দেশব্যাপী ডেঙ্গুর আধিপত্য। প্রাদুর্ভাব ছড়াচ্ছে চিকুনগুনিয়া। পার্বত্য অঞ্চল কাঁপছে ম্যালেরিয়ায়। তিনটি রোগই মশা দ্বারা সংক্রমণের কারণ। যেন সারা দেশে মশার রাজত্ব। সংক্রমণের গতিবেগ অপ্রতিরোধ্য। পরিবার, আত্মীয়- স্বজন, হাট- বাজার, শহর- গ্রাম; কোথাও জ্বর, সর্দি, কাশির প্রসঙ্গ এড়ানোর সুযোগ নেই। এডিস মশায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এবং অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া উভয়েই ভাইরাস জনিত রোগ। এডিস এর একমাত্র বাহক। ম্যালেরিয়া অ্যানোফিলিস প্লাজমোডিয়াম পরজীবী দ্বারা সংক্রমিত রোগ। এ পরজীবী খুব দ্রুত মানুষের লিভার এবং রক্ত কণিকায় বংশ বিস্তার করে। তাই প্রাণহানির আশঙ্কাও বেশি থাকে। সে জন্য উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
সারা বছর মশাবাহিত রোগী শনাক্ত হলেও বর্ষ এ ভাইরাসজনিত রোগের আধিপত্যে আক্রান্ত ও মৃত্যু নিয়মিত সংবাদ শিরোনাম। মানুষের মনে যোগ হয় শঙ্কা ও উদ্বিগ্নতার নতুন মাত্রা। এ বছর বৃষ্টির শুরু থেকেই অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়ছে সংক্রমণের হার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, নারীদের মৃত্যু হার আক্রান্তের তুলনায় বেশি। আক্রান্তের মধ্যে সর্বোচ্চ বরিশাল বিভাগে এবং সর্বনিম্ন সিলেটে। কারণ বরিশাল বিভাগে নদ- নদী, খাল- বিল অন্যান্য জলাধার তুলনামূলকভাবেই বেশি। তাই বর্ষার শুরুতেই পানি জমতে শুরু করে। আর সিলেট বিভাগ তুলনামূলকভাবে উজানে অবস্থিত। অন্যদিকে সিটি কর্পোরেশনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। অত্যধিক, নিম্ন আয়ের প্রান্তিক মানুষের বসবাস এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ অন্যতম কারণ। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে বৃষ্টি বিবেচনায় বর্ষার অনাগত সময়ে সংক্রমণ আরও বাড়বে। কারণ বর্ষাকালে জমে থাকা পানিতে দ্রুত এডিস লার্ভা বংশ বিস্তার করে।
এডিস মশা মূলত দিনের আলোতে বেশি সক্রিয় থাকে। তাই সকাল এবং সন্ধ্যার আগে বেশি কামড়ায়। তানজানিয়ার স্থানীয় ভাষার শব্দ ‘চিকুনগুনিয়া’ মানে ‘বাঁকানো বা কুঁকড়ানো’। মূলত শরীর ব্যথায় রোগীদের মধ্যে বাঁকা হয়ে যাওয়ার প্রবণতাকেই প্রধান উপসর্গ হিসেবে ধরে এমন নামকরণ। চিকুনগুনিয়া ভাইরাস (CHIKV) শরীরে প্রবেশের দুই থেকে চার দিনের মধ্যে আকস্মিক জ্বর শুরু হয় এবং এর সাথে দেখা দেয় অস্থিসন্ধিতে ব্যথা যা কয়েক সপ্তাহ, মাস এমনকি বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই রোগে মৃত্যু ঝুঁকি যাই হোক না কেন বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে শারীরিক অনেক জটিলতা সৃষ্টি করে। এছাড়া মাথাব্যথা, ক্লান্তি, পেটব্যথা, ফটোফোবিয়া বা চোখ আলো সহ্য করতে না পারা, আর্থরাইটিস বা জয়েন্টে প্রদাহ ইত্যাদি উপসর্গও জনভেদে দেখা দিতে পারে। সম্প্রতি একটি রিপোর্টে দেখা যায় যে, চট্রগ্রামে উপসর্গ দেখা দেওয়া রোগীদের প্রায় আশিভাগই চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হচ্ছে। ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ কাছাকাছি। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত লক্ষণ হিসেবে বমির ভাব, শরীরে হামের মত দানা দেখা দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ০৭ (সাত) দিনের মধ্যে এমনিতেই সেরে যায়। ডাক্তারের পরামর্শ মতে, আক্রান্ত রোগীকে উপসর্গ অনুসারে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে বিশ্রামে রেখে প্রচুর পানি ও তরল খাবার খাওয়ানো এবং দ্রুত জ্বর কমানোর জন্য মাথা ধোয়া, ভিজা কাপড় দিয়ে গা মোছা ও প্যারাসিটামল খেতে দেয়া যেতে পারে। এ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ গ্রহণে নিষেধ করা হয়। মারাত্মক আক্রান্ত হলে রোগীকে অবিলম্বে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
