নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

বাংলাদেশ সোমবার। দুপুর ১২:৫৭। ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫।

শহর-গ্রামের আর্থ-সামাজিক বৈষম্য কমলে দেশ আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে

সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৫ ৩:১৩
Link Copied!

শহর ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের মাঝে আয়-বৈষম্য একটি চিরাচরিত বিষয় । তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এ বৈষম্য দেশের সুষম ও সামগ্রিক উন্নয়নের বিবেচনায় সুখকর কিছু নয়। বাংলাদেশে গ্রাম ও শহরের মধ্যে ব্যবধান কমছে, তবে খুব ধীর গতিতে। শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের আয় যেমন কম, তেমনি সুযোগ-সুবিধা আরও কম। মানসম্মত চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য গ্রামের মানুষকে ছুটতে হয় শহরে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামের কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না। অথচ গ্রামে খাদ্য উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও এখাতে মূল্যস্ফীতির হার গ্রামেই বেশি। অর্থনীতির ধারায় গ্রাম থেকে টাকা এনে ঋণের জোগান বাড়ানো হয়। অথচ গ্রামে ঋণপ্রবাহ কমে। গ্রামে কর্মোপযোগী মানুষ বেশি থাকলেও স্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সে অর্থে নেই বললেই চলে। সমস্যাগুলো থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে ভাবছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গতবছর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘এমনিতেই গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য এসব অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত করতে হবে। দ্রুত নতুন প্রকল্প শুরু করতে হবে, না হলে বিদ্যমান প্রকল্পগুলো সংশোধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট আয়তন এক লাখ ৪৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে গ্রামীণ এলাকা এক লাখ ৩৩ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং শহুরে এলাকা ১৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার। শহরের আয়তনের চেয়ে গ্রামের আয়তন এক লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার বেশি। অর্থাৎ প্রায় নয় গুণ বেশি। শহরের চেয়ে গ্রামে জনসংখ্যাও বেশি। এ হিসেবে উন্নয়নের সুবিধা বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে হলে গ্রামীণ উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

বিবিএস’র ২০২২ সালের হিসেবে শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের আয় কম। গ্রামে পরিবার প্রতি আয় মাসে গড়ে ২৬ হাজার ১৬৩ টাকা। অথচ প্রতি মাসে খরচ করে ২৬ হাজার ৮৪২ টাকা। অর্থাৎ আয়ের চেয়ে খরচ বেশি। আবার মূল্যস্ফীতিজনিত টাকা ক্ষয়ের দিক থেকে গ্রামই এগিয়ে। একদিকে পণ্যের দাম বেশি, অন্যদিকে আয় কম। গ্রামে চাল-ডাল, শাক-সবজি, মাছ-মাংস, দুধ-ডিম, ফল ও শিল্পোজাত পণ্যের কাঁচামাল উৎপাদন হচ্ছে। অর্থনীতির নিয়মে পণ্য যেখানে উৎপাদন হয় সেখানে সরবরাহ বেশি থাকে। এ কারণে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে মিলছে উলটো চিত্র। কৃষক পর্যায় ছাড়া গ্রামে পণ্যের দাম বেশি। ফলে শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হারও বেশি। গ্রামে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ, শহরে এ হার ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আবার, ২০২২ সালের হিসেবে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ এবং শহরে ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। এ চিত্র খানিকটা বদলেছে, তবে আরও বদলের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

আরও পড়ুনঃ  আওয়ামী লীগ প্রশ্নে আবারও দলের অবস্থান পরিষ্কার করলেন মির্জা ফখরুল

আবার, বিবিএস’র সেই প্রতিবেদনে শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের নানা ধরনের জটিল রোগে বেশি আক্রান্ত হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় ভোগেন গ্রামের ১২ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ, শহরে এ হার ৮ শতাংশ। উচ্চরক্তচাপে ভোগেন গ্রামের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ, শহরে এ হার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ক্যানসারের মতো মরণব্যাধিগুলোও গ্রামে বেশি হচ্ছে। এর মধ্যে লিভার ক্যানসার ও ব্লাড ক্যানসার শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। গ্রামের ৪ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। শহরে এ হার ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ব্লাড ক্যানসারে ভোগেন গ্রামের ৩ শতাংশ মানুষ। শহরে এ হার ২ দশমিক ৭ শতাংশ। আবার, বিদ্যুৎ ব্যবহারেও শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ পিছিয়ে। গ্রামের ৯৯ দশমিক ১০ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। শহরের বিদ্যুৎ ব্যবহারের হার ৯৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। আগের চেয়ে শহরে ও গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবহারের হার বেড়েছে। তবে শহরের চেয়ে গ্রামে লোডশেংডিং বেশি করা হয়।

ব্যাংকে আমানত জোগানের মধ্যে ৭৯ শতাংশ শহরের, ২১ শতাংশ গ্রামের। এর বিপরীতে মোট ঋণের ৮৮ শতাংশ দেওয়া হয় শহরে, গ্রামে ১২ শতাংশ। আগে গ্রামে ঋণের হার আরও কম, আমানতের হার বেশি ছিল। গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রণোদনার জোগান বাড়াতে সরকার নানামুখী তহবিল গঠন করেছে। সেগুলো থেকে গ্রামে কম সুদে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এতে গ্রামে ঋণের প্রবাহ কিছুটা হলেও বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গ্রামে ব্যাংকিং সেবার পরিধি বাড়ছে। প্রচলিত ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রসার বেশি ঘটছে গ্রামে। মোট এজেন্টের মধ্যে ১৪ শতাংশ শহরে, ৮৬ শতাংশ গ্রামে। এধারা ব্যাংকিং এর হিসাবধারীদের মধ্যে ১৪ শতাংশ শহরে ও গ্রামে ৮৬ শতাংশ।

