অনলাইন ডেস্ক : বাংলাদেশ-চীনের নানামুখী সম্পর্ক। ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গনও দুই দেশ পারস্পরিক বিনিময়ে কাজ করছে। দীর্ঘ প্রতিবেদনে দুই দেশের ক্রীড়া সম্পর্কের নানা বিষয় তুলে ধরা হয়েছে –
২০১০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমসে গেমসে বাংলাদেশ উশুতে স্বর্ণপদক অর্জন করে। এরপর থেকে মূলত ক্রীড়াঙ্গনে উশু আলোচিত হয়। আন্তর্জাতিক সাফল্যের আগেই চীন বাংলাদেশের উশুতে সহায়তা করে আসছে। ২০০৯ সালে সান্দা ও থালাউ দু’টি ফরম্যাটের ম্যাট দিয়েছিল বাংলাদেশস্থ চীন দূতাবাস।
প্রায় দেড় যুগ বাংলাদেশস্থ চীন দূতাবাস বাংলাদেশ উশু ফেডারেশনকে নানা সহায়তা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ উশু ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দুলাল হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের উশুতে চীনের অবদান অনেক। ২০১৭ সাল থেকে নিয়মিত এম্বাসেডর কাপ হচ্ছে। এটা সম্পূর্ণ চীনের অর্থায়নে। শুধু প্রতিযোগিতা আয়োজনই নয়, প্রশিক্ষণ সামগ্রি, ম্যাট দিয়েও তারা সহায়তা করে।’
ফুটবল, ক্রিকেট বাদে অন্য সকল ফেডারেশন আর্থিক, অবকাঠামোসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে উশুর এক ভরসার নাম চীন। ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘বাংলাদেশের উশুর অকৃত্রিম বন্ধু চীন। আর্থিক, ট্যাকনিক্যাল সব দিক থেকে তারা সহায়তা করছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত প্রায় অর্ধ কোটি টাকা মূলের উশু সামগ্রী ফেডারেশনকে দিয়েছিল।’
ম্যাট সংরক্ষণ করা কঠিন। বাংলাদেশ উশু ফেডারেশনের নিজস্ব ভেন্যুও নেই। তাই অনেক ম্যাট জেলা পর্যায়ে পাঠিয়েছে উশু ফেডারেশন, ‘চীনের দেয়া ম্যাট ও উশু প্রশিক্ষণ সামগ্রী জেলা পর্যায়ে দেয়া হয়েছে। যাতে তৃণমূল পর্যায়ে উশুর প্রচলন ও চর্চা হয়।’
উশুতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বরাদ্দ খুবই সীমিত। তেমন পৃষ্ঠপোষকতাও পায় না উশু ফেডারেশন। বাংলাদেশস্থ চীন দূতাবাস উশু ফেডারেশনের বড় সহায়ক শক্তি।
বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের আতুড়ঘর বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)। বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি কিংবা সমঝোতা স্মারক রয়েছে। বাংলাদেশের একমাত্র ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপির ২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত সেই রকম কোনো চুক্তি ছিল না দেশের বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে।
২০১৭ সালে শেন ইয়াং স্পোর্টস ইউনিভার্সিটির সঙ্গে বিকেএসপির প্রথম চুক্তি হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় চীনের অনকে অলিম্পিয়ান উপহার দিয়েছে। বিকেএসপি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের আওতায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ জন ক্রীড়াবিদ পাঠিয়েছিলেন। উন্নত আবহে তারা কয়েক মাস প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।
