিসেবে ‘সভাপ্রধান’ শব্দটি ব্যবহার করা যেতে পারে। ‘প্রধান অতিথি’ অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। তাই, তাঁকে ‘সভাপ্রধান’ বলা খুবই সংগত। অনুরূপভাবে ‘সভাপতি’র পরিবর্তে ‘আহ্বায়ক’ কিংবা ‘সভা-আহ্বায়ক’ ব্যবহার করা যেতে পারে। ‘বিশেষ অতিথি’র পরিবর্তে লেখা যেতে পারে ‘বিশেষ আলোচক’ বা ‘বিশেষ বক্তা’। কোনো অনুষ্ঠানের ব্যানারে অতিথিদের নাম ‘উপস্থিত থাকবেন’ শিরোনামেও লেখা যেতে পারে। আলোচনাসভার ক্ষেত্রে প্রধান অতিথিকে বলা যেতে পারে ‘প্রধান আলোচক’ বা ‘মুখ্য আলোচক’। তবে সেক্ষেত্রে তাঁকে অবশ্যই আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। এতে একদিকে পরিভাষার স্বচ্ছতা আসবে, অন্যদিকে অযৌক্তিক আড়ম্বরও কমবে। সভা-সমাবেশের ব্যানারে ‘প্রধান অতিথি’, ‘বিশেষ অতিথি’ এবং ‘সভাপতি’র পরিবর্তে অন্য কোনো শোভন পরিভাষাও ব্যবহার করা যেতে পারে।
আমাদের দেশে আরেকটি ভ্রান্ত শব্দপ্রয়োগ হলো ‘আমন্ত্রিত অতিথি’। বাস্তবতা হলো, অনুষ্ঠানে প্রত্যেক অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রণ ছাড়া কোনো অতিথি সাধারণত অনুষ্ঠানস্থলে আসেন না। তাই আলাদা করে ‘আমন্ত্রিত অতিথি’ বলা বা লেখার কোনো মানে হয় না।
সভা-সমাবেশের ব্যানারে যে প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি ও সভাপতি লেখা যাবে না—বিষয়টি কিন্তু সে রকম নয়। কোনো অনুষ্ঠানে যদি কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তিনি যদি অনুষ্ঠান আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত না থাকেন, তাহলে তাঁকে প্রধান অতিথি কিংবা বিশেষ অতিথি রাখা যেতে পারে। আয়োজকদের মধ্য থেকে প্রধান আয়োজক বা অন্য কেউ সভাপতি হতে পারেন। অনুষ্ঠানের ধরন বিবেচনায় ব্যানারে স্বাগত বক্তা, সঞ্চালক ও মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকারীর নাম লেখার যৌক্তিকতাও রয়েছে। তবে, প্রধান অতিথি ও সভাপতি ছাড়া সভা-সমাবেশ করা যাবে না—এ ধারণা থেকে বের হতে হবে। প্রধান অতিথি কিংবা সভাপতি ছাড়াও সভা-সমাবেশ করা সম্ভব। একজন উপস্থাপক কিংবা সঞ্চালক দিয়েও সভা-সমাবেশ চালিয়ে নেওয়া যায়।
সভা-সমাবেশের আরেকটি জটিল বিষয় হলো, অতিথিদের নাম নির্বাচন। ব্যানারে কাদের নাম থাকবে, কাদের নাম থাকবে না—এ নিয়ে আয়োজকদের প্রায়ই বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। অতিথিদের নামের ক্রম নির্ধারণেও অনেক সময় জটিলতা সৃষ্টি হয়। জটিলতা এড়াতে কখনো কখনো ব্যানারে কারও নাম রাখা হয় না। তবে একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, একজনকে সম্মানিত করতে গিয়ে অন্যরা যেন অসম্মানিত না হন।
সভা-সমাবেশে বক্তার আধিক্য নিয়েও কখনো কখনো জটিলতা সৃষ্টি হয়। বক্তার আধিক্য সভা-সমাবেশের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত করে। বক্তাদের দীর্ঘ বক্তৃতা শ্রোতাদের বিরক্তির উদ্রেক করে। এর ফলে বক্তাদের কোনো বার্তাই শ্রোতাকে স্পর্শ করতে পারে না। তাই, অনুষ্ঠানে বক্তার সংখ্যা একটা যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা প্রয়োজন।
সভা-সমাবেশের ব্যানারে অতিথিদের নামের আগে ‘জনাব’ লেখার কোনো প্রয়োজন আছে কি না— সেটিও ভেবে দেখা যেতে পারে। কেবল নাম ও পদবি লেখাই যথেষ্ট নয় কি? সভা-সমাবেশে সবার শেষে সভাপতির বক্তব্য দেওয়ার প্রথাও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ, প্রধান অতিথির বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর শ্রোতাদের মনোযোগ অনেকাংশেই ফুরিয়ে যায়। রাজনৈতিক জনসভার ক্ষেত্রে প্রধান অতিথির বক্তৃতা শেষ হওয়ার পরপরই অংশগ্রহণকারীরা দল বেঁধে চলে যান। এসব ক্ষেত্রে প্রধান অতিথির বক্তৃতার আগেই সভাপতির বক্তৃতা দেওয়া উচিত। এতে অনুষ্ঠানের শৃঙ্খলা বজায় থাকবে।
