বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকের কাছে সরকারি সেবা মানেই ছিল দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অনিশ্চিত অপেক্ষা, ফাইল হাতে এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে ছোটা, নথিপত্রে ভুল–ত্রুটি হলে আবারও ঘুরে আসা এবং শেষে দালালের ফাঁদে পড়া। এই অভিজ্ঞতা শুধু হতাশাজনকই নয় বরং সময় ও অর্থেরও অপচয় ঘটাতো। অনেকেই তাই প্রয়োজনীয় সেবা নিতে গিয়েও মাঝপথে বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিতেন। কিন্তু এই পুরোনো বাস্তবতার পরিবর্তনে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে ‘নাগরিক সেবা বাংলাদেশ’ নামের একটি উদ্যোগের মাধ্যমে। এটি একটি ওয়ান স্টপ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, যেখানে এক ঠিকানা থেকে বহু ধরনের সরকারি সেবা নেওয়া যাবে। নাগরিক আর ফাইল হাতে অফিসে ছুটে বেড়াতে হবে না বরং অনলাইনে কয়েকটি ধাপে আবেদন জমা দিয়ে কাজের অগ্রগতি সহজেই ট্র্যাক করা যাবে। সময়, খরচ ও হয়রানি কমিয়ে সুশাসনের নতুন মানদণ্ড তৈরি করাই এই প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য।
এই উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২৬ মে ২০২৫ সালে। রাজধানীতে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি ঘোষণা দেন দালালের দৌরাত্ম্য কমানো, হয়রানিমুক্ত সেবা নিশ্চিত করা এবং এক জায়গায় সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়ার। তাঁর বক্তব্য নিছক প্রতিশ্রুতি ছিল না, বরং একটি কাঠামোগত সংস্কারের ইঙ্গিত বহন করছিল। শুরুতেই ঢাকার গুলশান, উত্তরা ও নীলক্ষেতে তিনটি নাগরিক সেবা কেন্দ্র চালু করা হয়। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই কেন্দ্রগুলো। এখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্যোক্তারা দায়িত্ব পালন করছেন এবং প্রতিটি কেন্দ্রে সরকার নির্ধারিত ফি তালিকা উন্মুক্তভাবে ঝুলানো আছে। ফলে নাগরিকরা আগেই বুঝে নিতে পারেন কোন সেবার জন্য কত খরচ হবে। তথ্য সুরক্ষার জন্য উদ্যোক্তাদের নন-ডিসক্লোজার চুক্তির আওতায় আনা হয়েছে, যাতে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপদ থাকে।
তবে নাগরিক সেবা কেবল একটি ফ্রন্ট ডেস্ক নয় বরং একটি পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ইকোসিস্টেম। এখানে একক সার্ভিস পোর্টাল ও সুপার অ্যাপ থাকবে, থাকবে বিলিং অ্যাগ্রিগেটর ও পেমেন্ট গেটওয়ে। প্রতিটি আবেদনের জন্য স্বয়ংক্রিয় ট্র্যাকিং নম্বর দেওয়া হবে, ফলে একজন নাগরিক যেকোনো সময় জানতে পারবেন তাঁর আবেদন কোন ধাপে আছে। নীতিনির্ধারকেরাও দেখতে পারবেন কোথায় কোনো বটলনেক তৈরি হয়েছে। ফলে এই উদ্যোগ কেবল ডিজিটালাইজড ফ্রন্ট ডেস্ক নয়, বরং প্রমাণভিত্তিক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকেও এক ধাপ অগ্রগতি। নাগরিকের প্রতিটি অভিযোগ, প্রতিটি ধাপের রেকর্ড ও প্রতিক্রিয়া সহজেই নথিভুক্ত হয়ে যাবে।
বর্তমানে পাইলট পর্যায়ে ৮১টি সেবা চালু আছে। তবে লক্ষ্য অনেক বড়। খুব শিগগিরই ৪৫০ এর বেশি সেবা একত্রে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন, এনআইডি সংশোধন ও পুনর্মুদ্রণ, নতুন পাসপোর্ট আবেদন ও নবায়ন, অনলাইন জিডি, ই-মিউটেশন ও ই-পর্চা, ভূমি কর পরিশোধ, ট্রেড লাইসেন্স ও ট্রেডমার্ক নিবন্ধন, আয়কর রিটার্ন দাখিল ও ভ্যাট চালান, বিদ্যুৎ-পান-গ্যাসসহ ইউটিলিটি বিল, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও যানবাহন নিবন্ধন নবায়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি সম্পর্কিত নানা সেবা এক গেটওয়েতে পাওয়া যাবে। যাদের নিজস্ব ডিভাইস নেই বা অনলাইন ব্যবহারের দক্ষতা কম তারা কাছের নাগরিক সেবা কেন্দ্রে গিয়ে সহায়তা নিতে পারবেন। প্রয়োজনে ৩৩৩ নম্বরে কল করে নির্দেশনাও মিলবে। ফলে ডিজিটাল বিভাজনের বাস্তবতাকে মাথায় রেখে অনলাইন ও অফলাইন উভয় চ্যানেলের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে।
এই উদ্যোগের মূল ভরসা হলো উদ্যোক্তা মডেল। সরকারের তত্ত্বাবধানে কড়া বাছাই ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা নির্বাচন করা হয়েছে। প্রথম ধাপে ২০০ জন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০০ জন সার্টিফিকেট অর্জন করেছেন যাদের মাঝে ৫০ জন নারী ও ৫০ জন পুরুষ। উদ্যোক্তাদের জন্য থাকছে ব্র্যান্ডেড ইউনিফর্ম, পরিচয়পত্র, সনদ এবং ভবিষ্যতে স্বল্পসুদের আর্থিক সহায়তার সুযোগ। সরকারি–আধাসরকারি স্থাপনা, পোস্ট অফিস, বিটিসিএল অফিস, জেলা ও উপজেলা কমপ্লেক্সে কো-ওয়ার্কিং স্পেসে কেন্দ্র বসানো হয়েছে, যাতে বিনিয়োগের বাধা কমে। ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে স্বল্পসুদের ঋণের বিষয়েও আলোচনা চলছে। সেবা মান বজায় না রাখলে উদ্যোক্তার লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করার বিধানও রাখা হয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রভিত্তিক র্যাঙ্কিং ও নাগরিক ফিডব্যাক প্রকাশ্যে প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে, যাতে সেবাদাতাদের মধ্যে ইতিবাচক প্রতিযোগিতা তৈরি হয়।
যদিও পরিকল্পনা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক তবুও কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থিতিশীল ইন্টারনেট ও বিদ্যুতের অভাব সেবার মানে বৈষম্য তৈরি করতে পারে। ডিজিটাল সাক্ষরতার ঘাটতির কারণে অনেকেই নিজের হাতে আবেদন করতে স্বস্তি বোধ করবেন না। তাঁদের জন্য উদ্যোক্তাদের দক্ষতা ও নৈতিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, কারণ নাগরিকের তথ্য ফাঁস হলে তা বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই কে কখন কোন ডেটায় প্রবেশ করবে, তা কঠোরভাবে নিয়মে বেঁধে দিতে হবে। সমস্ত কার্যক্রম রেকর্ড রাখতে হবে এবং নিয়মিতভাবে সিস্টেম পরীক্ষা করে দুর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্থায়ন। জাতীয় পর্যায়ে এই সেবা চালাতে হলে নেটওয়ার্ক, যন্ত্রপাতি, সার্ভার, সাপোর্ট টিম ও তদারকির জন্য দীর্ঘমেয়াদি বাজেট দরকার। সরকারি অর্থায়নের পাশাপাশি বেসরকারি খাত ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশীদারিত্বও কাজে লাগাতে হতে পারে।
তবুও এই উদ্যোগ নাগরিক জীবনে বিশাল পরিবর্তন আনতে সক্ষম। আগে একটি জন্মনিবন্ধনের জন্য ফাইল হাতে বারবার অফিসে যেতে হতো। এখন কয়েকটি ক্লিকেই আবেদন জমা হবে, সঙ্গে হাতে মিলবে ট্র্যাকিং নম্বর ও এসএমএস আপডেট। ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রেও একই সুবিধা। পুরোনো লাইসেন্স নম্বর ও টিআইএন নম্বর দিলেই সিস্টেম নিজে থেকেই বিলম্ব ফি হিসাব করে দেখাবে। অনলাইনে পেমেন্ট করলে আবেদন স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রক্রিয়ায় ঢুকে যাবে। ফলে নাগরিক আর অযথা সময় নষ্ট করবেন না এবং দালালের ওপর নির্ভর করার প্রয়োজন পড়বে না। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসবে নাগরিকের আস্থায়। আগে কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যেত না। এখন প্রতিটি ধাপ স্বচ্ছভাবে দেখা যাবে, অভিযোগ করলে রেফারেন্স নম্বর পাওয়া যাবে, আর ফিডব্যাকও প্রকাশ্যে থাকবে। এতে মানুষ বুঝবেন সেবা প্রক্রিয়া সত্যিই বদলাচ্ছে। আস্থার এই পরিবেশই হবে নাগরিক সেবার দীর্ঘমেয়াদি শক্তি।
পরিকল্পনা রয়েছে প্রথমে ৬৪ জেলার প্রতিটি উপজেলায়, এরপর ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে এ সেবা পৌঁছে দেওয়ার। প্রতিটি মন্ত্রণালয় থেকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে অন্তত দুটি করে সেবা যুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাসপোর্টের মতো বায়োমেট্রিক সেবার ক্ষেত্রেও নাগরিক সেবা কেন্দ্রে সরাসরি আঙুলের ছাপ, চোখের স্ক্যান ও ছবি সংগ্রহের ব্যবস্থা থাকবে। এভাবে নাগরিক সেবা কেন্দ্রগুলো শুধু সেবা দেওয়ার জায়গা নয়, বরং স্থানীয় অর্থনীতির ছোট হাবে পরিণত হবে। তরুণ, নারী ও প্রযুক্তিপ্রেমীরা এখানে কাজ শিখবেন, দক্ষতা বাড়াবেন এবং আয় করার সুযোগ পাবেন।
সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, যদি ডেটা সুরক্ষা, সাইবার নিরাপত্তা, মান নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি যথাযথভাবে নিশ্চিত করা যায়, তবে এই উদ্যোগ বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ভেঙে দিতে সক্ষম হবে। সরকারি সেবা নিতে নাগরিকদের আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না, দালালের উপর নির্ভর করতে হবে না কিংবা হতাশাজনক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে না। নাগরিক সেবা বাংলাদেশ তাই শুধু একটি প্রযুক্তি প্রকল্প নয়, বরং এটি নাগরিক সেবা সংস্কৃতিতে এক নতুন যুগের সূচনা। মানুষের আস্থা তৈরি হলে এই আস্থাই হবে উদ্যোগটির দীর্ঘমেয়াদি শক্তি।
লেখক: মো. খালিদ হাসান
সহকারী তথ্য অফিসার
পিআইডি ফিচার