নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

ঢাকা সোমবার। রাত ১২:৪৬। ৪ আগস্ট, ২০২৫।

পবার আরও দুই ইউনিয়নে চালু হলো কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

আগস্ট ৩, ২০২৫ ৮:০৩
Link Copied!

স্টাফ রিপোর্টার : ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন এখন আর শুধু শহরে সীমাবদ্ধ নয়, সেই স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়ছে রাজশাহীর প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ সুযোগকে গ্রামের তরুণ প্রজন্মের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে তাদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পবা উপজেলার আরও দুটি ইউনিয়নে যাত্রা শুরু করলো ‘ইউনিয়ন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’। হড়গ্রাম, দর্শনপাড়া ও পারিলা ইউনিয়নের ধারাবাহিক সাফল্যের পর এবার দামকুড়া ও হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে স্থাপন করা হলো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত এই দুটি কেন্দ্র। এর মধ্য দিয়ে পবায় প্রযুক্তিগত ক্ষমতায়নে নতুন এক দিগন্তের উন্মোচন হলো।

সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য রোববার (৩ আগস্ট) সকালে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দামকুড়া ও হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদে পৃথকভাবে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দুটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন পবা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরাফাত আমান আজিজ।

এই উদ্যোগের মাধ্যমে নামমাত্র খরচে গ্রামের শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সর্বাধুনিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পাবে, যা তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের পথকে সুগম করবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরাফাত আমান আজিজ এই উদ্যোগকে ‘একটি স্বপ্নের বাস্তব রূপ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন,“ইউনিয়ন পরিষদে বসে গ্রামের ছেলেমেয়েরা নামমাত্র খরচে প্রযুক্তির মতো জটিল বিষয় শিখতে পারবে—এটা একসময় কল্পনা করাও কঠিন ছিল। আমরা চাই, উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে। বিশেষ করে আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী প্রযুক্তি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সেইসব দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য এক নতুন সুযোগের দ্বার খুলে দিয়েছে।”

তিনি আরও যোগ করেন,“ইতিপূর্বে পবা উপজেলার হড়গ্রাম, দর্শনপাড়া ও পারিলা ইউনিয়নে স্থাপিত কেন্দ্রগুলোতে আমরা শিক্ষার্থীদের বিপুল আগ্রহ ও সাফল্য লক্ষ্য করেছি। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই আজ আরও দুটি ইউনিয়নে এই কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হলো। এটি কেবল একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নয়, এটি একটি সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা, যা গ্রাম এবং শহরের মধ্যকার ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।”

আরও পড়ুনঃ  বাংলাদেশ-পাকিস্তানসহ কপাল পুড়তে পারে যেসব দেশের

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা প্রকৌশলী আবু বাশির। তিনি প্রকল্পের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন,“দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের অধীনে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির অর্থায়নে কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল কারিগরি শিক্ষাকে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে দিয়ে বেকারত্ব নামক মানবসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলা করা। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমরা স্থানীয় চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি, যার ফলে এটি একটি সময়োপযোগী ও টেকসই প্রকল্পে রূপ নেবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।”

প্রতিটি কেন্দ্রে একসঙ্গে ২০ জন শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। কেন্দ্রগুলোতে রয়েছে আধুনিক কম্পিউটার, নিরবচ্ছিন্ন দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ এবং প্রজেক্টরসহ অন্যান্য মাল্টিমিডিয়া উপকরণ। প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দক্ষ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, যিনি শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিক্ষা প্রদান করবেন। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের যেকোনো শিক্ষার্থী এই কেন্দ্রে ভর্তি হতে পারবে। প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে কম্পিউটার অফিস অ্যাপ্লিকেশন (এমএস ওয়ার্ড, এমএস এক্সেল, পাওয়ারপয়েন্ট), ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ইমেইল, ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং বর্তমান সময়ের চাহিদাসম্পন্ন গ্রাফিক্স ডিজাইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

নিজের গ্রামেই কম্পিউটার প্রশিক্ষণের এমন আধুনিক সুযোগ পেয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। দামকুড়া ইউনিয়ন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষক ফাহিম আল মুনতাসির জানান, পূর্বের ইউনিয়নগুলোর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এখানেও কোর্সটি সফলভাবে পরিচালনা করা হবে।

