স্টাফ রিপোর্টার : ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেট এখন মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে এর অপব্যবহার ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নানা ধরনের হয়রানি, প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইলের শিকার হচ্ছেন। অনলাইনে নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে তাই সচেতনতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং আইনি সহায়তার গুরুত্ব অপরিসীম। এই প্রেক্ষাপটেই রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত হলো এক ব্যতিক্রমধর্মী কর্মশালা।
শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকালে নগরীর মনি বাজার নানকিং দরবার হলে আয়োজিত এ কর্মশালার শিরোনাম ছিল “নারী ও শিশুদের জন্য নিরাপদ সাইবারস্পেস: বিদ্যমান প্রযুক্তিগত ও আইনি দৃষ্টিভঙ্গির চ্যালেঞ্জ”। কর্মশালার আয়োজন করে দোলা মহিলা উন্নয়ন সংস্থা (ডিএমইউএস)। সহযোগিতা করে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি)।
কর্মশালায় উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, অনলাইনে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ভুয়া আইডি, ব্যক্তিগত ছবি ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইল, অশ্লীল বার্তা ও ভিডিও পাঠানো, ফেসবুক মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে হয়রানি এবং আর্থিক প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। অনেক ভুক্তভোগী বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আনতে ভয় পান। ফলে অপরাধীরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে।
গবেষণায় আরও বলা হয়, অনলাইন হয়রানির শিকার হলে ভুক্তভোগীরা নিকটস্থ থানায় অভিযোগ করতে পারেন। পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনসহ বিদ্যমান বিভিন্ন আইনের অধীনে ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব। তবে এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে আরও সচেতন করতে হবে।
কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন আরএমপি কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান। তিনি বলেন,“নারী ও শিশুদের জন্য ইন্টারনেটকে নিরাপদ করা আমাদের সবার দায়িত্ব। পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদেরও নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কৌশল জানতে হবে।”
এসময় দোলা মহিলা উন্নয়ন সংস্থার মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিনের সঞ্চালনায় কর্মশালায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন- রাজশাহী বারের সাধারণ সম্পাদক জমশেদ আলী, দোলা মহিলা উন্নয়ন সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. শহিদুল্লাহ আনসারী, আরএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (সদর) মোহাম্মদ খোরশেদ আলম, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রওনক আরা পারভীন, আরএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (শাহমখদুম) সাবিনা ইয়াসমিন, উপ-পুলিশ কমিশনার (বোয়ালিয়া) মীর মো. শাফিন মাহমুদ।
তাঁরা বলেন, ‘প্রযুক্তি এখন যেমন আমাদের জীবনে গতি এনেছে, তেমনি এটি বড় হুমকির কারণও হয়ে উঠেছে। শিশু-কিশোররা অল্প বয়সেই মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, কিন্তু তারা ঝুঁকি সম্পর্কে জানে না। তাই পরিবারে শিশুদের ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং প্রয়োজনে সাইবার ক্রাইম ইউনিট থেকে সহায়তা নিতে হবে।’
কর্মশালার মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন- শাহমখদুম থানার অফিসার ইনচার্জ মাছুমা মুস্তারী, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা, যোগাযোগ ও মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান, ব্লাস্ট রাজশাহীর সমন্বয়কারী অ্যাড. সামিনা বেগম, পুলিশ সদস্য ফাতেমাতুজ জোহরা ইতি ও বিলকিস, রাজশাহীর সিনিয়র সাংবাদিক ড. আইনুল হক, কালের কণ্ঠের রাজশাহীর ব্যুরো প্রধান ড. সাদিকুল ইসলাম স্বপন এবং প্রতিদিনের বাংলাদেশের রাজশাহী প্রতিবেদক রাজু আহমেদ।
তাঁরা প্রত্যেকে নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, সাইবার অপরাধ দিন দিন বাড়ছে। নারী সাংবাদিক, শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীরা বিশেষভাবে টার্গেট হচ্ছেন। অপরাধীরা প্রযুক্তিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তাই অনলাইন হয়রানিকে অবহেলা না করে তাৎক্ষণিকভাবে আইনের আশ্রয় নেওয়া জরুরি।
অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী প্রার্থনা ফারদ্বীন মিথিলা ও শিক্ষার্থী শওকত সাজিদ বক্তব্য রাখেন। তারা জানান, অনেক সময় কিশোরীরা স্কুল-কলেজে যাওয়ার সময় ভুয়া আইডি থেকে অশ্লীল বার্তা পেয়ে আতঙ্কিত হয়। অভিভাবকরা বিষয়টি জানতে পারলে সমাধানের পথ খুঁজতে পারেন।
কর্মশালায় বক্তারা সর্বসম্মতভাবে মত দেন— নারী ও শিশুদের জন্য নিরাপদ সাইবারস্পেস নিশ্চিত করতে হবে এখনই। এজন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা উন্নয়ন, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ জানানোর প্রক্রিয়া সহজ করা এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।