চীন, জাপান, ভারত, সিঙ্গাপুর নয়- যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালী, বেলজিয়ামের মত পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোকে পেছনে ফেলে লিঙ্গ সমতার র্যাংকিংয়ে উপরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। গত ১১ জুন বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ-২০২৫’ শীর্ষক যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, সেখানে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির এ চিত্র উঠে এসেছে।এ ফোরামের ২০২৫ সালের বৈশ্বিক লিঙ্গ বৈষম্য সূচকে ৭৭ দশমিক ৫০ শতাংশ লিঙ্গ সমতা স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ আবারও দক্ষিণ এশিয়ায় লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে অগ্রণী দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বৈশ্বিক লিঙ্গসমতার সূচকে ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯৯তম। গত বছর বার্ষিক এই সূচকে বাংলাদেশের ৪০ ধাপ অবনতি ঘটেছিল। আর ২০২৫ সালের সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে ৭৫ ধাপ ! এটি নজিরবিহীন ! প্রতিবেদনে সৌদি আরব, মেক্সিকো, ইকুয়েডর এবং ইথিওপিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশকে সকল আয়ের স্তরে লিঙ্গ বৈষম্য কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর অর্থনীতির দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যারা বিশ্বের শীর্ষ ৫০ এর মধ্যে স্থান পেয়েছে, যা লিঙ্গ বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে তার অব্যাহত অগ্রগতির প্রতিফলন। প্রতিবেদন অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়া, একটি অঞ্চল হিসেবে, আটটি বৈশ্বিক অঞ্চলের মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছে, যার সামগ্রিক সমতা স্কোর ৬৪ দশমিক ৬০ শতাংশ।
যদিও এই অঞ্চলটি সিনিয়র নাগরিকদের, পেশাদার ও কারিগরি কর্মীদের, অর্থনৈতিক প্রতিনিধিত্বে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবুও চ্যালেঞ্জগুলি এখনও রয়ে গেছে। আনুমানিক অর্জিত আয়ের সমতা ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ পয়েন্ট হ্রাস পেয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে, দক্ষিণ এশিয়া ৯৫ দশমিক ৪০ শতাংশ সমতা স্কোর পেয়ে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। তবে, তীব্র বৈষম্য রয়ে গেছে — নেপাল এবং পাকিস্তান সাক্ষরতার সমতা স্কোরের রিপোর্ট করেছে ৭৫ শতাংশের নিচে, মালদ্বীপে সম্পূর্ণ সমতার বিপরীতে। এই অঞ্চলের স্বাস্থ্য এবং বেঁচে থাকার স্কোর ৯৫ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, জন্মের সময় লিঙ্গ অনুপাতের ১-পয়েন্ট হ্রাসের ফলে সুস্থ আয়ুষ্কালের সামান্য উন্নতি হয়েছে। রাজনৈতিক দিক থেকে, দক্ষিণ এশিয়া ২৬ দশমিক ৮০ শতাংশ স্কোর নিয়ে বিশ্বব্যাপী চতুর্থ স্থানে রয়েছে।
২০০৬ সালে এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ বেসলাইন ছিল ২১ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং এরপর থেকে এটি ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, বাংলাদেশই এই ব্লকের একমাত্র দেশ যারা রাষ্ট্রপ্রধান পর্যায়ে রাজনৈতিক সমতা অর্জন করেছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের গবেষণা অনুসারে, বিশ্বব্যাপী লিঙ্গ বৈষম্য কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, যা ২০২৪ সালে ৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে উন্নত হয়ে ২০২৫ সালে ১৪৮টি অর্থনীতিতে ৬৮ দশমিক ৮০ শতাংশ হয়েছে। তবে, অগ্রগতির গতি মহামারী-পূর্ব প্রবণতার তুলনায় ধীর রয়ে গেছে এবং বর্তমান হারে, আরও ১৩২ বছর ধরে পূর্ণ লিঙ্গ সমতা আশা করা যায় না। উচ্চ-আয়ের অর্থনীতির দেশগুলি গড়ে তাদের লিঙ্গ বৈষম্যের ৭৪ দশমিক ৩০ শতাংশ পূরণ করেছে। তবুও, প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে নিম্ন-আয়ের শ্রেণীতে সেরা পারফরম্যান্সকারীরা – যেমন বাংলাদেশ – বাস্তব অর্জনের দিক থেকে অনেক ধনী দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়াও, ভারত ১৩১তম স্থানে নেমে এসেছে, প্রতিবেশী দেশ ভুটান (১১৯তম), নেপাল (১২৫তম) এবং শ্রীলঙ্কা (১৩০তম) এর পরে।