আরও পড়ুনঃ  বরেন্দ্র রাজশাহী টেক্সটাইল কারখানায় ছয় মাসে দুই হাজার কর্মসংস্থান

দামকুড়া ইউনিয়নের রাজশাহী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী মাহফুজ আহমেদ মনন তার অনুভূতি প্রকাশ করে। তিনি বলেন, “আজ আমাদের জন্য সত্যিই একটি আনন্দের দিন। দামকুড়া ইউনিয়নে এই কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু হওয়ায় আমি খুবই খুশি। আমি রাজশাহী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র, তাই পড়াশোনার জন্য আমাকে প্রতিদিন শহরে যেতে হয়। এর পাশাপাশি আবার শহরে গিয়ে কম্পিউটার শেখাটা আমার জন্য সময় ও খরচের দিক থেকে প্রায় অসম্ভব ছিল।

এখন বাড়ির কাছেই কমখরচে আধুনিক প্রযুক্তি শেখার সুযোগ মেলায় আমার সেই চিন্তা দূর হলো। আমি এখন পড়াশোনার ক্ষতি না করেই গ্রাফিক্স ডিজাইনের মতো প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারব। এই অসাধারণ উদ্যোগের জন্য উপজেলা প্রশাসন, পিআইও অফিস ও ইউনিয়ন পরিষদকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।”

হরিপুর ইউনিয়নের কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী শাহারা খাতুন ইমা তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, “ডিজিটাল যুগে টিকে থাকতে কম্পিউটার জানাটা কতটা জরুরি, তা আমি বুঝি। কিন্তু আমাদের মতো গ্রামের মেয়েদের জন্য শহরে গিয়ে নিয়মিত ক্লাস করে কম্পিউটার শেখাটা বেশ কঠিন ছিল। এখন বাড়ির কাছেই এমন আধুনিক পরিবেশে শেখার সুযোগ পেয়ে আমি আনন্দিত।”

দামকুড়া ইউনিয়নের একজন অভিভাবক বলেন,“আমার মেয়েটা এবার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। আগে কম্পিউটার শেখাতে শহরে পাঠানোর কথা ভাবলে খরচ আর নিরাপত্তার চিন্তায় পিছিয়ে যেতাম। এখন ইউনিয়নের ভেতরেই এত কম খরচে সে কম্পিউটার শিখতে পারবে—এটা ভাবতেই পারিনি।”

হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ভারপ্রাপ্ত) চেয়ারম্যান মোসফিকুর রহমান রাশেল তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আজ আমাদের হরিপুর ইউনিয়নের জন্য একটি ঐতিহাসিক ও আনন্দের দিন। আমি এই মহতী উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য ইউএনও এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে ইউনিয়নের সর্বস্তরের জনগণের পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।”

আরও পড়ুনঃ  আমরা এখনো রপ্তানিমুখী শিল্পে বৈচিত্র্য আনতে পারিনি : সাখাওয়াত হোসেন

তিনি আরও বলেন, “এই ইউনিয়নের শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে ছাত্রীরা, এখন নিজের বাড়ির কাছেই আধুনিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবে। এতে শিক্ষার্থীরা শহরে যাওয়ার কষ্ট ও বাড়তি খরচ থেকে মুক্তি মিলল। আমি বিশ্বাস করি, এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে দক্ষ হয়ে আমাদের তরুণ-তরুণীরা আত্মনির্ভরশীল হবে এবং চাকুরীর সুযোগ পাবে। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে কেন্দ্রটির সুষ্ঠু পরিচালনায় এবং একে টিকিয়ে রাখতে আমরা সার্বিক সহযোগিতা করে যাব।”

দামকুড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ভারপ্রাপ্ত) চেয়ারম্যান মোখলেসুর রহমান বলেন,“আমার ইউনিয়নের শিক্ষার্থীরা যেন পিছিয়ে না পড়ে, সেই চিন্তা থেকেই আমরা এই প্রকল্পে সর্বাত্মক সহায়তা করেছি। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে এই কেন্দ্রকে টিকিয়ে রাখতে এবং এর সম্প্রসারণে যা যা প্রয়োজন, আমরা তা করব।”

হড়িপুর ইউনিয়নের একজন মাদ্রাসার শিক্ষক আনোয়ার হোসেন জানান, এই উদ্যোগ শুধু প্রযুক্তিগত জ্ঞানই দেবে না, বরং গ্রামের শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস, কর্মদক্ষতা ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার পথ তৈরি করে দেবে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন বেকার সমস্যা কমবে, তেমনি ফ্রিল্যান্সিংসহ অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কাজ করে গ্রামীণ অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। পবার এই মডেল এখন রাজশাহী অঞ্চলের অন্যান্য ইউনিয়নেও নতুন আশার সঞ্চার করেছে। গ্রামীণ প্রযুক্তি বিকাশের এই ধারা চলমান থাকলে খুব শিগগিরই গ্রাম-শহরের পার্থক্য ঘুচে গিয়ে এক ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে বলে আশাবাদী এলাকাবাসী।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময়ের কথা ২৪ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন somoyerkotha24news@gmail.com ঠিকানায়।