২০২৪ সালে ইউনান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ৫ বছরের চুক্তি হয় বিকেএসপির। এই চুক্তির আলোকে বিকেএসপির মেধাবী শিক্ষার্থীরা চীনের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তির মাধ্যমে পড়াশোনা করতে পারছে। বিকেএসপির পরিচালক প্রশিক্ষণ লে কর্ণেল হাসান বলেন, ‘অতি সম্প্রতি মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের চার জন শিক্ষার্থী গেছেন। সেখানে তারা চার বছর মেয়াদী অনার্স করবেন। এটা সম্পূর্ণ চীনের খরচ। বিকেএসপি এবং শিক্ষার্থীদের কোনো ব্যয় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতি শিক্ষার্থীকে ৮০০ আরমবি করে প্রদান করবে। আমদের শিক্ষার্থীরা সেই বিশ্ববিদ্যালয় দলের হয়ে খেলতে পারবে। তারা যদি সেখানে ভালো পারফরম্যান্স করতে পারে সেখানে চাকরিরও সুযোগ মিলবে।’
খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্নে বিকেএসপিতে ভর্তি হন অনেক তরুণ-তরুণী। অনুশীলন বা জাতীয় প্রতিযোগিতার কোনো টুর্নামেন্টে আঘাত পেয়ে ক্রীড়াঙ্গন থেকে ছিটকে যাওয়ার ঘটনা রয়েছে অনেক। বিকেএসপির মেডিক্যাল সেন্টার থাকলেও আধুনিক ও উন্নত মানের ইনজুরি পুর্নবাসন ব্যবস্থা সেভাবে নেই।
চীন বিকেএসপিতে আধুনিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার নির্মাণ করবে। এই প্রসঙ্গে বিকেএসপির পরিচালক (প্রশিক্ষণ) হাসান বলেন, ‘উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাফিলিয়েটেড হাসপাতালের মাধ্যমে বিকেএসপিতে আধুনিক ইনজুরি পুর্নবাসন সেন্টার হবে। ইতোমধ্যে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এটি শীঘ্রই কাজ শুরু হবে। এটি হলে বিকেএসপির ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক উপকৃত হবে।’
ইনজুরি পুর্নবাসন সেন্টারের পাশাপাশি একটি ভাষা সেন্টারও খুলবে চীন বিকেএসপিতে। এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের সাথে চীনের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তি রয়েছে। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে বিকেএসপির সম্পর্ক বিস্তৃত হচ্ছে। এজন্য চীন-বাংলা দুই ভাষা উভয়ের জন্য প্রয়োজন। তাই বিকেএসপিতে একটি ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টারও হওয়ার কাজ চলছে।’
বিকেএসপিতে তাইচি সেন্টার, মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশ-চীন ফ্রেন্ডশিপ ক্রিকেট সেন্টার’
ইউনান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয় বিকেএসপিতে চীনের বিশ্ববিদ্যালয় তাইচি সেন্টার উদ্বোধন করেছে। বাংলাদেশে উশুকে চাইনিজ ভাষায় তাইচি সেন্টার বলা হয়। তাইচি সেন্টারের মাধ্যমে বাংলাদেশের উশুর মান অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি বছর এপ্রিলে চীনের দুই জন প্রশিক্ষক এক মাস বিকেএসপিতে অবস্থান করে উশু প্রশিক্ষণ দেন।
