পিন্টু আলী , চারঘাট (রাজশাহী) : প্রজনন মৌসুমে মা-ইলিশ সংরক্ষণে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও রাজশাহীর চারঘাটে চলছে ইলিশ শিকারের মহোৎসব। মৎস্য বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের দায়সারা অভিযান এড়িয়ে জেলেরা ইচ্ছেমত দিন-রাত মা-ইলিশ ধরছে। মাঝেমধ্যে দু একটা অভিযান দিলেও জেলেরা পালিয়ে ভারতীয় সীমান্তের ভেতরে গিয়ে মাছ শিকার করছে। এতে যেকোনো সময় ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর হাতে আটক কিংবা হতাহতের আশংকাও তৈরি হয়েছে। ভারতীয় জেলেরাও বাংলাদেশের সীমান্তে ঢুকে অবাধে ইলিশ শিকার করছে।
চারঘাট উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, অক্টোবরের ২২ দিন (৪-২৫ অক্টোবর) মা-ইলিশ ডিম ছাড়তে নদীতে উঠে আসে। পদ্মা দেশের অন্যতম ইলিশ প্রজনন অভয়াশ্রম। এই ২২ দিন পদ্মা নদীর জলসীমায় জাল ফেলা, ইলিশ মাছ শিকার, বহন, মজুত ও ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ। গত ছয়দিনে তিনটি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। কোনো জাল, মাছ কিংবা জেলে আটক হয়নি বলছে মৎস্য অফিস।
গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে ১১টা পর্যন্ত সরেজমিন পদ্মা নদীর চারঘাটের পিরোজপুর ও রাওথা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাতে মাছ শিকার করে একের পর একা নৌকা তীরে ভিড়ছে। আবার কিছু নৌকা সকালে মাছ শিকার করতে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নদীতে তখনো প্রায় ৩০টির অধিক নৌকা মাছ শিকার করছে। এর মধ্যে বাংলাদেশী জেলের পাশাপাশি ভারতীয় জেলের নৌকাও রয়েছে। দূরদূরান্ত থেকে মাছ কিনতে আসা সাধারণ মানুষ ও আড়তদারেরও দেখা গেছে।
মাছ কিনতে আসা সেলিম রেজা নামের এক সাধারণ ক্রেতা বলেন, যখন নিষেধাজ্ঞা ছিল না তখন বাজারে মাছের দাম চড়া ছিল। তখন সাধারণ মানুষ ইলিশ কিনতে পারেননি। এখন সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ভোরের দিকে নদীর পাড়ে আসলে একটু সস্তা দামে ইলিশ কিনতে পাওয়া যায় এজন্য এসেছি। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার সময়ও আড়তদাররা এসে ভিড় করায় মাছের দাম বেশি চাচ্ছে। তারপরও বাচ্চা সাইজের ইলিশ চারশ টাকা দরে দেড় কেজি কিনেছি।
স্থানীয় আড়তদার জিল্লুর রহমান বলেন, নদীতে রিটা, ঘাউরা, চিংড়ি এসব মাছ কিছু জেলে ধরছে। সেগুলোর পাশাপাশি ইলিশ মাছও কিনছি আমরা। ইলিশ তো বাজারে বিক্রি করতে পারবো। এজন্য বিভিন্ন মানুষ মোবাইলে ও অনলাইনে অর্ডার করলে সেগুলো চাহিদা অনুযায়ী আমরা সরবরাহ করছি। মাছের ব্যবসা না করলে কি করে খাবো, এজন্য বিকল্প উপায়ে ব্যবসা চালিয়ে নিচ্ছি।
