নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

বাংলাদেশ সোমবার। দুপুর ১২:৫৭। ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫।

প্রবাসীর ত্যাগ, মাতৃভূমির সমৃদ্ধি

সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৫ ১:৩৮
Link Copied!

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গতিশীল ও শক্তিশালী করতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা নিরবচ্ছিন্নভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অন্যান্য দেশে কর্মরত এসব পরিশ্রমী নাগরিক শুধু রেমিট্যান্স প্রেরণের মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করছেন না, বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতেও ভূমিকা রাখছেন। তাদের কঠোর পরিশ্রম, দক্ষতা ও আত্মত্যাগের ফসল হিসেবেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। প্রবাসীদের কল্যাণে বিএমইটি, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড, বোয়েসেল ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক এই চারটি দপ্তর/সংস্থার মাধ্যমে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রবাসীদের কল্যাণে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় গত এক বছরে যুগান্তকারী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আন্দোলন করায় ১৮৮ জন বাংলাদেশি কর্মী দণ্ডপ্রাপ্ত হন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর কূটনৈতিক হস্তক্ষেপে তাঁদের মুক্ত করে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। একইভাবে, লেবাননের যুদ্ধাবস্থায় বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশি কর্মীদের সরকারি অর্থায়নে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। প্রবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের অংশ হিসেবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ‘প্রবাসী লাউঞ্জ’ স্থাপন করা হয়েছে। বিদেশে কর্মী প্রেরণ প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ, দ্রুত ও সহজতর করতে সময় কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য একটি সমন্বিত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া, বিদ্যমান শ্রমবাজারের পাশাপাশি নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এসব নীতিগত ও বাস্তবমুখী কর্মসূচির ফলে বর্তমান সরকারের দায়িত্বগ্রহণের পর থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহে নতুন গতি সঞ্চার হয়েছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।

