নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

ঢাকা মঙ্গলবার। রাত ৩:২২। ৫ আগস্ট, ২০২৫।

হামলার পর ফাঁকা বাগসারা সাঁওতালপাড়া

আগস্ট ৪, ২০২৫ ১০:৫২
Link Copied!

স্টাফ রিপোর্টার : একটি হামলার পর ফাঁকা হয়ে গেছে রাজশাহীর পবা উপজেলার বাগসারা গ্রামের একটি সাঁওতালপাড়া। পাড়াটিতে মোট ১২টি বাড়ি থাকলেও সোমবার (৪ আগস্ট) দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, কেবল এক বৃদ্ধা ছাড়া কোন বাড়িতে আর কেউ নেই। বেশ কয়েকটি বাড়ি ভাঙচুর করা অবস্থায় পড়ে আছে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঘরের জিনিসপত্র।

বারনই নদীর তীরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পুলের ওপর প্রায় পাঁচ বছর আগে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ১২টি পরিবার এই পাড়ায় ঘর তৈরি করেন। এর মধ্যে সাতটি সাঁওতাল, চারটি ধাঙ্গড় (ওরাঁও) ও একটি রবিদাস সম্প্রদায়ের পরিবার। পাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বারনই নদী। নদীর পরেই মো. বাবলু নামের এক বিএনপিকর্মীর জমি। এই জমির সামনের জায়গায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিবারগুলো বসবাস করায় তিনি আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন। যদিও এই জায়গা পাউবোর।

গত বুধবার (৩০ জুলাই) সকালে বাবলুর সঙ্গে পাড়াবাসীদের হাতাহাতি হয়। এরপর দুপুর ও সন্ধ্যায় দুই দফা হামলা হয় পাড়াটিতে। এর পরপরই লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়।

পুলের পাশে সারি সারি ১২টি বাড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের। সোমবার সকালে পাড়ায় ঢুকে প্রথম বাড়িটিতেই যাওয়া হয়। কিন্তু কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। পরের বাড়িটি হিমেন রবিদাসের। বাড়িতে ছিলেন তার শ্বাশুড়ি অমলা দাসী। তিনি জানালেন, তার বাড়ি নওগাঁর নিয়ামতপুরে। ১৫ দিন আগে তিনি চিকিৎসার জন্য এখানে এসেছেন। তিনি হাঁটতে পারেন না। এই বাড়িতে থেকেই রাজশাহীতে চিকিৎসা করাচ্ছেন। অমলা বলেন, ‘কয়দিন আগে গন্ডগোল হয়েছে। তারপর তো কেউ নাই। আমি চলতে পারি না, আছি।’

আরও পড়ুনঃ  রাজধানীর গুলিস্তানে সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটে আগুন নিয়ন্ত্রণে

হিমেনের পরের বাড়িটিতেও কেউ নেই। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাড়ির জিনিসপত্র। ঘরের দেয়ালে টানানো আছে বিদ্যুৎ বিলের বেশকিছু কাগজ। একটি কাগজে দেখা যায়, বাড়িটির মালিক শ্যামল মুর্মু। তিনিই এই সাঁওতালপাড়ার সর্দার। শ্যামলের পরের বাড়িটিও একইভাবে তছনছ অবস্থায় দেখা যায়। এ বাড়ির দেয়ালেও বিদ্যুৎ বিলের কপিগুলো টানানো। একটি কপি নিয়ে দেখা যায়, এই বাড়ির মালিকের নাম বেরজন টুডু। বিলের কপিতে মোবাইল নম্বরও আছে। সেই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

বেরজন টুডুর পরের বাড়িটির দরজা বন্ধ। কয়েকবার ডেকেও ভেতর থেকে কারও সাড়া পাওয়া গেল না। পরের বাড়ির ঘরের টিনে হামলার চিহ্ন স্পষ্ট। টিন ফুটো হয়ে গেছে। বাইরে থেকেই ঘরের ভেতর দেখা যাচ্ছে। বিছানায় এখনও মশারি টানানো। ঘরে শুয়ে দুটি কুকুর। বাইরে থেকে টিনের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতেই ঘেউ ঘেউ করে একটি কুকুর বাড়ির বাইরে এল।

