স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা এখন দেশব্যাপী চলছে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সারাদেশের মতো রাজশাহী নগরীতেও সৃষ্টি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ। মহাষ্টমীর দিন ভোর থেকেই নগরীর বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে ভক্ত-দর্শনার্থীদের ভিড় জমে। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধসহ হাজারো মানুষ অঞ্জলি প্রদান, কুমারী পূজা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও অন্যান্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নেন। রঙিন আলোকসজ্জা, মন্দিরের থিমভিত্তিক সাজসজ্জা ও শিল্পীদের কারুকাজে সাজানো প্রতিটি পূজা মণ্ডপ পরিণত হয়েছে উৎসবের মিলনমেলায়। মহাষ্টমীর দিন মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ১১টায় রাজশাহী মহানগরীর বিভিন্ন পূজা মণ্ডপের নিরাপত্তা পরিস্থিতি সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান। এ সময় তিনি ঐতিহ্যবাহী রাণীবাজার টাইগার পূজা মণ্ডপ ও ধর্মসভা পূজা মণ্ডপ ঘুরে দেখেন এবং পূজা উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দ ও স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পুলিশ কমিশনার আবু সুফিয়ান বলেন,“ধর্মীয় উৎসব শুধু একটি সম্প্রদায়ের নয়, এটি সবার। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। এই সম্প্রীতির ঐতিহ্যই আমাদের শক্তি। তাই সবার সহযোগিতায় পূজা যেন আনন্দময় ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।”
তিনি আরও বলেন, দুর্গাপূজা নির্বিঘ্ন ও উৎসবমুখর পরিবেশে সম্পন্ন করতে আরএমপি সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছে। নগরজুড়ে নিয়মিত টহল জোরদার করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে ডিবি (গোয়েন্দা পুলিশ), সাইবার ইউনিট, ট্রাফিক বিভাগ, বোমা ডিসপোজাল ইউনিটসহ একাধিক শাখা সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটি পূজা মণ্ডপে পর্যাপ্ত পুলিশ, আনসার ও প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক মোতায়েন করা হয়েছে। দর্শনার্থীরা যেন কোনো ধরনের শঙ্কা ছাড়াই পূজা উদযাপন করতে পারেন, সেজন্য সর্বোচ্চ সতর্কতায় দায়িত্ব পালন করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
প্রতিমা বিসর্জনের প্রসঙ্গে কমিশনার আবু সুফিয়ান জানান, রাজশাহীর তিনটি ঘাট—আইবাঁধ, মুন্নুজান ও পুলিশ লাইন ঘাটে আলাদা ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে। এসব স্থানে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা থাকায় দর্শনার্থীদের কোনো ভোগান্তি হবে না। ভিড় সামলাতে ও যানজট এড়াতে বিসর্জনের দিন বিশেষ ট্রাফিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
আরএমপি কমিশনার আরও জানান, নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও মণ্ডপগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে নিয়মিত নজরদারি চলছে। যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি প্রতিরোধে আরএমপি একটি বিশেষ হটলাইন চালু করেছে, যেখানে ফোন করলেই তাৎক্ষণিক পুলিশি সহায়তা পাওয়া যাবে। প্রতিদিন নিয়মিত ব্রিফিং প্যারেড ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা সভার মাধ্যমে সামগ্রিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
রাণীবাজারের টাইগার পূজা মণ্ডপে এবারের থিম ছিল ‘শান্তির প্রতীক’। মণ্ডপজুড়ে নানা শিল্পকর্ম ও প্রতিমার নকশায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা। সেখানে উপস্থিত পূজা উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময়কালে পুলিশ কমিশনার বলেন,“আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ কঠোর নজরদারি করছে। আমরা চাই এই উৎসব আনন্দমুখর পরিবেশেই শেষ হোক। ধর্মীয় সম্প্রীতি আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য—এটিকে অটুট রাখতে সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে। গুজব ছড়িয়ে কেউ যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট না করতে পারে সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।”
টাইগার পূজা মণ্ডপ উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক পার্থ পাল চৌধুরী বলেন,“প্রতি বছরই দুর্গাপূজার সময় পুলিশ প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা পাই। এবছরও আমরা তাদের পাশে পেয়ে আশ্বস্ত বোধ করছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি আমাদের নিরাপত্তার অনুভূতিকে আরও শক্তিশালী করেছে। ভক্ত-দর্শনার্থীরা নিশ্চিন্তে পূজা উদযাপন করছেন, এটিই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় স্বস্তি।”
তিনি আরও বলেন,“মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে। এতে ভক্তদের আস্থা বেড়েছে, পূজা উদযাপন আরও আনন্দময় ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে।”
শহরের বিভিন্ন পূজা মণ্ডপ ঘুরে দেখা যায়, পূজাকে ঘিরে নগরজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে এক অনন্য উৎসবের আবহ। রাজশাহী কলেজ, বোয়ালিয়া, নিউজ মার্কেট, জিরোপয়েন্ট, লক্ষ্মীপুর, সাহেববাজারসহ বিভিন্ন এলাকায়ও ছিল ভক্তদের উপচে পড়া ভিড়। শিশুদের আনন্দ, নারীদের শাড়ি ও গহনার সাজ, তরুণদের ভক্তিমূলক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় চারদিক ভরে উঠেছে। নগরীর প্রতিটি মণ্ডপে ছিল রঙিন আলোকসজ্জা ও ব্যতিক্রমী সাজসজ্জার প্রতিযোগিতা। সব মিলিয়ে মহাষ্টমীর দিন নগরীতে দুর্গাপূজা পরিণত হয়েছে ভক্ত-দর্শনার্থীদের মিলনমেলায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারিতে এদিন উৎসব শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়।
এসময় উপস্থিত ছিলেন- আরএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (সদর) মোহাম্মদ খোরশেদ আলম, উপ-পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) মো. গাজিউর রহমান, উপ-পুলিশ কমিশনার (বোয়ালিয়া) মীর মো. শাফিন মাহমুদ, উপ-পুলিশ কমিশনার (মতিহার) মো. মমিনুল করিমসহ রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ।