স্টাফ রিপোর্টার : উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও কয়েক দিনের টানা বর্ষণে ফুলেফেঁপে উঠেছে পদ্মা নদী। রাজশাহীতে পানি বিপৎসীমার খুব কাছাকাছি প্রবাহিত হওয়ায় প্লাবিত হয়েছে জেলার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল ও দুর্গম চরাঞ্চল। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে পবা উপজেলার প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ও পানিবন্দি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
বুধবার (১৩ আগস্ট) সকালে উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের সবচেয়ে দুর্গম এলাকা—চরখিদিরপুর, চরখানপুর ও চরতারানগরে নৌকায় করে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের এই যৌথ উদ্যোগে প্রায় ২০০টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই চরাঞ্চলগুলোতে ত্রাণ পৌঁছানো ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সড়কপথ না থাকায় একমাত্র ভরসা ইঞ্জিনচালিত নৌকা। বুধবার ভোর থেকেই দেখা যায় এক ভিন্ন চিত্র। নদীর এক পাড়ে ত্রাণের বস্তা নৌকায় তোলা হচ্ছে, সেই নৌকা উত্তাল নদী পাড়ি দিয়ে পৌঁছাচ্ছে চরের ঘাটে। সেখান থেকে অপেক্ষারত মানুষের হাতে সরাসরি চালের বস্তা তুলে দেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ভোর সাড়ে ৫টা থেকেই নদীর ঘাটে ত্রাণ নিতে জড়ো হয়েছিলেন চরাঞ্চলের শত শত নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ ও শিশু। দীর্ঘ অপেক্ষার পর হাতে চালের বস্তা পেয়ে অনেকের চোখেই ছিল স্বস্তির ছাপ।
ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে পুরো প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আরাফাত আমান আজিজ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) প্রকৌশলী আবু বাশির, যিনি এই কার্যক্রমের সভাপতিত্ব করেন। এছাড়া হরিয়ান ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. ছাবের আলীসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গ্রামবাসী উপস্থিত ছিলেন।
পদ্মার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই চরাঞ্চলগুলোর বসতভিটা ও ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন অনেকে। গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। চর খিদিরপুরের বাসিন্দা আফজাল হোসেন চালের বস্তা হাতে পেয়ে বলেন, “প্রতিবছর বর্ষার সময় নদীর পানি বেড়ে গেলে আমাদের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে যায়। কাজ-কাম বন্ধ হয়ে যায়। এই সহায়তা আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। অন্তত কয়েকদিনের খাবারের চিন্তা থাকলো না।”
ত্রাণ নিতে আসা চরখানপুরের আরফা খাতুন নামে এক নারী জানান, “বন্যা ও নদীভাঙনে আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। ঘরের খাবারও ফুরিয়ে আসছিল, ঠিক এমন সময়ে চাল পেলাম। সরকার আমাদের কথা মনে রেখেছে, এতেই আমরা খুশি ও কৃতজ্ঞ।”
একইভাবে চরতারানগরের ইসাহাক আলী বলেন, “আমাদের এই এলাকা এতটাই দুর্গম যে, কোনো সাহায্য-সহযোগিতা সময়মতো পৌঁছানো খুব কঠিন। কিন্তু এবার উপজেলা প্রশাসন দ্রুত সাড়া দিয়েছে। এই বিপদের দিনে এমন সাহায্য পেয়ে আমরা অনেক স্বস্তি পেয়েছি।”
প্রধান অতিথি ইউএনও আরাফাত আমান আজিজ বলেন, “প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কষ্ট লাঘবে বর্তমান সরকার অত্যন্ত আন্তরিক এবং সেই অনুযায়ী নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আজকের এই সহায়তা তারই একটি অংশ। আমরা খবর পাওয়া মাত্রই জরুরি ভিত্তিতে এই উদ্যোগ নিয়েছি। এটি কেবল শুরু, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ধাপে ধাপে আরও ত্রাণ বিতরণ করা হবে। শুধু তাই নয়, বন্যা পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের জন্যও আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে।”
সভাপতির বক্তব্যে পিআইও প্রকৌশলী আবু বাশির বলেন, “চরাঞ্চলের মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছানো আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, কিন্তু আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি যেন কোনো ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার বাদ না যায়। আমাদের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
হরিয়ান ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. ছাবের আলী বলেন, “চরাঞ্চলের মানুষ বছরের একটা বড় সময় নদীভাঙন, বন্যা আর কর্মসংস্থানের অভাবে খুব কষ্টে দিন কাটায়। সরকারি সহায়তার পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা এবং সমাজের বিত্তবানদেরও এই দুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমি আহ্বান জানাই।”
দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শুধু পবা নয়, রাজশাহীর গোদাগাড়ীসহ অন্যান্য উপজেলার প্লাবিত ও দুর্গম চরাঞ্চলেও পর্যায়ক্রমে ত্রাণ বিতরণের ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের ঘরবাড়ি মেরামত, কৃষি সহায়তা এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার মাধ্যমে টেকসই পুনর্বাসনের উদ্যোগও নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।