নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

বাংলাদেশ বুধবার। রাত ২:৫৩। ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫।

অপচিকিৎসার ফাঁদে গ্রামের মানুষ

সেপ্টেম্বর ২, ২০২৫ ৭:১০
Link Copied!

পিন্টু আলী (চারঘাট) রাজশাহী : রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার পিরোজপুর গ্রামের আফরোজা বেগম প্রেসার ও ডায়াবেটিস রোগী। সপ্তাহ খানেক আগে মাথা ঘোরা ভাব হলে প্রতিবেশীদের পরামর্শমত সদ্য পল্লী চিকিৎসক বনে যাওয়া মমিন আলী নামে এক ব্যাক্তিকে খবর দেন। তিনি এসে প্রেসার মেপে বলেন প্রেসার অনেক বেশি, এজন্য কয়েক রকমের ওষুধ দেন। পাশাপাশি শরীরের দূর্বলতা কাটাতে আমলকি নামে একটি ইউনানী ভিটামিন ওষুধ দেন। সেই ওষুধ খেয়ে দুদিন পরেই ডায়াবেটিস বেড়ে শারিরিক অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ছয়দিন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, পল্লী চিকিৎসক পরিচয়ধারী মমিন আলী মাত্র তিন মাস আগেও কুটির শিল্পের কারিগর ছিলেন। বাড়িতে বসে বাঁশের সরঞ্জাম তৈরি করতেন। কিন্তু এখন সকাল হলেই একটি ব্যাগে প্রেসার ও ডায়াবেটিকস মাপার যত্ন নিয়ে এলাকা এলাকা ঘুরে রোগী দেখছেন তিনি। আমলকি নামের ভিটামিন ওষুধটি কেনা মাত্র ৫০ টাকায়। কিন্তু প্যাকেটের গায়ে মূল্য লেখা রয়েছে ৩৫০ টাকা। সে দামেই যেকোনো রোগীকে শারিরিক দূর্বলতার কারণ দেখিয়ে ৩৫০ টাকা দামে বিক্রি করছেন। তাতে এক ওষুধই ৩০০ টাকা লাভ।

এ বিষয়ে মমিন আলী বলেন, আমি আগে কুটির শিল্পের কারিগর হিসাবে কাজ করতাম এটা সঠিক। কিন্তু এ পেশার চাহিদা এখন আর তেমন নাই। এজন্য এক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে ওষুধের দোকান ও পাশাপাশি রোগীদের ছোট খাট চিকিৎসা প্রদান করেন।

শুধু মমিন আলী নয়, চারঘাট উপজেলার আনাচে কানাচে এভাবে রাতারাতি পল্লী চিকিৎসক বনে ফার্মেসি দোকান খুলে বসছেন কুলি, রাজমিস্ত্রী, মুদি দোকানি কিংবা ভবঘুরে তরুণরা৷ গ্রামে গ্রামে ঘুরে এবং নিজ ফার্মেসীতে বসে চিকিৎসা প্রদান করছেন। এতে সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে অনুমোদন ছাড়াই ফার্মেসি ব্যবসা ও অপচিকিৎসা দিলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই।

আরও পড়ুনঃ  ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা আশ্বস্ত করেছেন

ঔষধ প্রশাসন রাজশাহীর তথ্যমতে, জেলায় ৪ হাজার ১০০টি অনুমোদিত ওষুধের ফার্মেসি আছে। এর মধ্যে চারঘাটে অনুমোদিত ফার্মেসী রয়েছে ২১৭টি। তবে চারঘাটের আনাচকানাচে অনুমোদনহীন ফার্মেসি রয়েছে আরো ৪৫৭টি। যারা কেউ বাড়িতে, মোড়ে কিংবা স্থানীয় বাজারে ফার্মেসি খুলে বসেছে বলছে উপজেলা ড্রাগ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি।

প্রশাসনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই চালিয়ে যাচ্ছে ওষুধ বিক্রির ব্যবসা। এসব ফার্মেসির দিয়ে পল্লী চিকিৎসার নামে ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক, নিষিদ্ধ, নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের বিভিন্ন ওষুধ বিক্রি করছে অবাধে। এতে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন অনেক রোগী ও তাদের পরিবার। এমনকি এসব পল্লী চিকিৎসকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাদকসেবীদের কাছে কাঁশির সিরাপ ও ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেটও সরবরাহ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

উপজেলার নিমপাড়া গ্রামের বাসিন্দা খায়রুল ইসলাম বলেন, আমার ছেলের বয়স সাত বছর। হঠাৎ জ্বর আসায় আমি বাড়িতে না থাকায় ওর মা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে কোনো ওষুধ সরবরাহ না থাকায় রবিউল ইসলাম নামে স্থানীয় এক পল্লী চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিল। সে দুই দিনেই জ্বরে এন্টিবায়োটিক ওষুধ দেয়, পাশাপাশি শরীর দূর্বলতার কথা বলে ভিটামিন ইউনানী ওষুধ দেয়। এতে আমার ছেলে আরো গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে রাজশাহী হাসপাতালে নিয়ে পরীক্ষা করে শুনি ডেঙ্গু হয়েছে। পল্লী চিকিৎসকের কথা শুনে বাড়িতে রাখলে ছেলেকে হয়তো জীবিত দেখতে পেতাম না।