নিষেধাজ্ঞার সময় সরকারি ভাবে দেওয়া ২৫ কেজি চাল পাওয়ার পরও নদীতে মাছ ধরছিলেন সাগর আলী নামে এক জেলে। তিনি বলেন, শুধুমাত্র আমি একা মাছ ধরা বন্ধ রাখলে ইলিশের প্রজনন বৃদ্ধি পাবেনা। সকল জেলেই জাল বানিয়ে কেউ নদীতে নেমে পড়েছে আবার কেউ নামার প্রস্তুতি নিয়ে আছে। প্রশাসন আগের মত শক্ত না। তারা দিনে দু একবার নদীতে এসে চক্কর দিয়ে চলে যায়, কাউকে কিছু বলেনা। এজন্য যে যার মত মাছ ধরছে, আমরাও ধরছি। ভারতীয় জেলেরাও ধরছে।
নদীতে অভিযানের বিষয়ে চারঘাট নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা নিয়মিত অভিযানে যাচ্ছি। অভিযানে গেলেই বাংলাদেশের জেলেরাও নৌকা নিয়ে ভারতীয় সীমান্তের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে তখন আর আটক করা যাচ্ছেনা। তারা অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করলেও আমরা তা পারছিনা। ভারতীয় সীমান্তের ভেতরে ঢোকার ফলে আটক কিংবা গুলির মুখেও পড়তে পারে তারা। কিন্তু টাকা ইনকাম করতে গিয়ে তারা মৃত্যুকেও তুচ্ছ ভাবছে। বিষয়টি নিয়ে মৎস্য অফিস ও বিজিবির সাথে আলোচনা করা হয়েছে।
স্থানীয় জেলে সমিতির সভাপতি তাজমুল হক বলেন, ভারতীয় জেলেরা এসে হরহামেশা মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের আটক করা হচ্ছেনা। এজন্য আমাদের দেশের জেলেরাও উৎসাহিত হয়ে অভিযান এড়াতে ভারতের সীমান্তের ভেতরে ঢুকে মাছ ধরছে। বিগত সময়ে অনেক জেলে ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীর হাতে আটক হয়ে নির্যাতনের হয়েছে। অনেকে আটক হয়ে এখনো ভারতের কারাগারে দিন কাটাচ্ছে তারপরও জেলেরা ঝুঁকি নিয়ে এ কাজ করছে।
উপজেলার রাওথা এলাকার বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা বলেন, বিগত বছরগুলোতে যেভাবে কঠোর অভিযান হতো এবার তেমনটা নেই। কঠোর অভিযান হলে জেলেরা নদীতে নামারই সাহস পেত না, ভারতের সীমান্তে পালিয়ে যাওয়া তো পরের ব্যাপার। কিন্তু আইনশৃংখলা পরিস্থিতি কিছুটা নাজুক থাকায় জেলেরাও সে সুযোগ নিচ্ছে। নদীতে ইলিশ এখনো আসেনি এটা ভুল। পরিমাণে কম এসেছে, প্রতিনিয়ত তা বাড়ছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) চারঘাট ইউসুফপুর ক্যাম্প কমান্ডার সাহেবুর রহমান বলেন, আমরা জেলেদের নিয়ে সীমান্তবর্তী এলাকায় সচেতনতা কার্যক্রম করেছি যেনো তারা অন্য দেশের সীমান্ত প্রবেশ না করে। সীমান্ত এলাকায় মাইকিং ও মসজিদে নামাজের সময়ও বিষয়গুলো জানানো হচ্ছে। এছাড়াও মা ইলিশ রক্ষায় সরকারি সকল আইন বাস্তবায়নে আমরা নদী সীমান্তে সতর্কতার সাথে দায়িত্ব পালন করছি।
মা ইলিশ রক্ষায় অভিযানের বিষয়ে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, নদীতে এখনো পর্যাপ্ত ইলিশ আসেনি এজন্য জোরদার অভিযান এখনো শুরু করিনি। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই জোরালো অভিযান শুরু হবে। অভিযানের সময় অন্য দেশের সীমান্তে যাবার বিষয়টি নৌ পুলিশও আমাকে জানিয়েছে। জেলে সংগঠনগুলোর সাথে কথা বলে তাদের এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।