চীন অলিম্পিকে দাপট দেখায়। বিশ্বের অনেক শীর্ষ খেলায় তারা বড় অবস্থানে থাকলেও ক্রিকেটে তারা পিছিয়ে। বাংলাদেশ চীনের ক্রিকেটের উন্নয়নে কাজ করছে। মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকেএসপি একটি বাংলাদেশ ক্রিকেট সেন্টার করেছে। যেটার আনুষ্ঠানিক নাম দেয়া হয়েছে, ‘বাংলাদেশ-চীন ফ্রেন্ডশিপ ক্রিকেট সেন্টার।’ সেখানে বিকেএসপির কোচরা গিয়ে ক্রিকেট শেখান। বাংলাদেশে যখন উশু শেখাতে আসেন তখন চীনের অনেকে ক্রিকেট শেখার জন্যও আসেন।
মাল্টি স্পোর্টস ডিসিপ্লিনে অলিম্পিকের পরই এশিয়ান গেমসের অবস্থান। সাম্প্রতিক সময়ে চীন দুই বার এশিয়ান গেমস আয়োজন করেছে। ২০১০ সালে গুয়াংজু এবং ২০২৩ সালে হাংজুতে। দুই গেমসেই ক্রিকেট ডিসিপ্লিন ছিল। দুই বারই ক্রিকেট পীচ ও আউটফিল্ড দক্ষতার সাথে তৈরি করেছেন বাংলাদেশের অভিজ্ঞ গ্রাউন্ডসম্যান জসিম।
২০২৩ সালে হাংজু এশিয়ান গেমসে ক্রিকেটের ভেন্যু ছিল জিজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। সেই ক্যাম্পাসের এক কোণে পাহাড়ের কোল ঘোষে ছোট্ট একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম। সেই পিচ ও মাঠের তত্ত্ববধায়ন করেছে বাংলাদেশ।
হাংজু এশিয়ান গেমসের পিচ ও গ্রাউন্ডস নির্মাণ সম্পর্কে জসিম বলেন, ‘এক বছরের বেশি সময় লেগেছে মাঠ ও পিচ তৈরিতে। আমরা নির্দেশনাতে এটা হয়েছে দু’জন কিউরেটরকে আমি সার্বক্ষণিক তদারকি করেছি।’
২০১০ চীনের গুয়াংজুতে এশিয়ান গেমসের পিচ ও সামগ্রিক মাঠ ব্যবস্থাপনায় ছিলেন জসিমই। চীনের দু’টি এশিয়ান গেমসের ক্রিকেট মাঠের সঙ্গে থাকতে পেরে তৃপ্ত জসিম, ‘বাংলাদেশ কখনো এশিয়ান গেমস আয়োজন করতে পারেনি, পারবে কিনা আদৌ জানি না। চীনের দু’টি এশিয়ান গেমসে ক্রিকেট মাঠ, পিচ তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে গর্বিত কারণ বাংলাদেশ আয়োজনের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত থাকল। গুয়াংজু গেমসের পিচ তৈরি, মাঠের সকল কিছুতেই আমি ছিলাম।’
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সিইও নিজামউদ্দিন চৌধুরি সুজন বলেন, ‘চীন ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে আমাদের সুসম্পক। চীনে দুই এশিয়ান গেমসে গ্রাউন্ডস সংক্রান্ত বিষয়ে বিসিবি সর্বাত্মক অবদান রাখার চেষ্টা করেছে।’
চীন ক্রিকেটে উন্নয়নের চেষ্টা করছে। সেই উন্নয়নের সারথি হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশ। চীন নারী ক্রিকেট দলের কোচ হিসেবে কাজ করছেন ফাতেমা তুজ জোহরা। চীনের নারী ক্রিকেট উন্নয়ন নিয়ে তিনি অবদান রাখার ব্যাপারে আশাবাদী, ‘চীন ক্রিকেটে এগিয়ে আসছে। চীনের নারী ক্রিকেটের উন্নয়নে বাংলাদেশের একজন সাবেক নারী ক্রিকেটার ট্যাকনিক্যাল পারসন হিসেবে কাজ করছে। এটা বাংলাদেশের জন্য দারুণ ব্যাপার।’
২০২৫ সাল বাংলাদেশ-চীন কূটনীতির ৫০ বছর। দুই দেশের কূটনীতির ৫০ বছর উপলক্ষ্যে নানা ক্ষেত্রে নানা আয়োজন ও কর্মসূচি রয়েছে। এর মধ্যে ফুটবলে সৌহাদ্যপূর্ণ ম্যাচ হয়েছে। ২০ সেপ্টেম্বর জাতীয় স্টেডিয়ামে চাইনিজ বিশ্ববিদ্যালয় মহিলা ফুটবল উইনাইটেড দল ও বাফুফের একাডেমি দল একটি প্রীতি ম্যাচ খেলে। ঐ ম্যাচে চীনের বিশ্ববিদ্যালয় দল ৩-০ গোলে জয়লাভ করে।
ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন ঐ দিন দুই দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সম্পর্ক নিয়ে বলেন, ‘চীন ও বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনে এক সঙ্গে কাজ করবে। ক্রিকেট বাংলাদেশ চীনকে এবং ফুটবল, উশুতে চীন বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পারে। দুই দেশের মধ্যকার ক্রীড়া বিনিময় অব্যাহত থাকবে।’
চীনের বিশ্ববিদ্যালয় নারী দলের আগমনের পর বাংলাদেশ অ-১৭ একাডেমি দল চীনের আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে। সেই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ রানার্স আপ হয়ে দেশে ফেরে।
টেনিস বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা হলেও বাংলাদেশে তেমন প্রচার-প্রসার নেই। বাংলাদেশে প্রচার-প্রসার না থাকলেও বাংলাদেশি কোচরা চীনে দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন। তাই টেনিস খেলোয়াড় ও কোচদের লক্ষ্যই থাকে চীন যাওয়া।
বাংলাদেশের টেনিসের অন্যতম সিনিয়র সংগঠক ইশতিয়াক আহমেদ কারেন, ফেডারেশনের বর্তমান সাধারণ সম্পাদকও। তিনি বলেন, ‘টেনিস বেশ ব্যয়বহুল খেলা। এখানে টেনিসকে পুরোপুরি ক্যারিয়ার হিসেবে নেয়াটা বেশ চ্যালেঞ্জিংই। এজন্য অনেক টেনিস খেলোয়াড় ও কোচরা চীনে কাজে আগ্রহী হচ্ছে। সুযোগ, সম্মান, সব দিক থেকেই চীন এখন বাংলাদেশের টেনিসের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র ও নির্ভরতার জায়গা।’
চীনের গুয়াংজু, সাংহাই, বেইজিংসহ আরো কয়েকটি প্রদেশ মিলিয়ে ৩০ জনের কাছাকাছি বাংলাদেশি টেনিস কোচ রয়েছেন। এই কোচদের মধ্যে বিকেএসপির সাবেক শিক্ষার্থী আক্তার নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়েছেন।
চীনে যত সংখ্যক ভালো মানের বাংলাদেশি কোচ রয়েছেন বাংলাদেশেও এত নেই। এ সম্পর্কে বেইজিংয়ে কাজ করা বাংলাদেশি টেনিস কোচ আক্তারের ব্যাখ্যা, ‘চীনে আমরা সম্মানী যেমন পাই, সম্মানও যথেষ্ট। বাংলাদেশে অনেক কোচকে মার্কারী হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। এখানে আমাদের মেধার যেমন কদর তেমনি পরিশ্রমেরও দাম যথেষ্ট।’
বাংলাদেশের অনেক খেলায় নারী কোচ সংকট। দেশেই যখন অনেক নারী কোচ কাজের সুযোগ পান না। সেখানে চীনে বাংলাদেশি নারী কোচ রয়েছেন বেশ কয়েকজন। বিকেএসপির প্রথম নারী ব্যাচের শিক্ষার্থী রুমা কয়েকবার বাংলাদেশের জাতীয় টেনিস চ্যাম্পিয়ন। তিনি এখন চীনের সাংহাইয়ে বেশ সুনামের সঙ্গেই কোচিং করাচ্ছেন। ‘এখানে বাচ্চাদের টেনিস শেখানোর জন্য অভিভাবক ও কোচিং একাডেমিগুলো নারীদের একটু প্রাধান্য দেয় কারণ নারীরা একটু বেশি ধৈয্য নিয়ে বাচ্চাদের শেখাতে পারে’, সাংহাই থেকে বলেন রুমা।
২০০৫ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থী মুরাদ, আক্তার ও মিজান চীনে কোচিং করাতে আসেন। এরপর ধীরে ধীরে আরো অনেকে এসেছেন। চীনে আগমন ও থিতু হওয়া সম্পর্কে সাংহাই থেকে মিজান বলেন, ‘আমরা একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে চীনে আসি। ২০০৫ সালে তিন মাসের একটি প্রজেক্টে আসি। সেই প্রজেক্টে ট্রেনিংয়ের পর আমরা ধীরে ধীরে নিজেকে চীনে প্রতিষ্ঠিত করি।’
আগে বাংলাদেশি টেনিস কোচরা অন্য দেশের টেনিস একাডেমিতে কাজ করতেন। এখন বাংলাদেশিরাই টেনিস কোচিং একাডেমি দিয়েছেন। সেখানে দেশি-বিদেশি অনেকেই কাজ করে। গুয়াংজুতে রিজভী ও সাংহাইয়ে শাহনেওয়াজের একাডেমি এখন বেশ প্রতিষ্ঠিত।
দুই দশকের বেশি সময় বাংলাদেশের টেনিস কোচরা চীনে কাজ করছেন। পেশাগত কাজে চীন থেকে তারা ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা অনেক দেশেই যান। এরপরও তাদের ভরসা চীনেই। চীনে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের কোচ শাহনেওয়াজ আহমেদ সাংহাই থেকে বলেন, ‘সম্মান একটা বড় বিষয়। চীনে আমরা ভালো সম্মান পাই। অন্য দেশে গেলে অর্থও পাব কিন্তু সম্মানটা হয়তো সেভাবে পাব না এজন্য আমি চীনেই থাকছি। আমার মতো অনেকেই এ রকম ভাবনা।’
মিজান-আক্তাররা চীনে রয়েছেন প্রায় দেড় যুগ। চীনের টেনিসে কাজের সুবাদে বিশ্বের অনেক দেশেই গিয়েছেন। টেনিসে আরো উন্নত দেশগুলোতে স্থানান্তরিত না হওয়ার কারণ সম্পর্কে মিজান বলেন, ‘এখানে আমরা সেটেল। অনেকে পরিবারও এনেছে। নতুন জায়গায় গেলে নতুন করে নিজেকে চেনানো, ভাষা সংস্কৃতিরও ব্যাপার রয়েছে। তাই এখানেই ভালো লাগছে।’
চীনের টেনিসে যারা কাজ করছেন তারা বেশ উন্নত মানের কোচ। এখানে বেশ ভালো থাকলেও বাংলাদেশ নিয়ে ঠিকই আফসোস রয়েছে। আক্তার বলেন, ‘টেনিসের কাজে যখন অন্য দেশে যাই তখনই মনে বাজে ইশ বাংলাদেশ যদি খেলত বা বাংলাদেশের কেউ যদি এখানে আসত। বাংলাদেশের ফেডারেশন, সরকারসহ সব পক্ষের সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন।’
২০০৫ সালে সাবেক টেনিস খেলোয়াড় সুকুমার রায় প্রথমে কোচিংয়ের উদ্দেশ্যে চীনে যান। তাকে অনুসরণ করেই শাহনেওয়া এবং অন্যরা চীনের পথিক হয়েছেন। চীন-বাংলাদেশ টেনিসে যোগসূত্র সম্পর্কে শাহনেয়াজ বলেন, ‘সুকুমার দা চট্টগ্রাম ক্লাবে টেনিস শেখাতেন। সেখানে চাইনিজ ভদ্রলোক টেনিস খেলতেন। চীনে একটি একাডেমি কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানে কোচ প্রয়োজন এ রকমটি তিনি জানতে পারেন। সুকুমার দা’র দক্ষতা দেখে তিনি সুকুমার দা’কে জানান এরপর সুকুমার দা আগ্রহী হন। বাংলাদেশে টেনিসে কাজের সুযোগ সীমিত ছিল পরবর্তীতে চীনের দ্বার উন্মোচন হওয়ায় সবাই এদিকে আগ্রহী হয়।’
চীনের টেনিসে এই মুহুর্তে অন্যতম সেরা নারী টেনিস খেলোয়াড় জাং ছিং। তিনি ২০২৩ সালে এশিয়ান গেমসে নারী এককে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ঐ বছরই নারী অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে রানার্স আপ হন। চীনের অন্যতম সেরা নারী এই টেনিস খেলোয়াড় জাং ছিং ওয়েনের বাল্যগুরু বাংলাদেশি টেনিস কোচ আক্তার হোসেন।
বেইজিংয়ে আক্তারের কাছে ২০১৩-১৮ সাল পর্যন্ত টেনিস দীক্ষা নিয়েছিলেন জাং। বেইজিংয়ে টেনিসের বেসিক শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি জাং ছিংয়ের চীনের বাইরেও অনেক টুর্নামেন্টের কোচ ছিলেন আক্তার। নিজের শিষ্য এখন চীনের পাশাপাশি বিশ্ব টেনিসের অন্যতম একজন খেলোয়াড় এতে বেশ তৃপ্ত বাংলাদেশি কোচ আক্তার, ‘আমার এক সময়ের শিষ্য এশিয়ান গেমসে স্বর্ণ জিতেছে। উইমল্বডনেও সেমিফাইনাল খেলেছিলেন। বাংলাদেশের কোচের এর চেয়ে প্রাপ্তি আর কি হতে পারে!’
