হাতি প্রাণীজগতের এক বিস্ময়। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ হাতিকে শক্তি, প্রজ্ঞা ও স্মৃতিশক্তির প্রতীক হিসেবে দেখে এসেছে। হাতির আচরণ, পরিবারভিত্তিক সামাজিক কাঠামো এবং অসাধারণ স্মৃতিশক্তি মানব সমাজেও এক বিশেষ শিক্ষা জাগ্রত করে। বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ১২ আগস্ট বিশ্ব হাতি দিবস পালিত হয়। ‘মাতৃ নেতৃত্ব, স্মৃতির টান; নিরাপদ রাখি হাতির বাসস্থান’ প্রতিপাদ্যে বাংলাদেশে এ বছর দিবসটি ২০ আগস্ট জাতীয়ভাবে উদ্যাপিত হবে। এই প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে হাতির মাতৃ নেতৃত্বের অসাধারণ বৈশিষ্ট্য, তাদের সামাজিক বন্ধনের দৃঢ়তা এবং টিকে থাকার জন্য নিরাপদ আবাসস্থল সংরক্ষণের গুরুত্বকে সামনে আনা হয়েছে।
বাংলাদেশে বন্য হাতি মূলত পাহাড়ি ও বনাঞ্চলভিত্তিক অঞ্চলে বাস করে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলা, শেরপুর এবং সিলেট অঞ্চলের কিছু বনভূমি হাতির আবাসস্থল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে আসা ভারত ও মিয়ানমারের বন্য হাতিও আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে। একসময়ে বাংলাদেশে হাতির অবাধ বিচরণ থাকলেও, বর্তমানে এই প্রাণীটি মহাবিপদাপন্ন হিসেবে বন্যপ্রাণীর লাল তালিকায় স্থান পেয়েছে। বন বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২.১০ থেকে ৩৩০টি স্থায়ী হাতি, ৭৯ থেকে ১০৭টি পরিযায়ী হাতি এবং ৯৬টি পোষা হাতি আছে। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো, মানুষের চাপ, কৃষি জমি সম্প্রসারণ, নগরায়ণ, পাহাড় ধ্বংস, অবকাঠামো নির্মাণ এবং বন উজাড়ের ফলে হাতির স্বাভাবিক চলাচলের পথ ও বাসস্থান ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। এর ফলে ‘হিউম্যান-এলিফ্যান্ট কনফ্লিক্ট’ তথা মানুষ ও হাতির দ্বন্দ্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফসল নষ্ট, মানুষের মৃত্যু এবং হাতির মৃত্যু এ দ্বন্দ্বের করুণ পরিণতি হয়ে উঠছে।
হাতির সমাজব্যবস্থা অত্যন্ত অনন্য। হাতির পালের নেতৃত্ব দেন একজন অভিজ্ঞ নারী হাতি। তিনি শুধু দলের পথপ্রদর্শকই নন, বরং দলীয় নিরাপত্তা, খাদ্য সংগ্রহ এবং আশ্রয়ের পথ নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। শুষ্ক মৌসুমে পানির উৎস কোথায় আছে, কোথায় শিকারির আক্রমণের আশঙ্কা বেশি – এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিশক্তির ভাণ্ডারে সংরক্ষিত থাকে। এ কারণে প্রতিপাদ্যে ‘মাতৃ নেতৃত্ব’ এবং ‘স্মৃতির টান’কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হাতির এই পারিবারিক ঐক্য ও মাতৃকেন্দ্রিক নেতৃত্ব মানব সমাজের জন্যও এক গভীর শিক্ষাযেখানে অভিজ্ঞতা, সহমর্মিতা ও পারস্পরিক যত্নকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
বাংলাদেশ সরকার হাতি সংরক্ষণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। হাতি আর মানুষের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ও সংঘাত নিরসনের জন্য সরকার বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। হাতির আক্রমণে নিহত, গুরুতর আহত, বা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্পদের ক্ষতির জন্য এখন পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৯৭৫ জনকে ১০ কোটি ৫৮ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, শেরপুর ও বান্দরবানের মতো হাতি-উপদ্রুত এলাকায় ‘এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম’ (ইআরটি) গঠন করা হয়েছে। এই দলগুলোতে ১৫৯ জন সদস্য আছেন, যাদেরকে নিয়মিত টহল দেওয়ার জন্য দৈনিক ভাতা এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেওয়া হয়। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় হাতি সংরক্ষণ এবং মানুষ-হাতির মধ্যে সংঘাত কমানোর জন্য পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ, মাইকিং, সচেতনতামুলক সাইনবোর্ড স্থাপন, পথসভা এবং উঠান বৈঠকের আয়োজন সহ বিভিন্ন জনসচেতনতামুলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষ, বন্যপ্রাণী রক্ষায় কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং ইআরটি সদস্যরা অংশ নিচ্ছেন। এছাড়াও, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশে বিচরণ করা বন্যহাতিদের সুরক্ষা এবং অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে হাতি-অধ্যুষিত এলাকায় ৬টি বিশেষ দল গঠন করা হয়েছে। এই দলগুলো হাতি সংক্রান্ত অপরাধ দমনের কাজ করে। এছাড়াও, প্রতিবছর বিশ্ব হাতি দিবস পালন করা হয় যেন জনসাধারণের মধ্যে হাতি সংরক্ষণ, হাতির আবাসস্থল রক্ষা এবং সীমান্ত দিয়ে হাতির নিরাপদ চলাচল সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
