নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

বাংলাদেশ মঙ্গলবার। রাত ৯:১৩। ১৮ নভেম্বর, ২০২৫।

বাড়ছে খেজুর গাছের কদর, ২০০ কোটি টাকার গুড়ের সম্ভাবনা

নভেম্বর ১৮, ২০২৫ ৭:৫৭
Link Copied!

পিন্টু আলী, চারঘাট (রাজশাহী): রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার রাওথা গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম। তার ৩৮ শতাংশ জমিতে আমের বাগান রয়েছে। সেই বাগানের চারপাশ দিয়ে রয়েছে ২০টি খেজুর গাছ। পুরো এক বছর সার-কিটনাশক দিয়ে পরিচর্যার পর আম বিক্রি করেছেন মাত্র ১২ হাজার টাকার। অথচ ২০টি খেজুর গাছে কোনো খরচ কিংবা পরিচর্যা ছাড়াই রস সংগ্রহের জন্য চার মাসের জন্য লিজ দিয়েছেন ১৭ হাজার টাকায়। তার এক সময়ের আবর্জনায় ভরা খেজুর গাছ যেন সোনার গাছে পরিণত হয়েছে।

রফিকুল ইসলাম বলেন, আম গাছগুলোকে নিজ সন্তানের মত যত্ন করে ১৫ হাজার টাকা খরচ করে পেয়েছি মাত্র ১২ হাজার টাকা। গত বছর বিক্রি করেছিলাম ১৬ হাজার টাকার আম। প্রতিবছর একই অবস্থা। অথচ খেজুর গাছে এক পয়সা খরচ না থাকলেও ১৮ হাজার টাকা পেলাম। এজন্য সব জমির এক পাশে আলো প্রবেশের জায়গা রেখে তিন পাশে খেজুর গাছ রোপণ করেছি। আর আম বাগান কেটে ফসল আবাদ শুরু করেছি।

শুধুমাত্র রফিকুল ইসলাম নন, আমের জন্য বিখ্যাত রাজশাহী অঞ্চল জুড়েই কদর বেড়েছে খেজুর গাছের। দীর্ঘ লোকসানের ফলে চাষীরা আম বাগান কেটে ফেলে অন্য ফসল আবাদ করছেন। শুধুমাত্র চারঘাট-বাঘা দুই উপজেলাতেই এক বছরে আম গাছ কাটা হয়েছে প্রায় ২১০ হেক্টর জমির।পাশাপাশি বিভিন্ন জমির আইলে খেজুর গাছ রোপণ করছেন কৃষকেরা। এতে আমের রাজ্যে আম গাছের সংখ্যা কমলেও খেজুর গাছের সংখ্যা বাড়ছে। তবে ভেজাল গুড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে খাঁটি খেজুর গুড় বাজারজাত করে লাভবান হওয়াটাও চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছেন স্থানীয় চাষী ও ব্যবসায়ীরা।

আজ কার্তিক মাসের প্রথম দিন, মাঝামাঝি সময়েই শুরু হবে খেজুর রস সংগ্রহ। রাজশাহী কৃষি অধিদপ্তর জানায়, নভেম্বর থেকে গুড় উৎপাদন শুরু হবে এবং ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। গত মৌসুমে ৮ হাজার ৮২৪ টন গুড় আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এবার লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে হয়েছে ৯ হাজার ৬৪ টন। রাজশাহীর প্রায় ৪৯ হাজার ৭১১ জন চাষী রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় প্রায় ১১ লাখ ৮ হাজার ১৮টি খেজুর গাছ রয়েছে। এর মধ্যে বোয়ালিয়ায় ২৪৩ টি, মতিহারে ১ হাজার ৫১৮ টি, পবায় ৪০ হাজার ৫০০ টি, তানোরে ১০ হাজার ৭৩২ টি, মোহনপুরে ৮ হাজার ১০০ টি, বাগমারায় ৩৮ হাজার ৪৭৫ টি, দুর্গাপুরে ৫০ হাজার ৬২৫ টি, পুঠিয়ায় ৫ লাখ ৭৭ হাজার ১২৫ টি, গোদাগাড়ীতে ৪০ হাজার ৫০০ টি, চারঘাটে ১ লাখ ৮৪ হাজার ২৭৫ টি ও বাঘায় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৯২৫ টি। একটি গাছ বছরে ২০-২৩ কেজি রস দিতে পারে। তা থেকে আট-নয় কেজি গুড় তৈরি করা সম্ভব। সে হিসাবে গুড় উৎপাদন দাঁড়ায় ৯ হাজার ৬৪ টন। ৯ হাজার ৬৪ মেট্রিক টন সমান ৯০ লাখ ৬৪ হাজার কেজি গুড়। গত বছর খেজুর গুড়ের বাজারমূল্য ছিল ২০০-২২০ টাকা কেজি। ২০০ টাকা কেজি হিসাবে এই গুড়ের বাজারমূল্য দাঁড়ায় ১৮১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। ২২০ টাকা কেজি হিসাবে হয় ১৯৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। দ্রব্য মূল্যের উর্ধগতি থাকায় এবছর গুড়ের দাম আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাতে ২০০ কোটি টাকার গুড়ের বাজার বলা যায়।