সরকারের নিরলস প্রচেষ্টা এবং ধারাবাহিক কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে প্রবাসী কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। বিশেষ করে সৌদি আরবের শ্রমবাজারে যেসব নারী কর্মী নানা কারণে অবৈধভাবে বসবাস করছিলেন, তাদের জন্য বৈধতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে তারা শুধু আইনগত সুরক্ষার আওতায় আসবেন না, বরং নিয়মিত কর্মসংস্থানের সুযোগও লাভ করবেন। এই উদ্যোগ প্রবাসী নারী কর্মীদের জীবনমান উন্নয়ন ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া সৌদি আরবে বাংলাদেশ থেকে অধিকসংখ্যক দক্ষ ও অদক্ষ কর্মী প্রেরণের বিষয়ে উভয় দেশের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সৌদি সরকার এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে, যা আগামী দিনে বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করবে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বাড়বে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।
একই সঙ্গে জর্ডানে কর্মরত নারী কর্মীদের জন্যও একটি যুগান্তকারী সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন কারণে— যেমন কর্মস্থল পরিবর্তন বা চুক্তিভঙ্গের কারণে যারা অবৈধ অবস্থায় পড়েছেন, তারা এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিলে কোনো ধরনের জরিমানা ছাড়াই বৈধতা লাভ করতে পারবেন। এতে দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তা ও ভয়ের অবসান হবে এবং কর্মীরা পুনরায় নিরাপদ কর্মসংস্থানে যুক্ত হতে পারবেন। এই সব উদ্যোগ সরকারের প্রবাসীবান্ধব অবস্থানেরই সুস্পষ্ট প্রতিফলন। বৈধ অভিবাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে প্রবাসী কর্মীদের অধিকার রক্ষা, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র উন্মুক্ত করার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। এর ফলে বাংলাদেশের শ্রমবাজার আন্তর্জাতিক পরিসরে আরও গ্রহণযোগ্য হবে এবং বাংলাদেশি কর্মীরা বিশ্বব্যাপী সম্মান ও মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হবেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণ ও অধিকার সুরক্ষা এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের টেকসই আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করাকে বর্তমান সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত মিশন ও ভিশনের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণ, নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা এবং তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। একই সঙ্গে নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান, বিদ্যমান শ্রমবাজার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ, মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতামুলক ও মানসম্পন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, অভিবাসন ব্যয় হ্রাস এবং অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়া রেমিট্যান্স ও প্রবাসীদের অভিজ্ঞতা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করাও এই ভিশনের অন্তর্ভুক্ত।
এই ভিশনের অংশ হিসেবে ইউরোপীয় দেশসমূহে বৈধ অভিবাসনের সুযোগ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া এবং আরও চারটি ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরসহ একাধিক যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকার বৈধ পথে নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এর মূল লক্ষ্য হলো বিদেশগমনেচ্ছু নাগরিকরা যেন নিরাপদে বিদেশে যেতে পারেন, ন্যায্য পারিশ্রমিক পান এবং মর্যাদাসম্পন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ লাভ করেন।
এ ধারাবাহিকতায় ইতালিতে কর্মী প্রেরণ কার্যক্রমে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। ইতালি সরকার বাংলাদেশ থেকে সিজনাল ও নন-সিজনাল—উভয় ধরনের কর্মী গ্রহণে সম্মত হয়েছে। এ প্রক্রিয়াকে কার্যকর ও টেকসই করতে দুই দেশের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা প্রতিবছর নিয়মিত বৈঠক করবে। কর্মীদের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বাংলাদেশে বিদ্যমান টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে ইতালীয় ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। একইভাবে জাপানেও অধিকসংখ্যক দক্ষ জনশক্তি প্রেরণের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। জাপানের শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী উপযুক্ত ও প্রশিক্ষিত কর্মী তৈরি করতে দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট খাতে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে কর্মীদের আন্তর্জাতিক মানে উপযোগী করে গড়ে তোলার কার্যকর ও ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এই পদক্ষেপগুলো শুধু প্রবাসীবান্ধব বৈধ অভিবাসন ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিকেই শক্তিশালী করছে না, বরং আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় ও মর্যাদাপূর্ণ করে তুলছে। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে নিরাপদ অভিবাসন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণসহ শ্রমবাজার বিষয়ক তৃতীয় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই ধারাবাহিক বৈঠক ও উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ শ্রমবাজার সম্প্রসারণের নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে, যা ভবিষ্যতে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও বৈধ কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও বৃদ্ধি করবে। সরকার গত এক বছরে প্রবাসী কর্মীদের কল্যাণ ও সুরক্ষায় একাধিক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রবাসী কল্যাণ তহবিল থেকে মরদেহ দেশে পাঠানো, ক্ষতিপূরণ, শিক্ষাবৃত্তি ও আইনি সহায়তা আরও দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে প্রদান করা হচ্ছে।
বিএমইটি ৭১টি পেশায় দক্ষতা যাচাই কার্যক্রম চালু করেছে, যেখানে ২৪ হাজারেরও বেশি কর্মী উত্তীর্ণ হয়েছেন। সৌদি আরবগামী কর্মীদের জন্য ড্রাইভিং স্কিল টেস্ট চালু করা হয়েছে এবং জাপানে দক্ষ কর্মী প্রেরণের লক্ষ্যে বড়ো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছরে ১০ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে গেছেন এবং রেমিট্যান্স এসেছে ৩০.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড বিমানবন্দরে বিশেষ সেবা, অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসা ও শিক্ষা সহায়তা প্রদান করছে। মৃত কর্মীদের পরিবারকে ২১৮ কোটির বেশি বীমা ও অনুদান দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রবাসী কল্যাণ হাসপাতাল ও জেলা পর্যায়ে কল্যাণ ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক অভিবাসন ঋণের সুদ ৮ শতাংশে নামিয়ে এনেছে এবং প্রায় ৫০ হাজার ঋণগ্রহীতাকে ১১০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। ব্যাংকটি এখন ডিজিটাল রেমিট্যান্স ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এছাড়া বোয়েসেল ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৬ হাজারের বেশি কর্মী বিদেশে প্রেরণ করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রবাসী কর্মীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার বিশ্বাস করে, এসব কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার আরও প্রসারিত হবে এবং প্রবাসী কর্মীরা বৈধ পথে নিরাপদ অভিবাসনের সুবিধা পাবেন।
#
( লেখক ম.শেফায়েত হোসেন,প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ অফিসার)

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময়ের কথা ২৪ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন somoyerkotha24news@gmail.com ঠিকানায়।