মা দিবস বা মাতৃ দিবস এমন একটি দিন যেদিন বিশ্বজুড়ে মায়েদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। মা দিবস একটি ভালোবাসার উৎসব। এই দিনটি মাতৃত্বের মহিমা, মায়ের সঙ্গে সন্তানের অটুট বন্ধন এবং সমাজে মায়েদের অপরিসীম প্রভাবকে উদযাপন করে। এটি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন তারিখে পালিত হলেও সাধারণত মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার এই দিনটি উদযাপিত হয়। বাংলাদেশসহ অনেক দেশে এই দিনটি মায়েদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
মা দিবসের ধারণার শিকড় খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন সভ্যতায়। প্রাচীন গ্রিকরা মাতৃদেবী ‘রিয়া’ এবং ‘সিবেল’কে সম্মান জানাতে বসন্তকালে উৎসব পালন করত। এই উৎসব ছিল মাতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ। রোমানরা ১৫-১৮ মার্চের মধ্যে ‘হিলারিয়া’ নামে একটি উৎসব পালন করত, যেখানে দেবী সিবেলের পূজা করা হতো এবং মায়েদের উপহার দেওয়া হতো। মধ্যযুগে ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যে ‘মাদারিং সানডে’ পালন করা হতো। লেন্টের চতুর্থ রবিবারে এই দিনটি পালিত হতো, যখন মানুষ তাদের মায়ের কাছে ফিরে যেত এবং উপহার দিত। এটি মায়েদের প্রতি শ্রদ্ধার একটি ধর্মীয় ও সামাজিক রীতি ছিল।
মা দিবসের ইতিহাস প্রাচীনকাল থেকে শুরু হলেও আধুনিক রূপে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০ শতকে যুক্তরাষ্ট্রে এবং এর পিছনে রয়েছে কয়েকজন নারীর অসাধারণ প্রচেষ্টা। জুলিয়া ওয়ার্ড হোই (১৮৭০) মার্কিন গৃহযুদ্ধ ও ফ্রাঙ্কো-প্রুশীয় যুদ্ধের নৃশংসতার বিরুদ্ধে শান্তির আহ্বান জানিয়ে ‘মাদার্স ডে প্রক্লামেশন’ লেখেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, নারীরা সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন এবং মায়েদের সম্মানে একটি দিন পালনের প্রস্তাব করেন। আধুনিক মা দিবসের প্রকৃত প্রবর্তক হলেন অ্যানা মারিয়া রিভস জার্ভিস এবং তার মা অ্যান জার্ভিস। অ্যান জার্ভিস ছিলেন একজন সমাজকর্মী যিনি আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময় স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন নিয়ে কাজ করতেন এবং ‘মাদার্স ডে ওয়ার্ক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯০৫ সালে তার মৃত্যুর পর, তার মেয়ে আনা জার্ভিস মায়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করেন। ১৯০৮ সালে আনা জার্ভিস পশ্চিম ভার্জিনিয়ার গ্রাফটন শহরে একটি গির্জায় প্রথম মা দিবস উদযাপন করেন। এই অনুষ্ঠানে তিনি সব মাকে সম্মান জানান এবং সাদা কার্নেশন ফুল বিতরণ করেন, যা মায়ের প্রতি ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯১৪ সালে আনার অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে আনুষ্ঠানিকভাবে মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপর এই দিনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মায়েদের প্রতি ভালোবাসা, সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে, যদিও উদযাপনের তারিখ ও রীতি দেশভেদে ভিন্ন। বাংলাদেশে মা দিবসের কোনো ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক শিকড় নেই। এটি পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে জনপ্রিয় হয়েছে বিশেষত মিলেনিয়াল ও জেনারেশন জি-এর মাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই দিনটির প্রচারে বড় ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মা দিবস পালিত হয়।
মা দিবস শুধু একটি উৎসব নয়, এটি মায়ের অবদানকে স্মরণ করার একটি সুযোগ। মা দিবস মাতৃত্বের ত্যাগ, ভালোবাসা ও দায়িত্বকে উদযাপন করে। একজন মা সন্তানের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন এবং এই দিনটি সেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। এই দিনটি সন্তানদের মায়ের সঙ্গে সম্পর্ককে আরও গভীর করতে উৎসাহিত করে। ব্যস্ত জীবনে অনেক সময় মাকে সময় দেওয়া হয় না, মা দিবস সেই অবহেলা পূরণের একটি সুযোগ। মায়েরা সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা সন্তানদের মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও শিক্ষা দিয়ে সমাজের ভিত শক্ত করেন। মা দিবস এই অবদানকে স্বীকৃতি দেয়। এটি সন্তানদের মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি দিন। একটি সাধারণ “ভালোবাসি মা” বা ছোট্ট উপহারও মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, ইসলামে মায়ের প্রতি সম্মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাদিসে বলা হয়েছে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। তবে শহুরে যুবসমাজের মধ্যে এই দিনটি ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে এবং বাণিজ্যিকীকরণের প্রভাবও লক্ষণীয়।