অসুস্থ বা আহত হাতির চিকিৎসাও নিশ্চিত করা হচ্ছে। সম্প্রতি চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ট্রেনে কাটা পড়া একটি হাতির শাবককে উদ্ধার করে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। একইভাবে, চুনতি, ময়মনসিংহ এবং কাপ্তাইয়ে অসুস্থ হাতিদের সুস্থ করে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি, অবৈধভাবে চাঁদাবাজিতে ব্যবহৃত এবং নির্যাতিত তিনটি পোষা হাতিকেও উদ্ধার করা হয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে হাতির আবাসস্থল এবং খাদ্যের জোগান বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সুফল প্রকল্প এবং বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও আবাসস্থল উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে হাতি সমৃদ্ধ বনাঞ্চলে তাদের উপযোগী বাগান তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়াও, “জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন: বাংলাদেশের বনাঞ্চলে বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, রিইন্ট্রোডাকশন ও হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসন” এবং “হাতি সংরক্ষণ” প্রকল্পের আওতায় হাতি সংরক্ষণে আর্থিক সহায়তা প্রদানেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীরাও হাতি সংরক্ষণে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। তবে সমস্যার মূলে রয়েছে হাতির আবাসস্থল ধ্বংস ও সংকোচন। হাতিরা প্রতিদিন অনেক দূর হেঁটে খাদ্য সংগ্রহ করে। তাদের এই স্বাভাবিক পথ বাধাগ্রস্ত হলে তারা গ্রামে ঢুকে পড়ে এবং মানুষের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ফলে উভয়েরই ক্ষতি হয়। এ বাস্তবতা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো হাতির প্রাকৃতিক করিডোরগুলো রক্ষা করা এবং বিকল্প হিসেবে ‘ইকোলজিক্যাল প্যাসেজ’ বা বন্যপ্রাণীবান্ধব করিডোর তৈরি করা। পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তাদের বিকল্প জীবিকা নিশ্চিত করাও জরুরি।
হাতির স্মৃতিশক্তি বিস্ময়কর। তারা বহু বছর আগের কোনো স্থান, কোনো ঘটনার কথা মনে রাখতে পারে। এমনকি কোন পথে ঝুঁকি আছে আর কোন পথে নিরাপদে যাওয়া যাবে সেটিও তারা মনে রাখে। হাতি কেবল বনের একটি প্রাণী নয়, এটি আমাদের জীববৈচিত্র্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হাতিরা বনের বাস্তুসংস্থানকে সুস্থ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা বীজ ছড়িয়ে দেয়, মাটিকে উর্বর রাখে। ফলে বন পুনর্জন্ম লাভ করে এবং জীববৈচিত্র্য টিকে থাকে। হাতি সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা আমাদের বনভূমি ও প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পারি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, বনাঞ্চল ধ্বংস, চোরাচালান এবং মানুষের সঙ্গে সংঘাতের কারণে বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা কমে আসছে। তাই হাতি সংরক্ষণ এখন একটি জরুরি বিষয়। তাদের আবাসস্থল রক্ষা করা, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
বিশ্ব হাতি দিবসের প্রতিপাদ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় হাতি শুধু একটি প্রাণী নয়, বরং প্রকৃতি ও মানুষের টিকে থাকার সহযাত্রী। তাদের মাতৃ নেতৃত্ব, পারিবারিক ঐক্য ও অসাধারণ স্মৃতিশক্তি থেকে মানব সমাজ শিক্ষা নিতে পারে। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, তাদের বেঁচে থাকার জন্য যে আবাসস্থল প্রয়োজন, তা রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ, মানুষ এবং হাতি উভয়েই এই পৃথিবীর অংশীদার।
বিশ্ব হাতি দিবসে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক আমরা হাতির প্রাকৃতিক করিডোরগুলো রক্ষা করব, তাদের বাসস্থান নিরাপদ রাখব এবং মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব হ্রাসে সচেতন থাকব। আমরা যদি হাতিকে রক্ষা করতে পারি, তবে আমরা আমাদের বন, পরিবেশ ও জলবায়ুকেও রক্ষা করতে পারব। হাতি টিকে থাকলে প্রকৃতিও টিকে থাকবে, আর প্রকৃতি টিকে থাকলে মানবসভ্যতাও টিকে থাকবে।
লেখক: দীপংকর বর,উপপ্রধান তথ্য অফিসার, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
পিআইডি ফিচার