পিন্টু আলী , চারঘাট (রাজশাহী): রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল কাদের (৫৭) ডুবে যাওয়া আমন বীজতলা থেকে চারা তুলছিলেন। তিনি বলছিলেন, সাড়ে ছয় বিঘা জমিতে আমন আবাদ করবো কিন্তু সব জমিতে এখন কোমর সমান পানি।বীজতলাতেও হাঁটুপানিতে অধিকাংশ চারা ডুবে গেছে। যেটুক অবশিষ্ট আছে সেটুকুর চারা তুলে রাখতে চেষ্টা করছি। জলাবদ্ধতায় বীজতলা নষ্ট হওয়ায় জমির পানি নেমে গেলেও এত চারা টাকা দিয়ে কিনে আমন আবাদ করা সম্ভব হবেনা৷
শুধু আব্দুল কাদের নয়, উঁচু ভূমি হিসাবে পরিচিত বরেন্দ্র অঞ্চল চারঘাটের বিলগুলোতে এবার হাজারো কৃষকের আমন চাষে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত পুকুর খনন, খাল দখল ও কালভার্টের মুখ বন্ধের কারণে এলাকার বিলগুলো পানির নিচে ডুবে আছে। অনেক এলাকার বসত বাড়িতেও জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থায় কৃষকেরা শ্যালো মেশিন দিয়ে ও নিজ উদ্যোগে নালা কেটে বিলের পানি সরানোর চেষ্টা করছেন।
উপজেলা কৃষি অফিসের দাবি, পানি না সরলে অন্তত ৮০০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবে আগষ্ট মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যে পানি সরলেও কৃষকেরা সেখানে আমন রোপণ করতে পারবেন। তাতে হয়তো শেষ পর্যন্ত ৩০০-৪০০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হুমকিতে পড়তে পারে। পাঁচ হেক্টর জমির বীজতলা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।
তবে কৃষকেরা বলছেন, অন্তত এক হাজার হেক্টর আমন ধানের জমি পানির নিচে রয়েছে। বসতবাড়ির পানিই বিলে সরানোর চেষ্টা করছেন তারা৷ এ অবস্থায় চলমান বৃষ্টিতে বিলের পানি সরে যাওয়ার তেমন কোনো সম্ভবনা নেই৷ কারণ অপরিকল্পিত পুকুর খননের কারণে ও খালগুলো দিয়ে পানি প্রবাহ না হওয়ায় পানি একই জায়গায় স্থির হয়ে থাকছে।
এদিকে আপাতত বৃষ্টি কমার সম্ভাবনা নেই বলছে রাজশাহী আবহাওয়া অফিস। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক লতিফা হেলেন জানান, গত ২৯ জুলাই থেকে ৪ আগষ্ট পর্যন্ত সাতদিনে রাজশাহীতে ১৬৭.৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। যা এ মৌসুমের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। আগামী কয়েকদিনও একই রকম বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চারঘাট উপজেলায় পাঁচ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে আম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি বছর এই পরিমাণ জমিতেই আম চাষ হয়। আমন চাষের সাথে প্রায় ৩৮ হাজার কৃষক জড়িত রয়েছেন।
সরেজমিন চারঘাটের শলুয়া, ভাটপাড়া, বালিয়াডাঙা, চামটা, সাদীপুর, কৈ ডাঙা, বালুদিয়াড়সহ আমন চাষের বিলগুলোতে দেখা যায় সেখানে থই থই পানি।
উপজেলার বালিয়াডাঙা ও বামনদিঘী গ্রামের কৃষকেরা বিলের পানি বের করতে যোগাযোগ প্রধান সড়ক কেটে নালা তৈরি করেছেন। স্থানীয় কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, অপরিকল্পিত ভাবে ফসলি জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে। পুকুর পাড় উঁচু করে লাগানো হয়েছে কলাগাছসহ নানা গাছ। এতে পানি চলাচল করতে পারছেনা। বিলের পানি নেমে যাওয়ার সমস্ত পথ বন্ধ করা হয়েছে। হাঁটু সমান পানির জমিতে কিভাবে আম লাগাবো!
