জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাবের শিকার বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব কাটিয়ে উঠে আজ বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে প্রস্তুত আমাদের বদ্বীপ। জ্বালানির চাহিদা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি মজুদের দ্রুত হ্রাস এবং পরিবেশগত সংকটের কারণে বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। শুধু সৌর, বায়ু, পানি ও বর্জ্য থেকে প্রাপ্ত ক্লিন এনার্জি কাজে লাগিয়ে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। আর এই রূপান্তর এখন সময়ের দাবি হয়ে দাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে অগ্রসর হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। ২০০৮ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালাকে নতুন করে সাজিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ৪০শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৭ শতাংশের বেশি প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে প্রায় ৩৪,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। নেট মিটারিং, সবুজ ব্যাংকিং এবং নবায়নযোগ্য যন্ত্রপাতি আমদানিতে কর ছাড়ের মতো পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শুরু আস্থা তৈরি করেছে। নীতিমালার বাস্তবায়ন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং কারিগরি দক্ষতার অভাব এ অগ্রগতিকে ব্যাহত করছে। তবে একটি সহজতর ও স্পষ্ট নীতিগত কাঠামো ও দক্ষতা উন্নয়নের উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি।
গত দুই দশকে বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে জ্বালানির ব্যবহারও বেড়েছে কয়েকগুণ। সরকার সফলভাবে দেশের ৯৬ শতাংশেরও বেশি জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এনেছে। কিন্তু মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের শতকরা ৯০ শতাংশ এখনো জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপাদিত হচ্ছে। উৎ সমূহের মধ্যে প্রধানত প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা ও তেল উল্লেখযোগ্য। এসব জ্বালানি একদিকে যেমন সীমিত ও ব্যয়বহুল, অন্যদিকে পরিবেশের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। বাংলাদেশ প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করছে জ্বালানি আমদানিতে, যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ু ও জলদূষণ। এই বাস্তবতায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি এখন আর বিকল্প নয়—এটাই টেকসই প্রবৃদ্ধির একমাত্র ভরসা।
সৌরবিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় নবায়নযোগ্য উৎস। সৌরশক্তি উৎপাদনের অপার সুযোগ রয়েছে এ দেশে। সৌর হোম সিস্টেম (SHS) কর্মসূচির মাধ্যমে ইতোমধ্যে ২ কোটিরও বেশি মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেয়েছে, যা অন্যতম বৃহৎ অফ-গ্রিড সৌর উদ্যোগ। যেসব অঞ্চলে জাতীয় গ্রিড সম্প্রসারণ ও বিদ্যুতায়ন বিশেষভাবে কঠিন, সেসব স্থানে ৪৫ লাখেরও বেশি সোলার হোম সিস্টেম বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমানে জোর দেওয়া হচ্ছে শিল্পাঞ্চলে রুফটপ সোলার এবং বৃহৎ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে। বাংলাদেশে স্কুল, কারখানা ও সরকারি ভবনে প্রায় ৬ কোটি বর্গমিটার রুফটপ জায়গা বিদ্যমান যা গ্রিড-সংযুক্ত সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করবে। তবে, ব্যাপকভিত্তিক সৌর খামার নির্মাণে জমির স্বল্পতা একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে ভাসমান সৌর প্যানেল বা সেচ ব্যবস্থার সঙ্গে সৌর শক্তি একীভূতকরণ নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলছে।
বায়ুশক্তি (Wind Energy) ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে, তবে কক্সবাজার, কুয়াকাটা ও সেন্টমার্টিন অঞ্চলে বর্ষামৌসুমে পর্যাপ্ত বাতাসের গতি লক্ষ্য করা গেছে, যা ভবিষ্যতে বায়ুশক্তি উৎপাদনে সহায়ক হতে পারে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় কিছু পরীক্ষামুলক প্রকল্প চালু হয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ও বিপুল পরিমাণ কৃষি উচ্ছিষ্ট থাকার পরও বায়োমাস ও বায়োগ্যাস শক্তি এখনো যথাযথভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। ধানের তুষ, গোবর, পাটকাঠি এমনকি পৌর বর্জ্য থেকেও বিদ্যুৎ বা রান্নার জ্বালানি উৎপাদন করা সম্ভব। নীতিগত ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা থাকার পরও স্থানীয়ভিত্তিক বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট এবং বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদনের প্রকল্পগুলো ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির যাত্রাপথ এখনো বেশ চ্যালেঞ্জিং। সৌর বা বায়ুর মতো ভিন্নধর্মী উৎসকে কার্যকরভাবে সংযুক্ত করতে বিদ্যমান জাতীয় গ্রিড এখনো পর্যাপ্তভাবে প্রস্তুত নয় । এছাড়া, প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ব্যয়, অর্থায়নের অভাব, দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি, এবং ঘনবসতিপূর্ণ দেশে জমির সীমাবদ্ধতা—সব মিলিয়ে নবায়নযোগ্য প্রকল্প বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে। কেবল একটি সমন্বিত ও সমবেত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রকৃত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারবে এবং গড়তে পারবে একটি সবুজ, নিরাপদ ও টেকসই ভবিষ্যৎ।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও উন্নয়ন চাহিদার এক অনন্য সংমিশ্রণ রয়েছে, যা একদিকে যেমন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে, অন্যদিকে সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দেয়। পরিবেশগতভাবে টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে আজকের পৃথিবী । এই অবস্থায় বাংলাদেশের বিলম্ব করার সুযোগ নেই। সৌর, বায়ু, জৈব এবং জলবিদ্যুৎ—এই চার শক্তির যথাযথ ব্যবহার কেবল পরিবেশ রক্ষায় নয়, বরং অর্থনৈতিকভাবে টেকসই ও সামাজিকভাবে ন্যায়ভিত্তিক। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ালে বাংলাদেশ আমদানি নির্ভরতা কমাতে পারবে। একই সঙ্গে তৈরি হবে নতুন সবুজ কর্মসংস্থান এবং উন্নত হবে কোটি মানুষের জীবনমান। এক উষ্ণ পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের রৌদ্রভরা মাঠ, নদী অববাহিকা আর বাতাসপ্রবাহিত উপকূল এখন আর শুধুই প্রকৃতির অংশ নয়, এসবই হয়ে উঠবে আগামীর শক্তির মূল ভিত্তি। আজকের সঠিক বিনিয়োগই আগামী প্রজন্মের জন্য গড়ে তুলবে একটি সবুজ, স্বনির্ভর ও টেকসই বাংলাদেশ।
লেখক: তরিকুল ইসলাম
তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়
(পিআইডি ফিচার)