স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহীর বারনই এখন একটি ‘বিষাক্ত’ নদী। দুর্গন্ধে নদীর কাছেই যেতে পারে না মানুষ। এ অবস্থায় রাজশাহীতে ‘জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বারনই নদী রক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সভায় নদীপাড়ের বাসিন্দাদের মুখে নদীটিরই আর্তনাদ ফুটে উঠেছে। সোমবার বিকেলে রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা মহিলা ডিগ্রী কলেজ মিলনায়তনে এ সভার আয়োজন করা হয়।
এর আগে সকালে নওহাটার নদীপাড়ে গম্ভীরার আয়োজন করা হয়। ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরার মাধ্যমে বারনই নদী দূষণের ফলে দুপাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও কৃষির ওপর কী বিরূপ প্রভাব পড়েছে তা ফুটিয়ে তোলা হয়। এরপর বারনই রক্ষার দাবিতে নদীপাড়েই একটি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। ‘নদীর জন্য একসাথে-নদী রক্ষায় প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ’ স্লোগানে সমন্বিতভাবে দিনব্যাপী এ কর্মসূচির আয়োজন করে বেসরকারি সংস্থা এএলআরডি, রুলফাও ও বেলা। বুকস, মাসাউস, পরিবর্তন ও দিনের আলো হিজড়া সংঘসহ ১২টি সংগঠন এতে সহায়তা করে। অংশ নেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা।
রাজশাহীর নওহাটায় শিব নদী থেকে বারনইয়ের উৎপত্তি। এটি নাটোরের সিংড়ায় গিয়ে আত্রাই নদীতে মিলিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৩ কিলোমিটার। গড় প্রস্থ ৫১ মিটার। খাল হয়ে এ নদীতেই এখন গিয়ে পড়ে সিটি করপোরেশন এলাকার দূষিত বর্জ্যপানি। এছাড়া নদীর দুপাশের বিভিন্ন হাট-বাজারের ময়লা-আবর্জনাও নদীতে ফেলা হয়। ফলে নদীটি এখন এতই দূষিত যে মাছও বাঁচতে পারে না। পানিতে নামলে হয় চর্মরোগ।
আলোচনা সভায় নওহাটা এলাকার সাংস্কৃতিককর্মী মোস্তফা সরকার বিজলী বলেন, ‘সিটি করপোরেশন এলাকার বসতবাড়ির শৌচাগারের মল চলে আসে ড্রেনে। সেই ড্রেনের পানি খাল দিয়ে আসে বারনই নদীতে। এ পানি আর ব্যবহার করা যায় না। নদীপাড়ের প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ চর্মরোগে ভুগছেন নদীর পানি ব্যবহার করে। পানি এতই দূষিত যে মাছ বাঁচে না। পবার দুয়ারি থেকে নওহাটা পর্যন্ত এলাকায় দুর্গন্ধে ঘরবাড়ির জানালা বন্ধ রাখতে হয়।’
বারনইয়ের দূষিত পানি শিব নদী হয়ে তানোরেও যাচ্ছে বলে সভায় অংশ নিয়ে জানান পৌরসভার সাবেক নারী কাউন্সিলর মোমেনা আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এই নদীটা দখলের কারণে মৃতপ্রায়। দ্রুত নদীর সীমানা নির্ধারণ করে পিলার স্থাপন করতে হবে। নদীকে বাঁচাতে হবে।’
নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি রিপন আলী বলেন, ‘এই নদী দিয়ে আমাদের বাপ-দাদারা নৌকায় করে বাগমারার তাহেরপুরে কৃষিপণ্য নিয়ে আসতেন। এখন বছরের বেশিরভাগ সময় পানি থাকে না। পুঠিয়ায় অপরিকল্পিতভাবে রাবার ড্যাম নির্মাণের কারণে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে প্রচুর কচুরিপানা থাকে। এখন নৌপথও বন্ধ হয়ে গেছে।’
বাগমারা প্রেসক্লাবের সভাপতি রাশেদুল হক ফিরোজ বলেন, নদীর দুপাড়ের হাট-বাজার থেকে প্রচুর ময়লা-আবর্জনা নদীতে ফেলার কারণে নদীটি নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। এটি ড্রেজিং করতে হবে। রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, পৌরসভার মেয়ররা নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধ করেন না। কারণ, নদী যতই ভরাট হবে, ততই দখল সহজ হবে। এভাবে নদীর দুইপাশে বহু অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
উন্নয়নকর্মী সম্রাট রায়হানের পরিচালনায় আরও বক্তব্য দেন- এএলআরডির প্রতিনিধি সানজিদা খান রিপা, নওহাটা পৌরসভার সাবেক মেয়র মকবুল হোসেন, সাংবাদিক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, সাংস্কৃতিককর্মী ওয়ালিউর রহমান বাবু, কলেজশিক্ষক মাসুদ রানা প্রমুখ। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন রুলফাও-এর নির্বাহী পরিচালক আফজাল হোসেন।
সভায় অংশ নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাজশাহীর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী পার্থ সরকার, পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহীর সহকারী পরিচালক কবির হোসেন ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা সেলিম রেজা তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে বারনই রক্ষায় ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার করেন।