পাড়ার ৭ ও ৮ নম্বর বাড়ির দরজা বাঁশের বাতা দিয়ে তৈরি। তাতেই ছোট ছোট দুটি তালা লাগানো। পরের বাড়িটির ঘরের মাটির দেয়াল ভাঙা। বাইরে থেকেই দেখা গেল, মেঝেতে পড়ে আছে জিনিসপত্র। হাড়িতে ভাত ছিল। কয়েকদিন সে ভাত পচে গেছে। পাড়ার ১০ নম্বর বাড়িটিতে কোন তালা নেই। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, ঘরে তালা দেয়া। বারান্দায় দড়িতে ঝুলছে কাপড়চোপড়। পাড়ার অন্য দুটি বাড়িতেও তালা লাগানো। কেউ নেই।

আরও পড়ুনঃ  কাঠগোলাপের মাঝে নিজেকে খুঁজে পেলেন প্রভা

সুনশান এ এলাকার পুলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক ব্যক্তি। তিনি জানালেন, তিনি ভ্যান চালান। এলাকায় থাকেন না। হামলার পর তিনি শুনেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমে বাবলুর সাথে সাঁওতালদের হাতাহাতি হয়। পরে দুপুরে এবং সন্ধ্যায় দুদফা হামলা হয়েছে। বিকেলের হামলায় দলের লোকজন ছিল। কোন দল জানতে চাইলে তিনি তা বলতে চাননি।

ওই এলাকায় পাওয়া যায় বিএনপিকর্মী বাবলুর স্ত্রী ডলি বেগমকে। তিনি বলেন, ‘ওরা আমাদের জমির সামনে বাড়ি করেছে, খুব অত্যাচার করে। মদ খেতে নিষেধ করায় আমার স্বামীকে মেরেছে। পরে আমার স্বামীও লোকজন নিয়ে আসে। কিন্তু কাউকে মারেনি। ওরাই ভয়ে পালিয়ে গেছে।’ ঘরবাড়ি ভাঙচুরের বিষয়ে ডলি দাবি করেন, ‘ওরাই নিজেরাই ভেঙেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ এসে বলেছে, সাঁওতালরা থাকবে, কেউ কিছু বলবে না। এতই যদি দরদ হয়, তাহলে এদের নিয়ে গিয়ে বাড়ি করে দিক।’

মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয় এই পাড়ার সর্দার শ্যামল মুর্মুর সঙ্গে। তিনি জানান, আগে তাঁরা রাজশাহীর গোদাগাড়ীর পাকড়ি এলাকায় থাকতেন। কৃষিকাজের জন্য বাগসারা এলাকায় আসতেন। দূরত্বের কারণে স্থানীয় তিন কাউন্সিলরের পরামর্শে তাঁরা পাউবোর এই জায়গায় ঘর তোলেন। হামলার পর যে যেদিকে পেরেছেন চলে গেছেন।

আরও পড়ুনঃ  আমরা এখনো রপ্তানিমুখী শিল্পে বৈচিত্র্য আনতে পারিনি : সাখাওয়াত হোসেন

শ্যামল জানান, ‘ঘটনার দিন বাবলু পাড়ার এক নারীকে খারাপ ভাষায় গালি দিচ্ছিল। নিষেধ করায় সে ওই নারীকে মারে। তখন আমাদের যুবকরাও তাকে একটু মারে। এরপর বিকেলে বাবলু লোকজন নিয়ে এসে আমাদের তিনজনকে মারে। পরে পুলিশ এসে সবাইকে শান্ত থাকার কথা বলে চলে যায়। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই বাবলু আবার লোকজন নিয়ে এসে আমাদের ওপর হামলা করে। তাদের সঙ্গে হাঁসুয়া, বল্লম, ছোরা ছিল।’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমার নিজের বাড়ি থেকে ১০ হাজার টাকা, ২৫টি কবুতর লুট হয়েছে। কেউ কিছু নিয়ে পালাতে পারেনি। হরি আর তার বাড়িওয়ালি ১২ হাজার টাকাসহ বস্তায় জিনিসপত্র ভরে পালাতে গেলে পথ থেকে সেটাও কেড়ে নেয়া হয়েছে। আমরা এখনো ভয়ে আছি।’

সাঁওতালদের পক্ষ থেকে থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরাফাত আমান আজিজ বলেন, বিষয়টি জানার পর থানার ওসিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

পবা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘উভয় পক্ষই থানায় অভিযোগ দিয়েছে। সাঁওতালদের কয়েকজন আহত হয়েছেন। মামলা করতে বলা হয়েছে, কিন্তু কেউ এখনো মামলা করেনি। মামলা না করলে তো আমরা কিছু করতে পারি না।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময়ের কথা ২৪ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন somoyerkotha24news@gmail.com ঠিকানায়।