জিং’কে কোচিং করানোর ঘটনা আক্তার বললেন এভাবে, ‘বেইজিংয়ে আমি একটা ক্লাবে কোচিং করাতাম সেখানে জাং ছিং টেনিস শিখেছে। তার সাড়ে ১১ বছর বয়স থেকে ১৬ পর্যন্ত আমার তত্ত্বাবধানে ছিল।’ টেনিসে জুনিয়র পর্যায়ের এই টুর্নামেন্টগুলো খেলোয়াড়দের নিজেদেরই বহন করতে হয়। জাংয়ের অভিভাবক মেয়ের সঙ্গে কোচ হিসেবে আক্তারকেই প্রেরণ করেছেন। জাংয়ের টেনিসে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে আক্তারের অবদানের কথা বিভিন্ন সময় স্বীকার করেছে তার পরিবার।
চীনের বেইজিংয়ে আক্তার যে ক্লাবে কাজ করতেন সেখানে ছিলেন জাস্টিন হেনিনের কোচ কার্লোস রদ্রিগেজ। উপদেষ্টা/প্রধান কোচরা একাডেমি/কোচিংয়ে খেলোয়াড়দের অন্য কোচদের মধ্যে ভাগ করে দেন। কার্লোস রদ্রিগেজ জাংকে আক্তারের অধীনে দিয়েছিলেন। আমেরিকার জুনিয়র দু’টি টুর্নামেন্ট বিশ্বের মধ্যে নামকরা। ওই টুর্নামেন্টের শীর্ষ স্থানধারীরা পরে বিশ্ব টেনিসে প্রতিষ্ঠিত নাম হয়। সেই টুর্নামেন্টে আক্তার একাধিকবার জাং ছিংয়ের কোচ হয়ে গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশন আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্ট আয়োজন করে। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এটিএফ টেনিস টুর্নামেন্টে বালক দ্বৈত বিভাগে রানার্স আপ হয়েছেন চুয়ান ডিং ও কেঝি লি। তারা দুই জনই বাংলাদেশে খেলে ও পদক জিতে বেশ সন্তোষ প্রকাশ করেন, ‘এই টুর্নামেন্টে খেলে আমাদের মান যাচাই করতে পেরেছি। টুর্নামেন্ট মান ও ব্যবস্থাপনা উভয়ই ভালো।’
ঢাকায় আমন্ত্রিত টুর্নামেন্টগুলোতে চীন থেকে অনেক খেলোয়াড় নিজ উদ্যোগ কিংবা উৎসাহে আসেন। আবার অনেক সময় চীনের বিভিন্ন একাডেমি কিংবা ক্লাবে কাজ করা বাংলাদেশের কোচের মাধ্যমেও আসেন। এবার বালক দ্বৈত বিভাগে অংশ নেয়া দুই চাইনিজ খেলোয়াড় এসেছিলেন শাহনেয়াজের সাথে। ২০১৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আইটিএফ কাপে বালক দ্বৈত বিভাগে আক্তারের চাইনিজ শিষ্যরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।