আরও পড়ুনঃ  উত্তরা ইপিজেড এ  শ্রমিক হত্যার বিরুদ্ধে  জবি শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ "

এ বিষয়ে পল্লী চিকিৎসক পরিচয়দানকারী রবিউল ইসলাম বলেন, নিজেকে ডাক্তার হিসাবে দাবি করিনা। কিন্তু অভিজ্ঞতা আছে, সেজন্য ওই রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছি। এটা দোষের কিছু না।

উপজেলা ড্রাগ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেন্টু বলেন, কোনো প্রকার অনুমোদন ছাড়াই রাতারাতি ফার্মেসি খুলে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করছে। ৩০-৫০ টাকার নাম-গন্ধহীন কোম্পানির বিভিন্ন ওষুধ কিনে ৩৫০-৪০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। আমরা যারা প্রকৃত ফার্মেসি ব্যবসায়ী তারা এতে বিপাকে পড়ছি। কিন্তু বার বার বলার পরেও প্রশাসন গ্রাম অঞ্চলে অভিযানে যায় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পল্লী চিকিৎসক বলেন, আগে তিনি রাজমিস্ত্রীর কাজ করতেন, পাশাপাশি মুদি দোকান ছিল। সে দোকানেই এখন ফার্মেসি চালু করেছেন। চারঘাট সদরের কয়েকটি পাইকারি দোকান থেকে আমলকি, আমলকি প্লাস, বলারিষ্টসহ বিভিন্ন জ্বর সর্দি কাশির ওষুধ ও এন্টিবায়োটিক নিম্নমানের ওষুধ কিনে বিক্রি করেন। এতে অন্য ব্যবসার চেয়ে কয়েকগুন বেশি আয় করছেন তিনি৷ হাসপাতালে ডাক্তার না থাকায় ও ভোগান্তির কারণে গ্রামের বাসিন্দারা ভীড় করছেন।

উপজেলা দূর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সহ-সভাপতি আঞ্জুমান আরা ময়না বলেন, সীমান্তবর্তী উপজেলা হওয়ায় গ্রামপর্যায়ের ফার্মেসিগুলোতে ওষুধ ব্যবসার আড়ালে ইন্ডিয়ান নেশাজাতীয় ট্যাবলেট বেঁচাকেনা করা হয়। এছাড়া ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে ভালো মানের ওষুধের চেয়ে বেশি কমিশন দেওয়া হচ্ছে। এতে বেশি লাভের আশায় ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রিতে বেশি আগ্রহী হচ্ছে ওষুধ ব্যবসায়ীরা। সাধারণ মানুষও কোন ওষুধটি আসল কোনটি নকল তা চিহ্নিত করতে অপারগ। এর ফলে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের বাণিজ্য দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। আর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ।

আরও পড়ুনঃ  বোল্ড লুকে শ্রাবন্তী, জানালেন সুখে থাকার রহস্য

এদিকে গত ২৬ জুন নিজ বাড়িতে ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেটসহ আটক হয় মিয়াপুর কলেজছাত্র রাব্বি ইসলাম। তিনি এক মাস পর জেল থেকে বাড়ি ফিরেছেন। তিনি বলেন, স্থানীয় এক কয়েকটি ফার্মেসিকে ফোন করলেই তাদের লোক এসে কাঁশির সিরাপ ও ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেট বাড়িতে দিয়ে যেত। সেগুলো তিনি সেবন করতেন।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর রাজশাহী (সার্কেল-খ) এর পরিদর্শক সাইফুল আলম বলেন, রাতারাতি বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ ফার্মেসি ব্যবসায় জড়িয়ে তারা বিভিন্ন নিষিদ্ধ সিরাপ ও ট্যাবলেট বিক্রি করছে। মাঝে মধ্যেই আমরা চারঘাটের বিভিন্ন ফার্মেসিতে অভিযান চালিয়ে এসব ট্যাবলেট উদ্ধার করে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি।

ঔষধ প্রশাসন রাজশাহী জেলার ঔষধ তত্ত্বাবধায়ক মোঃ শরিফুল ইসলাম বলেন, সরকারি অনুমোদন না নিয়ে কোনো ভাবেই ফার্মেসি পরিচলনা করা যাবেনা। কিন্তু অনেকেই সে নিয়ম মানছেন না। এ বিষয়ে আমাদের অভিযান চলমান আছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌফিক রেজা বলেন, আমরা রোগীদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এ বিষয়ে সচেতন করছি। ডাক্তার ও সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউ যেন চিকিৎসা না নেয়। এরপরও অনেকে প্রতারকদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। লিখিত অভিযোগ পেলে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে আইনগত ব্যবস্থা নেবো।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময়ের কথা ২৪ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন somoyerkotha24news@gmail.com ঠিকানায়।