পাকিস্তান (১৪৮তম), সুদান (১৪৭তম) এবং চাদ (১৪৬তম) এর মতো দেশগুলি সূচকের নিচে রয়েছে, ব্যাপক লিঙ্গ বৈষম্যের সাথে লড়াই করে চলেছে। ২০২৫ সালের র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকা আইসল্যান্ড টানা ১৬তম বছরের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে লিঙ্গ-সমতার দেশ হিসাবে তার অবস্থান ধরে রেখেছে, তার লিঙ্গ বৈষম্যের ৯২ দশমিক ৬০ শতাংশ – ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়া একমাত্র দেশ। শীর্ষস্থানীয় অন্যান্য দেশগুলির মধ্যে রয়েছে ফিনল্যান্ড, নরওয়ে এবং যুক্তরাজ্য। এরপরও প্রশ্ন আছে, প্রায় অর্ধেক ভোটার যে দেশের নারী সমাজ সেখানে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে এদেশের রাজনৈতিক দলের অঙ্গীকার কতটা? সংসদ বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারী প্রতিনিধিত্ব আসে সংরক্ষিত আসন থেকে, দলের পছন্দ অনুসারে। নারী সমাজ মনে করে, এখানে অস্বাভাবিক স্বজন প্রীতি হয়। প্রকৃত নেতৃত্ব উঠে না। এজন্য নারী সমাজ জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে দল থেকে মনোনয়ন আশা করে, যেখানে তারা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৯ জন নারী নির্বাচিত হয়েছেন। সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থী ছিলেন ৯৬ জন। এর মধ্যে ১৫ জন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদের নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৬৯ নারী প্রার্থী সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২২ জন নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেটাই ছিল সর্বোচ্চ সংখ্যক নারী নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড। ১৯৭৯ সালে প্রথম একজন নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৮৬ সালে পাঁচ জন, ১৯৮৮ সালে চার জন নারী সরাসরি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে ৩৯ প্রার্থীর মধ্যে পাঁচ জন, ১৯৯৬ সালে ৩৬ প্রার্থীর মধ্যে আট জন, ২০০১ সালে ৩৮ প্রার্থীর মধ্যে ছয় জন, ২০০৮ সালে ৫৯ প্রার্থীর মধ্যে ১৯ জন, ২০১৪ সালে ২৯ প্রার্থীর মধ্যে ১৮ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত হন।
সুতরাং নারী সংসদ সদস্য পেতে হলে সব দলের কমিটমেন্ট থাকতে হবে, তাদের মনোনয়ন দিতে হবে, রাজনীতির মাঠে জায়গা করে দিতে হবে। নারী নেতৃবৃন্দের যোগ্যতা নেই বা আর্থিক সামর্থ্যের ঘাটতি রয়েছে এমনটা মনে হয় না। বাংলাদেশে নারী নেতৃত্ব স্বাধীনতার আগে থেকেই শুরু হয়েছে। প্রত্যেকটা দলের মহিলা সংগঠন আছে। আন্দোলন সংগ্রামে তারাও জোরালো ভূমিকা পালন করে। এখন প্রয়োজন দলগুলোর সদিচ্ছা। এর মধ্যে একটা দলের সিনিয়র নেতা নারী সংসদ সদস্যের সংরক্ষিত আসনের পরিবর্তে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখার দাবি জানান। সংসদে নারীদের সংরক্ষিত আসনের নামে সব পক্ষকে খুশি রাখা, স্বজনপ্রীতি করা, প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া; নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন থেকে নারীকে দূরে রাখার অপ্রত্যাশিত বিভিন্ন প্রক্রিয়া বলে তিনি মন্তব্য করেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সব কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, এ লক্ষ্য অর্জন করার কথা ছিল ২০২০ সালের মধ্যে। তবে তা না পারায় সময় ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সন্নিকটে। বাংলাদেশ এবছর লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণে দুর্দান্ত সাফল্য দেখিয়েছে। নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে একই রকম সাফল্য দেখাবে-এমন প্রত্যাশা।
লেখক:মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান
সিনিয়র উপপ্রধান তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর
পিআইডি ফিচার