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে উপজেলায় মোট পুকুরের সংখ্যা ৩ হাজার ৪০২টি; যা অর্ধযুগ আগে ছিল ২ হাজার ৭৬২ টি এবং এক যুগ আগে ছিল ১ হাজার ৯৩০টি পুকুর। সেই হিসাবে অর্ধযুগের ব্যবধানে ৬৪০টি এবং এক যুগের ব্যবধানে ১ হাজার ৪৭২টি নতুন পুকুর হয়েছে। এসব পুকুরের অধিকাংশই অবৈধ ভাবে খনন হয়েছে বিলের তিনফসলি জমিতে।
উপজেলার শলুয়া গ্রামের কৃষক সবুর আলী বলেন, কিছু মানুষের পুকুর খননের বলি হয়েছে আমাদের ফসলি জমিগুলো। পানি চলাচলের স্বাভাবিক কোনো প্রক্রিয়া নেই। শলুয়া ও চমটা বিলের পানি আগে শলুয়ার দহ খালের মাধ্যমে বড়াল নদীতে প্রবাহ হতো। বৃষ্টির হবার কয়েক ঘন্টা পরেই আর পানি জমা থাকতো না। কিন্তু এখন খালগুলো দখল করে ভরাট করা হয়েছে।
জানা যায়, কাগজে-কলমে উপজেলায় ছোট-বড় ২১টি খাল রয়েছে। এর মধ্যে গঙ্গামতী খাল, ঝিনি খাল, ত্রিমহনী খাল, কাঁটা বড়াল খাল, শ্যামা সুন্দরী খাল, সলিয়ার দহ খাল, ভাটপাড়া খাল, বেলঘরিয়া খাল ও নারদ খাল বেশ উল্লেখ্যযোগ্য। তবে বাস্তবে ২১টি খালের মধ্যে ১৬টি খালের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। যে ৫টি খাল আছে সেগুলোও দখল-দূষণে এখন পানি চলাচলের উপযোগী নেই।
সরদহ ইউনিয়নের খোর্দগোবিন্দপুর এলাকার বাসিন্দা সুমন আলী বলেন, আমাদের এলাকার শত শত বাসিন্দা বৃষ্টির পানিতে গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে। কালভার্ট গুলোর মুখ বন্ধ থাকায় বসতবাড়ির পানিই বিলে যেতে পারছেনা, বিলের পানি কোথায় যাবে? খাল দখল ও অপরিকল্পিত পুকুর খননের কারণেই হাজার হাজার কৃষক দূর্দশায় পড়েছে।
উপজেলা আদর্শ কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বলেন, প্রতি হেক্টর জমিতে ২৫ মণ আমন ধান হয়। সে হিসাবে ১০০০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ না হলে ২৫ হাজার মণ ধান উৎপাদন কম হবে। প্রতি মণ আমন ধানের দাম ১০০০-১২০০ টাকা। সে হিসাবে এ বছর চারঘাটের কৃষকেরা প্রায় তিন কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অপরিকল্পিত পুকুর খনন বন্ধ ও খালগুলো সচল করার দাবি জানাচ্ছি আমরা।
চারঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আল মামুন হাসান বলেন, উপজেলার প্রায় ৮০০ হেক্টর জমিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। তবে আগষ্টের শেষ সপ্তাহের মধ্যে পানি নেমে গেলে কৃষকেরা আমন রোপণ করতে পারবেন। এজন্য ৩০০-৪০০ হেক্টর জমির ধান রোপণ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবে কৃষকদের সাথে নিয়ে আমরা জলবদ্ধতা নিরসনের চেষ্টা করছি যেন কোনো জমিই আমন আবাদের বাইরে না থাকে। এজন্য উঁচু জমিতে বাড়তি বীজতলার ব্যবস্থা করা হয়েছে।