মা দিবসে মাকে খুশি করার জন্য ছোট ছোট কাজই যথেষ্ট। কিছু জনপ্রিয় ফুল (বিশেষত কার্নেশন), কার্ড, শাড়ি, গয়না, বা মায়ের পছন্দের কোনো জিনিস উপহার দেওয়া।মায়ের সঙ্গে গল্প করা, তার পছন্দের কাজে সাহায্য করা বা একসঙ্গে সময় কাটানো। মায়ের পছন্দের খাবার রান্না করা বা তাকে রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাওয়া। হৃদয়ছোঁয়া চিঠি, কবিতা বা সামাজিক মাধ্যমে মায়ের জন্য পোস্ট। মায়ের জন্য গান গাওয়া, ছবি আঁকা বা তার পছন্দের কোনো কাজে সহায়তা করা। লকডাউন বা দূরত্বে ভিডিও কলের মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে কথা বলা, ভার্চুয়াল উপহার পাঠানো বা কুরিয়ারে উপহার পৌঁছে দেওয়া। অনেকে সামাজিক মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে ছবি বা হৃদয়স্পর্শী বার্তা শেয়ার করে। তবে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রতিদিনের জীবনের একটি অংশ তাই এই দিনটি কেবল একটি আনুষ্ঠানিক উদযাপন হিসেবে দেখা হয়।
এত উৎসব পালনের মধ্যেও পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ কোনো দিবস পালন করার মতো অবস্থায় নেই। তাদের জীবনে নেমে আসা অন্ধকার ঢেকে দিয়েছে তাদের বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাই। তেমন দেশগুলোর মধ্যে ফিলিস্তিন অন্যতম। এদেশের মতো জায়গাগুলোতে হাজার হাজার মা শূন্য হাতে বসে মৃত্যুর দিন গুনছেন। হাজার হাজার শিশুর কান্না থেমে গেছে মায়ের মৃত্যুশোকে। অন্যদিকে আফগানিস্তানে নারীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। সেদেশে আজও সন্তান প্রসব এক নারীর জীবনে আনন্দের নয় বরং আতঙ্কের অভিজ্ঞতা হয়ে দাড়ায়। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, তালেবান শাসন বা আগের সরকারের আমলেও কেউ এই মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবেনি। তারা জানিয়েছেন, তারা শুধু প্রার্থনা আর লাশ দাফন করতে পারেন। মা বা শিশুর মৃত্যু সেখানে স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে মা দিবস ক্রমশ জনপ্রিয় হলেও এটি এখনও শহুরে ও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ভবিষ্যতে এটি আরও ব্যাপক হতে পারে, তবে এর সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সমন্বয় প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, মা দিবসকে ইসলামের মায়ের প্রতি শ্রদ্ধার বার্তার সঙ্গে মিলিয়ে পালন করা যেতে পারে।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়ন, সমঅধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এর মধ্যে রয়েছে ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট (ভিডব্লিউবি) কর্মসূচি, যা দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের আর্থিক সহায়তা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম নারীদের আত্মনির্ভরশীল করতে স্বল্প সুদে ঋণ ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দেয়। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ বাস্তবায়নে কর্মপরিকল্পনা নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণ বাড়ায়। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কার্যক্রমের মাধ্যমে আইনি সহায়তা, কাউন্সেলিং ও জরুরি হটলাইন সেবা প্রদান করা হয়। বাল্যবিবাহ নিরোধ কর্মপরিকল্পনা (২০১৮-২০৩০) সচেতনতা বৃদ্ধি ও আইন প্রয়োগে কাজ করে। এছাড়া জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ কর্মসূচি সফল নারীদের স্বীকৃতি দেয় এবং মহিলা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রকল্প ডিজিটাল দক্ষতা বাড়ায়। মন্ত্রণালয়ের এসব উদ্যোগ নারীদের তথা মা’দের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আইনি ক্ষমতায়নে অবদান রাখছে।
মা দিবস শুধু একটি দিন নয়, এটি আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মা’কে সম্মান জানানোর একটি অনুস্মারক। যদিও অনেকে বলেন প্রতিদিনই মা দিবস তবু এই বিশেষ দিনটি আমাদের ব্যস্ত জীবনে মায়ের প্রতি দায়িত্ব ও ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দেয়। আসুন মা দিবসে মাকে একটু বাড়তি সময়, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা দিয়ে তার মুখে হাসি ফোটাই। কারণ মায়ের হাসিই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এই দিনটি পারিবারিক বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করে এবং মায়ের প্রতি ভালোবাসাকে নতুনভাবে উদযাপন করে। তবে মা দিবসের আসল তাৎপর্য হলো প্রতিদিন মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করা।
লেখক: মো. রফিকুল ইসলাম,তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা,মহিলা ও শিশু বিষয়ক ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়।