জেলার সবচেয়ে বেশি খেজুর গাছ রয়েছে পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘায়। সরেজমিন গত সপ্তাহ এই তিন উপজেলায় ঘুরে দেখা গেছে, খেজুর গাছিরা বর্তমানে গাছ পরিস্কার করে রস সংগ্রহের উপযোগী করে তুলছেন৷ অনেকে কুমারপাড়া থেকে রস হাড়ি সংগ্রহ করে সেগুলোতে দড়ি বাঁধার কাজ করছেন। কেউ আবার মাটি দিয়ে গুড় তৈরির চুলা প্রস্তুত করছেন। শীতের খেজুর রস ঘিরে যেনো কর্মব্যস্ত হয়ে পড়েছে গ্রামগুলো। তবে নানা রকম শঙ্কার কথাও বলছেন তারা।

পুঠিয়ার ঝলমলিয়া গ্রামের গাছি বাসিন্দা বাহার উদ্দিন বলেন, নিজের ১৩টি গাছ আছে আর কৃষকের নিকট থেকে ৩৫টি লিজ নিয়েছি। চার মাসের জন্য প্রতিটি গাছের জন্য দিতে ৮০০ টাকা। গুড়ের ভাল দাম পেলে লিজের টাকা দিয়েও লাভবান হওয়া যাবে। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যক্তি বাজারে সিন্ডিকেট তৈরি করে খেজুর রস কিনে নিয়ে তার সাথে আটা, ভারতীয় চিটা গুড়, ফ্লেভার ও চিনি মিশিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করে। তারা কম দামে গুড় বাজারে ছেড়ে আমাদের ক্ষতিগ্রস্থ করে।

বাঘা উপজেলার হেলালপুর গ্রামের চাষী আলতাফ হোসেন বলেন, আমার ৪২ টি খেজুর গাছ রয়েছে। এগুলো থেকে রস সংগ্রহ ও গুড় তেরি করতে দুইজন কাজ করে। শীতের মৌসুম আসলে একটা উৎসবের আমেজ চলে আসে। এ অঞ্চলের একটি খেজুর গাছও পরিত্যক্ত পরে থাকেনা। আয় রোজগারের জায়গা সীমিত থাকায় বহু মানুষের রুটি রোজগার খেজুর গাছের রস ও গুড়ের সাথে জড়িত। এজন্য আমরা চাষীরাও চাই রাজশাহীর গুড়ের সুমান আরো যেন বৃদ্ধি পায়।

একই অভিযোগের কথা জানালেন চারঘাট ও বাঘা উপজেলার চাষীরাও। তাদের শঙ্কা, শেষ পর্যন্ত ভেজালের কাছে তাদের গুড় মুখ থুবড়ে পড়বে কিনা। এ বিষয়ে চারঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আল মামুন হাসান বলেন, কিছু ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থে ভেজাল মিশিয়ে কোটি কোটি টাকার খেজুর গুড়ের বাজার ক্ষতিগ্রস্থ করার চেষ্টায় নামে। এজন্য এবছর আমরা চাষিদের সাথে মাঠপর্যায়ে কথা বলে ভেজাল প্রতিরোধে কাজ শুরু করেছি। ভেজাল গুড় প্রস্তুতকারীদের তালিকা করে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাজশাহীর সবচেয়ে বড় খেজুর গুড়ের বাজার পুঠিয়ার বানেশ্বর হাট। এ হাটের খেজুর গুড় ব্যবসায়ী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খাইরুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় চাষী ও ব্যবসায়ীরা গুড় নিয়ে হাটে আসে, সেই গুড় বড় ব্যবসায়ীরা কিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যায়। ভেজাল গুড় হলে পরবর্তীতে আর তারা গুড় নিতে চায় না। এতে হাটেরও বদনাম হয়। এজন্য আমরা গুড় প্রস্তুতকারকদের বার বার অনুরোধ করি, তা সত্ত্বেও অনেকে লোভের বসে এগুলো করে সবাইকে বিপদে ফেলছেন। তাছাড়া আমের পর খেজুর গুড় নিয়ে আমাদের হাট চাঙ্গা থাকে।

এদিকে রাজশাহীর গুড়ের অন্যতম ক্রেতা ও বিক্রেতা অনলাইন ব্যবসায়ীরা। দেশী অগ্রানিক ফুডের পরিচালক ওবাইদুর রহমান রিগেন বলেন, চারঘাট, বাঘা ও পুঠিয়া উপজেলার বিভিন্ন চাষীর কাছে সরেজমিন গিয়ে আমরা গুড় তৈরি করে নিই। এত দাম একটু বেশি হলেও ক্রেতারা প্রকৃত খেজুর গুড়ের স্বাদ পান আবার চাষীদেরও গুড় বিক্রির ঝামেলা পোহাতে হয়না। হাটের গুড়ে ভেজালের কারণে এখন ক্রেতাদের একটি বড় অংশ অনলাইন নির্ভর হয়ে গেছে। গত মৌসুমের চেয়ে এবার গুড়ের উৎপাদন ও ব্যবসা দুইটা বাড়বে বলে আমরা মনে করছি।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, দেশজুড়ে রাজশাহীর গুড়ের সুনাম রয়েছে। আমরা এর সুনাম রক্ষার্থে এবং চাষীরা যেন খাঁটি গুড় তৈরি করে লাভবান হতে পারে এজন্য ভেজাল প্রতিরোধে কাজ শুরু করেছি। আমাদের বিভিন্ন উপজেলার মাঠ পর্যায়ের উপ-সহকারী কৃষি অফিসারগণ চাষীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতা কার্যক্রম করছেন। এছাড়াও কৃষি ভিত্তিক প্রতিটি অনুষ্ঠানে খেজুর গুড়ের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময়ের কথা ২৪ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন somoyerkotha24news@gmail.com ঠিকানায়।