সভা-সমাবেশে প্রধান অতিথির অনুপস্থিতিতে প্রতিনিধি প্রেরণের প্রথাও চালু রয়েছে। প্রতিনিধি যদি প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন এবং তিনি যদি অন্যান্য অতিথির চেয়ে নিম্নপদস্থ হন, সেক্ষেত্রে অতিথিদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি ও অসন্তোষ দেখা দেয়। প্রধান অতিথির প্রতিনিধি প্রেরণের প্রথাও বন্ধ হওয়া উচিত। প্রধান অতিথির প্রতিনিধি শুধু তাঁর বার্তা বহন করতে পারেন; কিন্তু তাঁর আসন অলংকৃত করতে পারেন না।
অনুষ্ঠানে ‘ভারপ্রাপ্ত প্রধান অতিথি’ করার প্রথাও চালু রয়েছে। অনেক সময় প্রধান অতিথির অনুপস্থিতিতে সভাপতি কিংবা কোনো বিশেষ অতিথিকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রধান অতিথি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটি সমীচীন নয়। এই প্রথা থেকেও বের হওয়া উচিত। এর পাশাপাশি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার সংস্কৃতিও বন্ধ করা প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে কারও সম্পর্কে বিশেষণ ব্যবহারে খুব সতর্ক থাকা উচিত। অতিরিক্ত বিশেষণ অনেক সময় হাস্যরসের সৃষ্টি করে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বক্তার নামের আগে অনেক সময় ‘কোকিলকণ্ঠী’ বিশেষণ ব্যবহার করা হয়। যা অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, মানুষের কণ্ঠের সঙ্গে কোকিলের কণ্ঠ তুলনীয় নয়। এ ধরনের বিশেষণ বক্তার মর্যাদার জন্য হানিকর। যেসব বিশেষণ ব্যবহার করা যুক্তিসংগত, কেবল সেসব বিশেষণ ব্যবহার করা উচিত। বক্তব্যে সম্ভাষণের ক্ষেত্রেও আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। অনেকেই সম্ভাষণে অতিথিদের নাম, পদবি ও বিশেষণ বলতে গিয়ে দুই-তিন মিনিট নষ্ট করেন। যা শ্রোতাদের জন্য বিরক্তিকর। এক-দুই বাক্যে সম্ভাষণ শেষ করাই সংগত ও শোভনীয়।
সভা-সমাবেশ কেবল প্রাতিষ্ঠানিক রীতি নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেকোনো ধরনের সভা-সমাবেশের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি শৃঙ্খলিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা প্রয়োজন। সভা-সমাবেশে যেমন জ্ঞানচর্চা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ তৈরি হয়, তেমনি সমাজের শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্যও প্রতিফলিত হয়। আয়োজকের অতিথি হওয়ার প্রবণতাসহ অন্যান্য অসংগতি সভা-সমাবেশের সেই সৌন্দর্য নষ্ট করছে। এসব অসংগতি সংশোধন করার সময় এসেছে।
সভা-সমাবেশ হতে পারে সমাজের পরিবর্তনের সূচনা-ক্ষেত্র। যেখানে আয়োজক থাকবেন আয়োজকের আসনে, অতিথি থাকবেন অতিথির মর্যাদায়। আর ব্যানার ও অনুষ্ঠানের ভাষা হবে শোভন ও যথাযথ। অযৌক্তিক প্রথার পরিবর্তে যুক্তি ও বাস্তবতানির্ভর নতুন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারলেই আমাদের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক জীবন হবে মর্যাদাপূর্ণ। একদিন হয়তো আমরা এমন সভা-সমাবেশের সাক্ষী হব, যেখানে কেউ নিজেকে অতিথি ভাবার চেষ্টা করবেন না, থাকবে না অযথা আড়ম্বর। সভা-সমাবেশের মূল উদ্দেশ্য হবে শ্রোতার কাছে বার্তা পৌঁছানো। যার মাধ্যমে সমাজে সৃজনশীলতা, ন্যায্যতা ও মূল্যবোধ আরও মজবুত হবে।
লেখক : মো. মামুন অর রশিদ
বিসিএস তথ্য ক্যাডারের সদস্য এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে কর্মরত
(পিআইডি ফিচার)