আরও পড়ুনঃ  দুর্গাপুরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আহ্বায়ক কমিটির পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত

বিবিএস’র প্রতিবেদন হতে জানা যায়, দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪০ দশমিক ৬ শতাংশই কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। কৃষির প্রায় পুরোটাই গ্রামে। পাশাপাশি, সেবা ও শিল্পখাতের একটি অংশও গ্রামে রয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পণ্য উৎপাদন করেও কৃষক পণ্যের সঠিক দাম পান না। উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে তা বিক্রি করে আগের ধারদেনা শোধ করেন। এ কারণে কৃষক পাইকারি বাজারে পণ্য নিয়ে প্রত্যাশিত দাম থেকে বঞ্চিত হন। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় খামারিরা দুধের ভালো দাম না পেয়ে রাস্তায় দুধ ঢেলে প্রতিবাদ করেছেন এমন নজিরও আছে। তাই নাগরিক সুবিধাগুলো তো বটেই, উপরন্তু বিপণন ব্যাবস্থাকে অর্থনীতির চালিকাশক্তি, তথা গ্রামে পৌঁছে দেওয়া দরকার হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ পরিসখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর হিসেব অনুযায়ী ২০২২ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ এবং অতি দরিদ্রের হার ছিল ৫.৬ শতাংশ। পিপিআরসির গবেষণায় দেখা গেছে, অতি দারিদ্র্যও তিন বছর পর বেড়ে ৯.৩৫ শতাংশ হয়েছে। দারিদ্র্য বেড়ে হয়েছে ২৭.৯৩ শতাংশ। পিপিআরসি বলছে, এখনো দেশের ১৮ শতাংশ পরিবার যে-কোনো সময় গরিব হয়ে যেতে পারে।

গ্রামের জীবন এক সময় কিছুটা স্থবির ছিল। গ্রামের মধ্যেই মানুষের যাবতীয় চাহিদার অনুসঙ্গের উপর তারা পরিতৃপ্ত ছিল। জীবন-জীবিকা-শিক্ষা-চিকিৎসা-ভ্রমণ কোনো প্রয়োজনেই তারা গ্রামের বাইরে যেত না। কৃষি মৌসুমবিহীন সময়ে অলস বেকার বসে থাকার দরুন সঞ্চিত অর্থ ও ফসল খরচ করতে হতো, যার কারণে দারিদ্র্যতা তাদের নিত্য সঙ্গী ছিল। তাদের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা ছিল গতিহীন ও স্থির। বর্তমানে পরিপার্শ্বিক কারণে তাদের জীবনে গতিশীলতা এসেছে। গ্রামের অনেকেই মধ্যপ্রাচ্য-সহ ইউরোপ-আমেরিকা প্রবাসী হওয়ার সুবাদে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে হরহামেশাইে এখন বিদেশ গমন করে থাকে। প্রবাসীদের অধিকাংশই গ্রামের অধিবাসী, যাদের পাঠানো রেমিটেন্সের কল্যাণে গ্রামীণ জীবনধারায় ব্যাপক সচ্ছলতা এসেছে ও গ্রামের মানুষের চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন ঘটেছে। যার কারণে গ্রামের মানুষের মাঝে আধুনিক সুবিধার স্বাচ্ছন্দ্যময় শহরে জীবন ব্যবস্থার প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। ফলে তারা সবাই শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। বিশ্বের অনেক দেশেই নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় শহর আর গ্রামের মধ্যে উন্নয়ন-বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় না। সেখানে নাগরিক সেবারমান সবখানে সমান ভাবে প্রযোজ্য। সেসব দেশে আধুনিক শিক্ষা-চিকিৎসার সাথে যুক্ত প্রতিষ্ঠান ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দাপ্তরগুলো শহর থেকে দূরে স্থাপন করা হয়, যাতে ঐ এলাকা সমৃদ্ধি লাভ করে। এভাবে অখ্যাত পল্লীর প্রত্যন্ত অঞ্চলও নাগরিক সুবিধার আওতায় আসে আবার মূল শহরগুলো বহুলাংশে চাপমুক্ত থাকে।

আরও পড়ুনঃ  পানিতে ডুবে দাদি ও এক নাতির মৃত্যু, অপর নাতি নিখোঁজ

গ্রামের উন্নয়নে বাস্তবমূখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না হলে শহর ও গ্রামের পার্থক্য থেকেই যাবে। মনে রাখা দরকার, শহরের মানুষের খাদ্যের জোগান আসে গ্রাম থেকে। খাদ্যের জোগানদাতা হিসাবে গ্রামের মানুষদেরই বেশি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে এমনটা সবসময় হচ্ছে না। ফলে কোনো পরিবার একটু আর্থিক সক্ষমতা অর্জন করলেই শহরমুখী হতে চাইছে। নগরমুখী এ প্রবণতা রোধ করতে গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বেকারত্ব হ্রাস, কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, ব্যবসাবাণিজ্য সম্প্রসারণ, গ্রামে শিল্পাঞ্চল স্থাপনসহ গ্রামীণ অর্থনীতিকে গতিশীল করা দরকার। একই সাথে গ্রামের যোগাযোগ, শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসা, সামাজিক নিরাপত্তা ও উন্নত জীবনযাপনের জন্য দরকারি সকল সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

লেখক: ম. জাভেদ ইকবাল
সিনিয়র উপপ্রধান তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর, ঢাকা
পিআইডি ফিচার

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময়ের কথা ২৪ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন somoyerkotha24news@gmail.com ঠিকানায়।