নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

বাংলাদেশ রবিবার। রাত ১২:০৮। ১৭ আগস্ট, ২০২৫।

ময়নাতদন্ত শেষে সমাহিত একই পরিবারের চারজন, শোকে স্তব্ধ বামনশিকড়

আগস্ট ১৬, ২০২৫ ১০:২৮
Link Copied!

স্টাফ রিপোর্টার : একসঙ্গে একই পরিবারের চারজনের মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে বামনশিকড় গ্রাম। বাড়ির সামনে, উঠোনে বসে আছেন নারীরা। তারা মুখে কাপড় দিয়ে কান্না আড়াল করছেন। ভেজা চোখে স্বজনদের কেউ কেউ আবার হাহাকার করে উঠছেন হঠাৎ হঠাৎ। দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে তারা স্মৃতিচারণ করছেন মিনারুল, মনিরা, মাহিম আর ছোট্ট মিথিলাকে নিয়ে।

শনিবার দুপুরে রাজশাহীর পবা উপজেলার এ গ্রামে গিয়ে এমন দৃশ্যই চোখে পড়ে। প্রতিবেশীরা বলেছেন, এর আগে কখনও এমন মর্মান্তিক দৃশ্য তারা দেখেননি। এ গ্রামের গোরস্থানেই শনিবার বিকেলে মিনারুল ইসলাম (৩০) ও তার ছেলে মাহিমকে (১৪) পাশাপাশি কবরে দাফন করা হয়। আর মিনারুলের শ্বশুরবাড়ির ইচ্ছা অনুযায়ী স্ত্রী মনিরা খাতুন (২৮) ও মেয়ে মিথিলাকে (৩) দাফন করা হয় রাজশাহী নগরের টিকাপাড়া গোরস্থানে।

ছোট্ট মিথিলা আধো আধো শব্দে কথা বলত। তার জন্য দাদি আঞ্জুয়ারা বেগমের ছিল অগাধ স্নেহ ও ভালোবাসা। মিথিলার যেকোনো ছোট্ট আবদারও নিমিষেই পূরণ করতেন আঞ্জুয়ারা বেগম। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আদরের মিথিলা দাদির কাছে মাছ খাওয়ার বায়না ধরেছিল। কিন্তু এটিই যে তার জীবনের শেষ ইচ্ছে হয়ে থাকবে, তা ভাবতেও পারেননি দাদি।

শনিবার সকালে নাতনির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন আঞ্জুয়ারা। বারবার বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘দাদু আমার মাছ খেতে খুব ভালোবাসত। আগের দিন দুপুরে আমাকে মাছ রান্না করে দিতে বলেছিল। কিন্তু তখন বাড়িতে মাছ ছিল না। তাই সকালেই বাজার থেকে মাছ কিনে এনেছিলাম। সকাল ৭টার মধ্যে রান্না শেষও করেছিলাম। কিন্তু মিথিলা আর ওঠেনি। তার মাছ খাওয়ার শেষ ইচ্ছে আমি পূরণ করতে পারিনি।’

আরও পড়ুনঃ  দ্বিগুণ লিড নেওয়া টটেনহ্যামকে কাঁদিয়ে সুপার কাপ জিতল পিএসজি

শুক্রবার সকালে মিনারুল, তার স্ত্রী মনিরা, ছেলে মাহিম ও মেয়ে মিথিলার লাশ উদ্ধার করা হয়। একটি ঘরের বিছানায় ছিল মনিরা ও মিথিলার লাশ। আর পাশের ঘরের বিছানায় ছিল মাহিমের লাশ। এ ঘরেই ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছিলেন মিনারুল। ঘর থেকে দুই পাতার একটি চিরকুট উদ্ধার করা হয়। এটি মিনারুল লিখে গিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমি নিজ হাতে সবাইকে মারলাম। এ কারণে যে, আমি একা যদি মরে যাই, তাহলে আমার বউ, ছেলে, মেয়ে কার আশায় বেঁচে থাকবে? কষ্ট আর দুঃখ ছাড়া কিছুই পাবে না। আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে। এত কষ্ট আর মেনে নিতে পারছি না। তাই আমাদের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলাম, সেই ভাল হলো।’

এতে আরও লেখা আছে, ‘আমি মিনারুল প্রথমে আমার বউকে মেরেছি। তারপর আমার মাহিনকে মেরেছি। তারপর আমার মিথিলাকে মেরেছি। তারপর আমি নিজে গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছি।’

অত্যন্ত হৃদয়বিদারক এ ঘটনাটির পর মিনারুলকে নিয়েই সর্বত্র আলোচনা চলছে। কাটেনি গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া। মিনারুলের আচার-ব্যবহার, মানুষের সাথে কথাবার্তা আর চলাফেরা নিয়ে কথা বলছেন প্রতিবেশিরা। গ্রামের কৃষক হাসান আলী বলেন, ‘মিনারুল খুব ভালো ছেলে ছিলো। কারও সাথে খুব বেশি মিশত না, খুব ভদ্র ছিলো। মাথা নিচু করে চলত। কিন্তু ঋণের কারণে, এক কথা এনজিওর চাপে স্ত্রী ও সন্তানদেরকে নিয়ে মিনারুল এমনটি করেছেন।’

