নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

ঢাকা মঙ্গলবার। রাত ১:০০। ১৫ জুলাই, ২০২৫।

‘মব’ সাজাতে সোহাগের দেহ টেনে এনে উল্লাস করে খুনিরা

জুলাই ১৪, ২০২৫ ৩:৪৭
Link Copied!

অনলাইন ডেস্ক : রাজনৈতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা অন্য যেকোনো প্রয়োজনে সোহাগের কাছ থেকে টাকা (চাঁদা) চাইতেন মাহমুদুল হাসান মহিন। নিয়মিত টাকা দিতেন সোহাগও। প্রায় বন্ধুত্বের মতো এই সম্পর্ক শত্রুতায় রূপ নেয় গত জুন থেকে। চাঁদা ‘ফিক্সড’ করে দেওয়ায় তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। চূড়ান্ত তর্কাতর্কি ও হাতাহাতি হয় গত ৭ জুলাই।

বড় অঙ্কের চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানো সোহাগকে সোজা করতে মহিন ও টিটন গাজী পরিকল্পনা করেন তাকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার। চাঁদা না দিলে পুরো ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ হারাবেন সোহাগ- এমন হুমকি দেন তারা।

ওইদিন সোহাগকে হত্যার ঘটনায় মামলা থেকে বাঁচতে ‘মব’ তৈরির চেষ্টা করেন খুনিরা। তাই সোহাগকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে টেনে-হিঁচড়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের তিন নম্বর গেটের সামনে নিয়ে আসেন এবং প্রকাশ্যে উল্লাসে মাতেন। উপস্থিত লোকজনকেও হামলায় অংশ নিতে ডাক দেন তারা, যাতে এটিকে মব বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।

সোহাগ হত্যার ঘটনায় পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত এবং সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।

কোতয়ালী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) নাসির উদ্দিন বলেন, সোহাগ হত্যার ঘটনায় হত্যা ও অস্ত্র আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।

এ ঘটনায় পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া সাতজন হলেন মূলহোতা মাহমুদুল হাসান মহিন, তারেক রহমান রবিন, মো. টিটন গাজী, আলমগীর ও লম্বা মনির, সজিব বেপারি ও রাজিব বেপারি।

গ্রেপ্তার হওয়ার পর মূলহোতা মাহমুদুল হাসান মহিন রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার পরিকল্পনা, সোহাগকে ভাঙারি দোকানে হত্যা না করে মিটফোর্ড চত্বরে ধরে এনে প্রকাশ্যে হত্যা, তারেক রহমান রবিন ও টিটনের সঙ্গে কিলিং মিশন বাস্তবায়নের পরিকল্পনা, অস্ত্র সংগ্রহের পরও নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা এবং হত্যার পর উল্লাস করার কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন।

ইতোমধ্যে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন তারেক রহমান রহমান রবিন। গ্রেপ্তার টিটনসহ অন্য আসামিরাও পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার কারণ ও বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরছেন।

আরও পড়ুনঃ  সাত বছরের মেয়েকে হত্যার পর বস্তাবন্দি করে পালাল সৎমা

খোঁজ নিয়ে ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকার রজনী বোস লেনের কিছুটা ভেতরে সোহাগের দোকান। গত ৭ জুলাই চাঁদা নেওয়ার বিষয়ে সোহাগ ও মহিনের মধ্যে বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করলে সোহাগ পুলিশকে জানান মহিনের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল, মিটে গেছে। কিন্তু মহিন চুপ থাকেননি, টিটনের সঙ্গে পরামর্শ করে সোহাগকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মহিন জানিয়েছেন, সোহাগ খুবই একরোখা স্বভাবের ছিল। এলাকার অনেকে সোহাগের ওপর ছিল ক্ষিপ্ত। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে চিরতরে সোহাগকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। শুরুতে তাকে দোকানেই হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সোহাগকে খুন করার জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়েছিল ছোট মনিরের মাধ্যমে। কিন্তু তারা সেটি ব্যবহার করেনি। তারা সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত বিভিন্ন মবের ঘটনা দেখে উৎসাহিত হয়। তাদের ধারণা ছিল, সোহাগকে মিটফোর্ডের ৩ নম্বর গেটের সামনে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে যদি অনেকে মিলে উল্লাস করা যায়, তাহলে ঘটনাটি মব হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যাবে।

পাশাপাশি ওই এলাকার ভাঙারি ব্যবসায়ী, অন্যান্য ব্যবসায়ী, অ্যাম্বুলেন্স চালক, রেস্টুরেন্ট, ফার্মেসি ও ফুটপাতের দোকানগুলোতে কড়া বার্তা দেওয়া যাবে যে, মহিন গ্রুপের কথা না শুনলে পরিণতি হবে এমনই ভয়াবহ। এই চিন্তা থেকেই ঘটনার দিন সোহাগ দোকানে আসার পরপরই ৭টি বাইকে করে ১৯ জন মিলে রজনী বোস লেনে প্রবেশ করেন। এরপর সোহাগকে মারধর করতে করতে মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে এনে ইট-বালু-সিমেন্টের তৈরি পাথর সদৃশ কনক্রিট দিয়ে বার বার আঘাত করে হত্যা করেন তারা।

এরপর ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে মরদেহ টেনে-হিঁচড়ে গেটের বাইরে এনে তার ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে উল্লাস করা হয়।