অন্যদিকে, তিন পার্বত্য জেলা- রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারে ম্যালেরিয়ায় সংক্রমণের চিত্র অন্যান্য মশাবাহিত রোগের চেয়ে উর্ধ্বমুখী। মূলত, তিন পার্বত্য জেলায় অবস্থিত বনের কারণে পূর্ব থেকেই ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার কামড়ের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটে। কোনো রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ালে তার শরীরে থাকা ম্যালেরিয়ার পরজীবী মশার শরীরে প্রবেশ করে। এরপর সেই মশা যখন অন্য কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন সেই ব্যক্তির শরীরেও এ পরজীবী প্রবেশ করে এবং ম্যালেরিয়া রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এটি লোহিত রক্ত কণিকার মাধ্যমে বংশবিস্তার করায় রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে মশাবাহিত উপর্যুক্ত লক্ষণসমূহ ছাড়াও কাঁপুনি, খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ম্যালেরিয়া নিশ্চিতকরণ পরীক্ষা করতে হবে। মশা যাতে প্রবেশ না করতে পারে সে জন্য দরজা জানালা সঠিকভাবে বন্ধ রাখা উচিত। আপনার ত্বকে এবং ঘুমের পরিবেশে পোকামাকড় প্রতিরোধক যেমন- ডাইথাইলটোলুয়ামাইড (DEET) স্প্রে, রোল-অন, স্টিক এবং ক্রিম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সন্ধ্যা এবং রাতে যখন মশা কামড়ানোর সম্ভাবনা থাকে তখন হাফপ্যান্টের বদলে হালকা, ঢিলেঢালা ট্রাউজার এবং লম্বা হাতা শার্ট কামড় থেকে রক্ষা করতে পারে। তবে কোনোভাবেই কয়েল ব্যবহার করা ঠিক নয়। কারণ ধোঁয়ায় ছোটদের এবং বয়স্কদের শ্বাসকষ্টের সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অসচেতনতায় কয়েলের আগুন অন্যত্র ছড়িয়ে বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধের প্রধান উপায় হচ্ছে মশা নিয়ন্ত্রণ। বাড়ির ভিতর-বাহির এবং আনাচে-কানাচে অপ্রয়োজনীয় পাত্রসমূহ রাখলে তাতে পানি জমে লার্ভা জন্মে। বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড় এবং আঙিনা পরিষ্কার রাখা আমাদের অন্যতম দায়িত্ব। ব্যবহারযোগ্য পাত্রসমূহ- বালতি, ড্রাম, ফুলের ও গাছের টব, ফ্রিজ এবং এয়ার কন্ডিশনারের নীচের পানি ভর্তি পাত্র, অব্যবহৃত গাড়ির টায়ার, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত চৌবাচ্চা, পরিত্যক্ত টিনের কৌটা, প্লাস্টিকের বোতল, গাছের কোটর, পরিত্যক্ত হাড়ি, ডাবের খোসা ইত্যাদিতে পানি কোনোভাবেই একনাগাড়ে ০৫ (পাঁচ) দিনের বেশী যেন জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। এছাড়া শহরে বর্তমানে ছাদ বাগান জনপ্রিয় হচ্ছে দিনে দিনে। বর্ষাকালে ছাদবাগানের পাত্রে জমে থাকা পানিতে মশা নীরবে বংশবিস্তার করছে। সে দিকেও নিজ দায়িত্বে নজর বাড়ানো উচিত। মনে রাখতে হবে মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য সকল নাগরিকের সক্রিয় সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের দেশে তিনটি রোগ নিয়ে অভিজ্ঞতা নতুন নয়। প্রতিরোধের প্রত্যেকটি লাইনই খুবই সহজ এবং আমাদের জানা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে মানতে অপরাগতা প্রকাশ করতে দেখা যায়। তার জন্য আইনও প্রয়োগ করতে হয়। অতীতে তাই হয়েছে। জনসংখ্যায় বিশ্বের অষ্টম দেশ হওয়ায় সংক্রামক রোগগুলো আমাদের জন্য বেশি উদ্বিগ্নের। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রমের সত্ত্বেও তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার পর্যটন এলাকায় সংক্রমণ হচ্ছে দ্রুত গতিতে। রোগের এমন প্রাদুর্ভাব অব্যাহত থাকলে তা পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাবের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া পর্যটকদের মাধ্যমে ছড়িয়ে যেতে যারে সারা দেশে। নিজেরা সচেতন হতে পারলে এবং জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে দ্রুত মশাবাহিত রোগের অশনি সংকেত প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
#
লেখক: মোঃ বেলায়েত হোসেন,তথ্য অফিসার, জেলা তথ্য অফিস, খাগড়াছড়ি
পিআইডি ফিচার