আরও পড়ুনঃ  ‘শূন্য থেকে শুরু করতে সমস্যা ছিল না’

তিনি বলেন, ‘কিস্তির টাকা দিতে দেরি হলে এনজিওর লোকেরা মিনারুলের বাড়িতে এসে বসে থাকত। যতক্ষণ পর্যন্ত টাকা না দিত, ততক্ষণ উঠতেন না। রাত আটটা থেকে নয়টা পর্যন্তও তারা বসে থাকতেন। এগুলো নিয়ে মিনারুল খুব বিব্রত হত। তারও মানইজ্জত ছিল। এটি নিয়ে মিনারুল লজ্জা পেত। কিস্তি দিতে গিয়ে অভাব লেগে থাকত। শুনেছি, অনেক টাকা ঋণও ছিলো। এ কারণেই হয়ত মিনারুল পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলে গেল।’

শুক্রবার লাশ চারটি বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মর্গে রাখা হয়েছিল। শনিবার দুপুরের পর ময়নাতদন্ত শেষে হস্তান্তর করা হয়। এর মধ্যে মিনারুল এবং তার ছেলে মাহিমের মরদেহ তার বাবা রুস্তম আলী এবং বড় ভাই রুহুল আমিনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আর মনিরা এবং তার মেয়ে মিথিলার মরদেহ তার বাবা আব্দুস সালাম এবং মা শিউলি বেগম তাদের রাজশাহী মহানগরীর তালাইমারি এলাকার বাড়ি নিয়ে যান।

পবার পারিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শায়েদ আলী মোর্শেদ বলেন, ‘আব্দুস সালাম এবং শিউলি বেগমসহ নিকটাত্মীয়রা মনিরা ও মিথিলার লাশ তাদের নিজ এলাকায় দাফনের জন্য আমাদের কাছে অনুরোধ করেন। তারা তাদের মেয়ে এবং নাতনির লাশ নিজ এলাকায় দাফন করলে মানসিক শান্তি পাবেন বলছিলেন। তাই মনিরা ও মিথিলার লাশ তাদের দেওয়া হয়। মিনারুল আর তার ছেলের লাশ বাবাকে দেয়া হয়। তারা গ্রামে লাশ দাফন করেন।’

আরও পড়ুনঃ  উইজডেন প্রকাশিত শতাব্দীর সেরা ১৫ টেস্ট সিরিজের দুটিতে বাংলাদেশ

এদিকে মিনারুল এবং তার ছেলে মাহিমের লাশ শনিবার বিকেলে পবা উপজেলার বামনশিকড় গ্রামে পৌঁছালে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। শুরু হয় শোকের মাতম। বাবা ও ছেলেকে শেষবারের মত একনজর দেখার জন্য মানুষের ঢল নামে। কয়েকশ মানুষ চোখের পানি ফেলে বাবা-ছেলের জানাজায় অংশ নেন। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মনিরা এবং তার মেয়ে মিথিলাকে রাজশাহী নগরের টিকাপাড়া গোরস্থানে দাফন করা হয়।

মিনারুলের বাবা রুস্তম আলী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘সবাই একসাথে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল। আমরা চারজনেরই লাশ চেয়েছি। ইচ্ছে ছিলো তাদের দাফন একসঙ্গেই হবে। কিন্তু সেটি আর হলো না। মৃত্যুর পরেও তারা ঠাঁই ঠাঁই হয়ে গেল। একসঙ্গে থাকতে পারল না। মনিবার বাবা-মায়ের অনুরোধের প্রেক্ষিতেই আমরা পৃথক স্থানে দাফনের বিষয়টি মেনে নিয়েছি।’

এদিকে একই পরিবারের চারজনের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি হত্যা মামলা, অন্যটি অপমৃত্যুর মামলা। শুক্রবার রাতেই রাজশাহীর মতিহার থানায় মামলা দুটি দায়ের করা হয়। মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মালেক জানান, মিনারুলের আত্মহত্যার ঘটনায় তার বাবা রুস্তম আলী বাদী হয়ে অপমৃত্যুর মামলা করেছেন। আর মনিরা, মাহিম ও মিথিলাকে শ্বাসরোধে হত্যার অভিযোগে হত্যা মামলাটি দায়ের করেছেন মনিরার মা শিউলী বেগম। তবে আসামি হিসেবে মামলা দুটিতে কারও নাম উল্লেখ নেই। আসামি অজ্ঞাত। তদন্তের পর এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান ওসি।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময়ের কথা ২৪ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন somoyerkotha24news@gmail.com ঠিকানায়।