‘সোহাগ বাঁচলে আমরা শেষ’ বলে হামলায় সবাইকে ডাকে মহিন
প্রত্যক্ষদর্শী অ্যাম্বুলেন্স চালক জানান, সোহাগকে মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে মারতে দেখি। আশপাশে অনেকেই ছিল। সবাই প্রথমে মারেনি। মহিন সবাইকে বলতে থাকে- ‘ও (সোহাগ) বাঁচলে আমরা শেষ’। এরপর সোহাগকে শেষ করতে সবাই মিলেই হামলে পড়ে। এরপর তাকে মিটফোর্ডের ৩ নম্বর গেটের ভেতরে নিয়ে যায়।

আরও পড়ুনঃ  রাজশাহীতে ষষ্ঠ শ্রেণির স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের মামলায় যুবক গ্রেফতার

ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করা ডিবির এক এডিসি পদমর্যাদার কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মহিন, টিটন ও রবিন গেঞ্জাম লাগছে বলে সবাইকে ডাকেন। বাকি সবাই জানতেন না সোহাগ হত্যার প্ল্যান আছে।

তিনি বলেন, আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

অস্ত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতয়ালী থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) মনির হোসেন জীবন বলেন, অস্ত্রসহ রবিনকে গ্রেপ্তারের পর সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তার দেওয়া তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।

অস্ত্র মামলার তথ্য : সোহাগ হত্যায় অস্ত্র সাপ্লাই দেয় ছোট মনির
অস্ত্র আইনে দায়ের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, সোহাগকে হত্যা করতে রবিন অস্ত্রটি ছোট মনিরের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। অস্ত্র দেওয়ার সময় ছোট মনির বলেছিলেন, কাজ শেষ হলে সেটি ফেরত দিয়ে আসতে। তবে ফেরতের আগেই ধরা পড়েন রবিন। হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার রবিনকে অস্ত্র মামলার বিষয়ে মহিন ও টিটনের সঙ্গে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ।

সোহাগ হত্যায় জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ মামলার তদন্ত কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। তদন্তে যদি বড় কোনো মাফিয়া, প্রভাবশালী বা কোনো নেতার সংশ্লেষ পাই তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মামলার প্রত্যেক আসামিকেই গ্রেপ্তার করা হবে।

বন্ধ সোহাগের ‘সোহানা মেটাল’ দোকানটি
মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনের েএলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, রজনী বোস লেনের পুরোটা জুড়েই ভাঙারি দোকান। অধিকাংশই খোলা দেখা গেলেও বন্ধ সোহাগের সেই ‘সোহানা মেটাল’ নামে দোকানটি।

হাসপাতালের ৩ নম্বর গেট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রহরা, সেনাবাহিনীর টহল আছে। রাজনৈতিক সংশ্লেষ আর চাঁদাবাজির হিসাব-নিকাশ সব ছাপিয়ে এখনো স্থানীয়দের মধ্যে আলোচনা- হত্যার নৃশংসতা নিয়ে।

সোহাগের কয়েক দোকান পরের এক ভাঙারি ব্যবসায়ী বলেন, এলাকাটিতে মহিনের মতো আরও ৫-৬টি গ্রুপ রয়েছে। মহিন গ্রেপ্তার হলেও অনুসারী ওই গ্রুপগুলো তাদের জন্য হুমকির। যেভাবে সোহাগকে ধরে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাতে আতঙ্ক ছড়িয়েছে ভাঙারিসহ সাধারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে।

আরও পড়ুনঃ  বাগমারায় বিবাহের দিন যুবকের আত্মহত্যা

ব্যবসায়ীদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে জানিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম বলেন, সোহাগকে যে নৃশংসতার মধ্য দিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাতে যে কেউ আতঙ্কিত হতে পারেন। তবে আমরা আশ্বস্ত করতে চাই, ব্যবসায়ীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমরা বৈঠক করে কথা বলেছি। নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

থানার পাশাপাশি তদন্তে সহযোগিতা করছে ডিবি

ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার (ডিবি-দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম জানান, চাঞ্চল্যকর সোহাগ হত্যা মামলার তদন্ত করছে ক্রাইম ডিভিশন। তবে আসামিদের শনাক্ত, গ্রেপ্তারসহ সার্বিক তদন্তে সহযোগিতা করছে ডিবি পুলিশ।

আনসার সদস্যদের দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ ভিত্তিহীন : ডিজি

এদিকে, ওই ঘটনায় আনসার সদস্যরা নির্বিকার ছিলেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে তার প্রতিবাদ জানিয়েছে বাহিনীটি।

গতকাল রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ বলেন, মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় আনসার সদস্যদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা বা দায় ছিল না। ঘটনার দিন আনসার সদস্যরা হাসপাতালের নির্ধারিত রোস্টার অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করেছেন। রোস্টারের বাইরে হাসপাতালের গেটের বাইরে স্বপ্রণোদিত হয়ে আনসার সদস্যদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ ছিল না।

তিনি বলেন, হাসপাতালের কোথায় কীভাবে আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন সেটা নির্ধারণ করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সোহাগ হত্যার ঘটনা ঘটে বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে। তখন ঘটনাস্থল ৩ নম্বর গেটে কোনো আনসার সদস্যকে রাখেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সুতরাং সোহাগ হত্যার ঘটনায় আনসার সদস্যদের অবহেলা বা ব্যত্যয় দেখার কোনো সুযোগ নেই।-ঢাকা পোস্ট

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময়ের কথা ২৪ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন somoyerkotha24news@gmail.com ঠিকানায়।